দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ দু’দিন আগেই নেতাজির জন্মজয়ন্তীতে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের অনুষ্ঠানে ‘জয় শ্রী রাম’ ধ্বনি শুনে মঞ্চ ছেড়ে নেমে এসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নামার আগে বলেছিলেন, এটা কোনও রাজনৈতিক দলের অনুষ্ঠান নয়, তাই তিনি কিছু বলবেন না। তারপর থেকে গত ৪৮ ঘণ্টায় রাজ্য রাজনীতির সবথেকে চর্চিত এই ভিক্টোরিয়ার ঘটনা। এই প্রসঙ্গে এবার মুখ খুললেন মমতা।
হুগলির পুরশুড়ায় তৃণমূলের সভা থেকে এই ঘটনার জন্য বিজেপিকে আক্রমণ করলেন মমতা।অপমান মানতে পারেননি বলেই প্রতিবাদে মঞ্চ ছেড়েছিলেন। ভিক্টোরিয়ায় যে কথা বলে বক্তৃতা না দিয়ে নেমে গিয়েছিলেন, সে কথাই আবার বললেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। হুগলির পুরশুড়ায় দলীয় জনসভায়।
এদিন সভামঞ্চে দাঁড়িয়ে ভিক্টোরিয়ার প্রসঙ্গ তুলে এনে মমতা বলেন, “বলুন তো আপনি যদি আমাকে বাড়িতে খেতে ডাকেন, তাহলে কি বলবেন এক থাপ্পড় মারব, বেরিয়ে যাও বাড়ি থেকে? বলবেন কখনও? এটা আমাদের রীতি নয়, সৌজন্যতা নয়, ভদ্রতা নয়। নেতাজি আমাদের সবার নেতা। তার প্রোগ্রামে গেলাম। এত সাহস। কয়েকটা গর্ধ গদ্দার এবং উগ্র গর্ধ ধর্মান্ধ আমায় টিজ (টিটকারি) করছে। নেতাজির জন্মজয়ন্তী পালনের সংস্কৃতি এটা নয়। আসলে নেতাজিকে অপমান করা হয়েছে। বাংলার অপমান, নেতাজির অপমান আমি কিছুতেই মেনে নেব না। সেই জন্যই সে দিন কিছু বলতে আমি অস্বীকার করেছিলাম।’’
দেশের প্রধানমন্ত্রী সামনে বসে। ওরা আমায় চেনে না।”
বিজেপি যে বাংলার মানুষকে, বাংলার সংস্কৃতিকে অপমান করেছে সেই কথা বারবার মানুষের সামনে তুলে ধরেন তিনি। বলেন, “তুমি যদি নেতাজি নেতাজি করতে, আমি স্যালুট জানাতাম। তা না করে বাংলাকে অপমান করেছ, নেতাজি সুভাষকে অপমান করেছ। এর আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অপমান করেছ। বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙেছ।”
শনিবার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রীকে বক্তৃতা করার জন্য আহ্বান জানানোর পরই জয় শ্রীরাম স্লোগানে কেঁপে ওঠে ভিক্টোরিয়া চত্বর। তারপরেই মুখ্যমন্ত্রী মাইকে বলেন, “এটা কোনও রাজনৈতিক দলের প্রোগ্রাম নয়। সরকারি অনুষ্ঠানের একটা ওজন থাকা উচিত। কেন্দ্রীয় সরকার কলকাতায় অনুষ্ঠান করছে। তাঁরা নেমন্তন্ন করে বেইজ্জত করলেন। আমি আর কিছু বলব না। জয় হিন্দ, জয় বাংলা।” এরপর পোডিয়াম থেকে নেমে মঞ্চের চেয়ারে বসে পড়েন মুখ্যমন্ত্রী।
এ নিয়ে যখন রাজনৈতিক বিতর্ক যখন তুঙ্গে তখন বিজেপির মধ্যেই এ নিয়ে মতান্তরের মেঘ জমছে। কেন্দ্রীয় বিজেপির তরফে বাংলার পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয় টুইট করে লিখেছেন “জয় শ্রীরাম স্লোগানে স্বাগত জানোনাকে মমতাজি অপমান ভাবছেন! এ কেমন রাজনীতি।” অনেক বিজেপি নেতাই এই স্লোগানকে খোলাখুলি সমর্থন জানিয়েছেন। তথাগত রায়, জয়প্রকাশ মজুমদাররা বিদ্রুপাত্মক টুইট করেছেন মমতার বিরুদ্ধে। রিমঝিম মিত্রর মতো বিজেপিতে যোগ দেওয়া অভিনেত্রীরা স্পষ্টই বলছেন, দিদি আতঙ্কিত হয়ে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন।
