দেবন্বিতা চক্রবর্তী,দেশের সময়:
৭৫ বছরে নেতাজির তৈরী আজাদ হিন্দ বাহিনী ,সেই উপলক্ষ্যে আন্দামান নিকোবরের তিনটি দ্বীপের নতুন নামকরন করলেন প্রধানমন্ত্রী ।রস্ আইল্যান্ড এর নাম “নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আইল্যন্ড” ,পাশাপাশি নীল আইল্যান্ড ও হ্যাভলক আইল্যান্ডের নাম ও পরিবর্তিত হয়েছে যথাক্রমে “শহিদ দ্বীপ” ও ” স্বরাজ দ্বীপে” যা স্বয়ং নেতাজির ই রাখা । এতো গেল এখনকার কথা , কিন্তু কালাপানির নামে যে নৃসংসতার ইতিহাস তৎকালীন ব্রিটিশ রাজ রচনা করে গেছে তা আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ও আমাদের রক্তে ঠান্ডা স্ত্রোত বইয়ে দেয় ৷
মনে পড়ে সেই বিখ্যাত লাইন…
“অভিরামের দ্বীপ চালান আর ক্ষুদিরামের ফাঁসি ”
দ্বীপ চালানের পিছনের গল্পটা অনেকের কাছেই জানা থাকার কথা নয় তবে বিনায়ক দামোদর সভারকর নিজের জেলবন্দী জীবন লিপিবদ্ধ করেছেন , ১৯১০ সালে গ্রেফতার হওয়ার পর ১৯১১ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত ৷
তিনি লিখে গেছেন পোর্টব্লেয়ারের বন্দীদের মৃত্যুদূত ডেভিড বেরির স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উপর অত্যাচারের কাহিনী ৷
একটি দৃশ্য কল্পনা করতে চেষ্টা করুন , অসহ্য গরমে কাঠ ফাঁটা রোদ্দুরে বসে একজন বন্দী নারকেল ছাড়াচ্ছেন হাত ফেঁটে রক্তে ভেসে যাচ্ছে , তেষ্টায় চাঁদি ফাটলেও জল চাইলে মিলছে চাবুকের ঘা ৷ রক্ষীধারি শয়তানরা এই রকম ব্যাবহার ই করতেন কালাপানির বিপ্লবী বন্দীদের সাথে । অথবা স্যাতস্যাতে ঘরে একাকিত্বের জ্বালা ও চাবুকের জ্বালা মিলেমিশে অসহ্য হওয়ায় নিরূপায় হয়ে নিজের পরনের জামা গলায় দড়ির ফাঁস হিসাবে ব্যাবহার করছেন কোনো বন্দী । এই ঘটনা খুবই সাধারন ছিল কালাপানির বন্দীদের কাছে ।
সভারকরের লেখনি থেকে আমরা জানতে পারি সেলুলার জেলের গোটা নকশা আর বন্দীদের দিনলিপি ।১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পর স্বদেশি দের দ্বীপান্তরের সাজা বেড়ে যাওয়ার জন্য ১৮৯৩ সালে ঠিক হয় এক বিশালাকৃতি জেল বানানো হবে ৷ আন্দামানে পিনাল কলোনির জেল থেকে বন্দীদের দিয়েই শুরু হল সেই জেল তৈরীর কাজ যার ১৯০৩ সালে চালু হল কুখ্যাত সেলুলার জেল ৷ মাঝের ওয়াচ টাওয়ার কে কেন্দ্র করে মোট সাতটি ভবন আর ৬৯৩ টি কুঠুরি যা লম্বায় সাড়ে ৪ ফুট চওড়ায় ২.৭ফুট নিয়ে এই জেল আর কুঠুরির দেওয়ালের ৩ মিটার উচ্চতায় ছোট একটি কপাট ৷জেলের মাঠের মাঝখানে ডেভিড বেরির নির্দেশে তিনটি দড়ি ঝুলন্ত অবস্থায় ,যেখানে বন্দীদের সামনেই ফাঁসিতে চড়ানো হত । আর আন্দামানের দিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্র পথে পালাতে গেলে মৃত্যুকে বরন করে নিতে হবে ৷
বন্দীদের প্রধান কাজ ছিল নারকেল থেকে দড়ি ও তেল বের করা কিন্তু সেই কাজের কোনো হিসাব ছিল না ৷ বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার ঘোষ প্রায় ১০ বছর সেলুলার জেলে কাটানোর পর নিজের স্মৃতিচারনায় বলেছেন..যাদের দড়ি তৈরীর কাজ দেওয়া হত তাদের পশুর চেয়েও বেশী শ্রম করতে হত ।প্রথমে ২০ টি নারকেল থেকে ছোরড়া ছাড়াতে হত ,তার পর ছোবরা থেকে ছাল বাদ দিয়ে আঁশ বের করে তা হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে নরম করা হত , এর পর জলে চোবানো ও ফের হাতুড়ি পেটা , সব শেষে দড়ি পাকানো ,আর এই গোটা পদ্ধতি অনুসরন করে প্রায় ১০ কেজি দড়ি তৈরী ছিল বাদ্ধতামূলক না পারলেই পিঠে পড়ত চাবুক বা বেতের বাড়ি । অন্যদিকে তেলের ঘানি তেও ১৫ কেজি তেল বার করতে হত গোরুর বদলে বন্দীদের ই , ঘানি টানার ফলে ক্লান্তিতে অজ্ঞান হওয়া ছিল রোজকার ঘটনা ।
