আনিসুর রহমান বনগাঁ জয়পুরের বাসিন্দা,দিন-রাত্রি পথের শারমেয়দেরকে এভাবেই খাবার দিচ্ছেন তাঁর কথায় যদি প্রাণে বাঁচানো যায়।বনগাঁ বি এস এফ ক্যম্প মোড়ে বৃহস্পতিবার রাতে তোলা ছবি:

পার্থ সারথি নন্দী,দেশের সময়: লকডাউনের তিনদিন। অনেক আশঙ্কা, প্রতিকূলতার আবহ দেশজুড়ে। তারই মধ্যে স্পষ্ট হচ্ছে মানবিক মুখগুলিও।


জীবন তুচ্ছ করে।হাসপাতালে হাসপাতালে চিকিৎসক-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন। পাশাপাশি শুধু নিজেদের নিয়ে ভাবতে শেখা মানুষদের অনেকেই ভাবছেন অন্যভাবে। বেরিয়ে আসছেন খোলস ছেড়ে। লকডাউনের জেরে থমকে গেছে যাঁদের রুটিরুজি-জীবন, তাঁদের পাশে দাঁড়াতে।দোকানপাট বন্ধ, বাইরে লোকজন নেই। তাই ভবঘুরেদের খালি পেটে বাঁচার লড়াই। এই অসময়ে স্থানীয় অসহায় ভিক্ষাজীবীদের জন্য খাবার নিয়ে এগিয়ে এলেন বারাসাত শহরের ‘সমন্বয়’ ক্লাব সদস্যরা। উত্তর ২৪ পরগনার শহরে ঘুরে বেড়ানো ভিক্ষাজীবীদের দু’বেলা করে খাওয়ানোর দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিলেন বারাসাত হরিতলার এই বাসিন্দারা।শুক্রবার থেকে দেগঙ্গা,কদম্বগাছি,হৃদয়পুর সহ বারাসাত এর বিভিন্ন এলাকায় ক্যাম্প করে, নিজেদের বাড়িতেই রান্না করে ,কখনওবা চাল, ডাল, সাবান, তেল পৌঁছে দিচ্ছেন কয়েকশো দু’স্থ মানুষদের কাছে৷ নিজেদের জীবন কে তুচ্ছ করে৷বারাসাত সহ আশেপাশের এলাকায় রয়েছেন বেশকিছু জন্মান্ধ ভিক্ষাজীবী। একশ শতাংশ অন্ধ, চলতে পারেন না কেউ। করোনা ভাইরাস সংক্রমণের জেরে লকডাউন ঘোষণা হতেই একরকম খালি পেটেই ছিলেন তাঁরা।

এঁদের মধ্যেই একজন কাঁদতে কাঁদতে বললেন, জন্মে পৃথিবীটাই দেখার সুযোগ পেলাম না,কিন্তু যখন শুনলাম করোনা এসেছে, এবার মরতে হবে সবাই কে, ঈশ্বর কে জানিয়ে ছিলাম,প্রভু আমাকে তুলে নাও,কিন্তু শুনল না,তাঁর দূত পাঠিয়ে দিল খাবার দিয়ে,ওদেরকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে যারা দু’বেলা আমাদেরকে খাবার দিচ্ছে।এদিন পেটপুরে ভাত খেয়ে দু হাত তুলে আশীর্বাদ করলেন তাঁরা।


সমন্বয়ের সদস্য কুমার বসু, রজত বিশ্বাসরা পেশায় চিত্র সাংবাদিক, তাঁদের কথায়, এখন ক্যামেরা নয় হাতে ক্যামেরার ব্যাগেও কিছু বিস্কুটের প্যাকেট,জল রাখছি প্রতিদিন নিয়ম করেই, কারণ রাস্তায় যেখানে দুস্থ মানুষ চোখে পড়ছে তাকেই দিচ্ছি যতটুকু আমাদের সামর্থ আছে৷এই মানুষদেরকে খাওয়াতে পেরে খুব ভাল লাগছে। যতদিন পারব এ যুদ্ধ চালিয়ে যাব।

অন‍্যদিকে একই যুদ্ধে সামিল হয়েছেন বনগাঁ স্টেশন সাহা পাড়ার এলাকার বাসিন্দা রথীন্দ্র নাথ হালদার,পেশায়এই মানুষটি ব্যাবসায়ী,তাঁর কথায় বনগাঁ হলো ভারতের একটি শেষ রেল জংশন শহর,এখানে বহু ক্ষুধার্ত ভবঘুরেদের যাতায়াত রয়েছে দীর্ঘদিন ধরেই।