ভিক্টোরিয়ার ঘটনা নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক চলছে। শুধু তৃণমূল নয়, কংগ্রেস আর সিপিএম-ও সে দিনের কাণ্ডকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর অপমান বলে মনে করছে। বিধানসভায় এর বিরুদ্ধে নিন্দাপ্রস্তাব আনতে চলেছে শাসকদল। অন্য দিকে বিজেপি মমতারসে দিনের ভূমিকাকে দেখছে অসৌজন্য হিসেবে ।
পুরশুড়ার সভায় শুধু বিজেপি-কে তোপ দাগা নয়, তৃণমূল ছেড়ে যাওয়া বা ছেড়ে যেতে চাওয়াদের উদ্দেশেও বার্তা দিলেন তৃণমূল নেত্রী। মমতা বলেন, ‘‘যাঁরা বিজেপি-তে যেতে চাইছেন, তাড়াতাড়ি চলে যান। পায়ে গিয়ে পড়ুন! ট্রেন ছেড়ে দেবে না হলে!’’ যাঁরা ইতিমধ্যেই দল পাল্টে ফেলেছেন, তাঁদেরও কটাক্ষ করে তৃণমূল নেত্রী বলেন, ‘‘ওঁরা কালো টাকা সাদা করতে বিজেপি-তে গিয়েছেন। বিজেপি যেন একটা ওয়াশিং মেশিন। গেলেই সব কালো সাদা হয়ে যায়। বেপথে টাকা করে এখন বিজেপিকে ধরে মুক্তি পেতে চাইছেন ওঁরা। যাঁরা দল বদলেছেন, তাঁরা বুঝেছেন, তৃণমূল তাঁদের টিকিট দিত না। এখন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চাইছেন।’’
প্রসঙ্গত, মমতার সভায় আসেননি হুগলির উত্তরপাড়ার তৃণমূল বিধায়ক প্রবীর ঘোষাল। তাঁকে নিয়ে জল্পনার মধ্যেই প্রবীর জানিয়েছেন, মঙ্গলবার তিনি সাংবাদিক বৈঠক করবেন। পক্ষান্তরে, মমতার সভায় দেখা গিয়েছে সিঙ্গুরের তৃণমূল বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যকে। যাঁর পুত্র বিজেপি-তে যাচ্ছেন বলে প্রকাশ্যেই জানিয়েছেন। ইন্টারনেটের সমস্যার কারণে সোমবারের সভা শুরু হতে কিছু দেরি হয়। দুপুর ১টার কিছু পরে বক্তৃতা শুরু করেন মমতা। তিনি প্রথমেই বলেন, ‘‘এই সভা আমি বুথকর্মীদের উৎসর্গ করছি। কেউ গাছ থেকে পড়ে নেতা হয় না। একেবারে নিচু স্তর থেকে লড়াই করেই নেতা হতে হয়।’’
সোমবারের সভায় মহিলাদের উপস্থিতি ছিল আলাদা করে চোখে পড়ার মতো। একেবারে সামনের সারিতেই ছিলেন মহিলারা। উচ্ছ্বাসও ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। বক্তব্যের মধ্যেও বারবার মহিলাদের সামনের সারিতে থাকার কথা তুলে ধরেন মমতা। সম্প্রতি অভিনেত্রী সায়নী ঘোষ বা দেবলীনা দত্তকে বিজেপি-র একাংশের রোষের মুখে পড়তে হয়েছে। সেই প্রসঙ্গে আগেই মুখ খুলেছিলেন মমতা। সোমবারও তিনি সেই ঘটনার উল্লেখ করে মঞ্চের সামনে বসা মহিলাদের উদ্দেশে বলেন, ‘‘হাতা-খুন্তি নিয়ে আপনারা তৈরি থাকুন। বাইকে করে বিজেপি-র গুণ্ডারা এলে রান্না করে দেবেন। আমি চাই আমার মা-বোনেরা এই লড়াইয়ে সামনে থাকুন।’’
তবে গেরুয়া শিবিরের মধ্যে অন্য মতও যে রয়েছে তাও দেখা যাচ্ছে। দলের মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, “গোটা ঘটনাটাই দুর্ভাগ্যজনক। নেতাজি জয়ন্তীর অনুষ্ঠানে জয় শ্রীরাম স্লোগান দেওয়া ঠিক হয়নি। এমন দিনে এই ধরনের ঘটনা একেবারেই অনভিপ্রেত।”
অনেকের মতে, বিজেপির মধ্যে হয়তো কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ফের তৃণমূল বাঙালি-অবাঙালি প্রসঙ্গে বিজেপিকে আক্রমণ করবে। বাংলার মানুষের ভাবাবেগকে নিজেদের দিকে টানার চেষ্টা করবে। তাদের ধারণা যে অমূলক নয়, তার প্রমান কিন্তু পুরশুড়ার সভাতেই মুখ্যমন্ত্রীর গলায় পাওয়া গেল।