পানীয় জল বন্দীদের জন্য বরাদ্দ ছিল অত্যান্ত কম ৷আর খাবার হিসাবে দেওয়া হত খুদ গিয়ে তৈরী অতি সামান্য ভাত অার বুনো ঘাস সিদ্ধ ৷ শৌচালয় বলতে ছিলনিজের কুঠুরিতে রাখা একটি ছোট মাটির পাত্র যা মল মূত্র ধারনের অনুপযোগী ৷সাথে মশার মাছির উপদ্রব বাদ দিলেও চাবুকের ঘায়ে ক্ষতবিক্ষত বন্দীর জন্য থাকত দড়ির জালের পোশাক দেওয়া হত যাতে ঘামে সারা পিঠে জ্বলুনি দ্বিগুন বেড়ে যায় ৷
ঘানি টানা ও নারকেল থেকে তেল ও গড়ি প্রস্তুতির সময় অসহনীয় অত্যাচারের প্রতিবাদ করায় বিপ্লবী উল্লাসকর দও কে পেতে হয়েছিল কঠিন সাজা, চাবুকের ঘায়ে ক্ষত বিক্ষত হওয়ার পর ৩ রাত তাকে হাতে পায়ে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয় ফলস্বরূপ পরে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারান ।
অনেক বন্দী আত্মঘাতী হতেন এই শয়তানের গুহা থেকে মুক্তি পেতে , তাদের লাশ গুলি পাথরের বস্তার সাথে বেঁধে নদীর জলে ফেলে দেওয়া হত ।
বিশেষত ডেভিড বেরি চাইতেন পাশবিক অত্যাচার চালিয়ে কি ভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে নিশ্চিন্হ করে দেওয়া যায় , কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামী রাও পিছিয়ে আসেননি কখনও ৷ ১৯৩২ সাল থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত কালাপানির বন্দীরা অনশন করেন , সুশীল দাশগুপ্ত সহ ৮ জন স্বাধীনতা সংগ্রামী শৌচালয় ও উপযুক্ত খাদ্যের দাবীতে । কিন্তু তার ফলে শাস্তির দাবি বেড়ে গেল , চাবুক ও অন্যান্য অত্যাচার ব্যর্থ হলে সিদ্ধান্ত হল জোড় করে খাওয়ানো হবে, ততদিনে ৮ জনের অনশন গন অনশনের রূপ নিয়েছে ৷ প্রথমে পানীয় জলের বদলে দুধ ঢেলে রেখে দেওয়া হল ও তৃষ্ণায় বুক ফাটলেও কেউ তা মুখে তুললেন না , ফলে সেলুলার জেলে ব্রিটিশ পুলিশের সন্ত্রাস চরম আকার নিল । পিনাল কলোনির ডাক্তার এজ্ এর নির্দেশে রক্ষীরা একে অকে বের করে নিয়ে এল বন্দীদের ,হাত পা বেঁধে নাক দিয়ে রবারের নল ঢুকিয়ে রাত ভর খাওয়ানোর চেষ্টা হল ডিম, দুধ ও চিনি মেশানো তরল মিশ্রণ ,কিন্তু এক ফোঁটাও দেহের ভেতরে প্রবেশ করাবেন না বিপ্লবীরাএই কঠিন পন তাদের ৷ ২ দিনের এই নিদারুন অত্যাচারের চেষ্টাকে বিফল করে বন্দীরা ফিরে অাসেন নিজের কুঠুরিতে মুখে একটাই ধ্বনি …ইনক্লাব জিন্দাবাদ ৷ এই অত্যাচারের কবলে পড়ে ফুসফুসে দুধের মিশ্রণ ঢুকে মারা যান মহাবীর সিং , যিনি ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দও কে লাহোর থেকে পালাতে সাহায্য করেন , একই ভাবে মারা যান বিপ্লবী মোহিত মিত্র ৷
কালাপানির মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে ১৯৩৭ সালে একযোগে প্রতিবাদ করলেন মহাত্মা গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর , সেই প্রতিবাদের ফলস্বরূপ সেলুলার জেল বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয় ব্রিটিশ সরকার ৷ কালাপানি থেকে অবশেষে বন্দী বিপ্লবী ও স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পাঠানো হল ভারতের মূল ভূখন্ডে তাঁদের নিজেদের প্রদেশের জেল গুলিতে ৷ ১৯৩৮ সালের মধ্যেই সেলুলার জেল থেকে সমস্ত বন্দীদের ফিরিয়ে আনা শেষ হয় ৷
সব শেষে ১৯৪৭ সালে জয়ী হল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সেই স্বপ্ন আমাদের স্বাধীন ভারত , তাদের নির্ভীক আত্মবলিদান ও দেশেকে ভালবেসে নিশ্চিত মৃত্যুর হাতে নিজকে আত্মসমর্পণের নামই বুঝি প্রকৃত দেশপ্রেমের উদাহরণ ।ছবি-তুলেছেন রতন সিনহা৷