লকডাউন এর আগেই সেই সমস্ত মানুষ বনগাঁ শহরের বিভিন্ন প্রান্তে আটকে পড়েছেন৷ তাঁদের জন্য আমার সাথে পূর্বপাড়ার কিছু বন্ধুদেরকে পেয়েছি যাঁরা তাঁদের জীবনের ঝুঁকিনিয়ে এই দুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়াতে সাহায্য করে চলেছেন৷বিশেষ করে পেট্রাপোল স্থল বন্দর এলাকায় প্রচুর সংখ্যক ভিক্ষাজীবী মানুষ রয়েছেন কিন্তু এখন ওই ভিক্ষা পাওয়ার পথ বন্ধ।

তাই তাঁদের জন্য পাঁচ কেজি করে চাল, ডাল, তেল, লবণ সহ কিছু নগদ টাকা প্যাকেট করে সাইকেলে ঘুরে ঘুরে তাঁদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে৷ আসলে এই মানুষ গুলোকে প্রতি সপ্তাহের শনি,মঙ্গল বার রাস্তায় দেখা যেত প্রায় সকলেরই মুখ চেনা এই মানুষ গুলো তাই খুঁজে পেতে সুবিধা হচ্ছে৷

কেন করছেন এমন কাজ ,রথীন বাবুকে প্রশ্ন? তাঁর সোজা সাফটা উত্তর দেশের প্রধান মন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন নবরাত্রীতে অন্তত ন’টি পরিবারের দায়িত্ব নিতে,তাঁর কথা সংবাদ মাধ্যমে শুনেই এই পরিকল্পনা আমাদের।

“একদিন খেয়ে তো মানুষ বাঁচতে পারে না। তাই যতদিন লকডাউন না উঠছে ততদিন দু’বেলা করে খাওয়াবো।”সারাদিন প্লাস্টিকের বোতল অথবা ফেলে দেওয়া জিনিসপত্র কুড়িয়ে সেগুলো বিক্রি করে যেটুকু আয় হয় সেই দিয়ে চলে বনগাঁ জয়পুরের বাসিন্দা খালেক মন্ডলের। কিন্তু লকডাউনের জেরে তাও বন্ধ। ফলে কার্যত অনাহারে কাটছে দিন। বৃহস্পতিবার সারাদিনের পরে রাতেও খাবার না খেয়েই কাটবে বলে ভেবেছিলেন। হঠাৎ হাজির চার পাঁচজন ছেলেমেয়ে। দেবদূতের মতো। তারা এসে দিয়ে গেল ভাত-সবজি-ডাল। অন্তত একটা রাত না খেয়ে শুতে হলো না খালেকের।
শহরের অলিগলিতে যেখানেই ভবঘুরেদের দেখা পাচ্ছেন, তাদেরকে সাহায্য করছে রথীনরা। লক্ষ্য একটাই, করোনা আতঙ্কে গৃহবন্দী মানুষ। এবং সে কারণে রাস্তায় যাঁরা পড়ে থাকেন তাঁরা যেন অভুক্ত না থাকেন।রথীনদের কথায়, ‘‘লকডাউনের ফলে ভবঘুরেদের খাবারের সোর্সটাই তো বন্ধ। কীভাবে পেট চলবে ওঁদের? তাই ওরাপথে নেমেছে। যদি কয়েকজনের অন্তত পেট ভরানোর ব্যবস্থা করা যায়।’’

বনগাঁর পূর্বপাড়ার বাসিন্দা তপন চক্রবর্তী পেশায় টেলর্স,তাঁর পরিবারের সদস্যদের সাহায্য নিয়ে নিজেই পাঁচ হাজার মাস্ক বানিয়ে ফেললেন বাড়িতেই,সেই সমস্ত মাস্ক নিয়ে বাইক চেপে শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটেবিনা মূল্যে বিলি করছেন মুদির দোকানদার থেকে শুরু করে বনগাঁ মহকুমা শাসক সহ বিডিন্ন সরকারি অফিস কর্মচারী এবং পথ চলতি মানুষের মধ্যে।

ছবি- পার্থ সারথি নন্দী।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here