পার্থ সারথি নন্দী:
করোনা পরিস্থিতিতে এবার শহর এবং সীমান্ত অঞ্চল গুলিতে উচ্চতা কমছে বিশ্বকর্মা মূর্তির। কারখানার মালিক, শ্রমিক সকলেই ছোটো ছোটো মূর্তি বানানোর বরাত দিয়েছেন মৃৎশিল্পীদের কাছে। লাভের মুখ দেখা তো দূর, বিশ্বকর্মা পুজোর আগে বড় রকমের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে অসহায় মৃৎশিল্পীদের পরিবার।
হাওড়া অঞ্চল সুপ্রসিদ্ধ শিল্পতালুক। শিল্পাঞ্চলে জাতীয় সড়কের ধারে কয়েক হাজার কারখানায় দুর্গাপুজোর আগে প্রতিবছর ঘটা করে বিশ্বকর্মা পুজো হয়। পুজো তো উপলক্ষ্য মাত্র, মন্ডপ এবং প্রতিমার আকার নিয়ে প্রতিযোগিতাই ছিল এই অঞ্চলের বিশ্বকর্মা পুজোর প্রধান আকর্ষণ। কোন কারখানা কত বড় মণ্ডপ আর কত দীর্ঘ বিশ্বকর্মা ঠাকুর নিয়ে আসতে পারে, তাই নিয়ে কারখানাগুলোর একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা চলত। গত বছর অব্দি এই নিয়ম মেনেই পুজোর আনন্দে মেতেছিল এই শিল্পাঞ্চল ।কিন্তু এবছর উলোটপুরাণ সবেতেই। করোনা আবহে আরও অনেক কিছুর মতো এবছর একেবারে বদলে গেছে এলাকার বিশ্বকর্মা পুজোর ছবিটাও।
হাওড়ার এক লোহার পাইপ কারখানার মালিক ধীরাজ সাউ এপ্রসঙ্গে বলেন এই বছর লকডাউনের জন্য বেসরকারি কারখানাগুলি টানা বেশ কিছু দিন বন্ধ ছিল। মালিক এবং শ্রমিকদের আর্থিক অবস্থাও ভালো নয় এ বছর। কোনওরকমে নমো নমো করে পুজো সারার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছে কারখানার কর্তৃপক্ষও এবং শ্রমিক সংগঠন । মণ্ডপ, ঠাকুর ও অন্যান্য খরচ যত দূর সম্ভব কম করা হচ্ছে। এ বছর বিশ্বকর্মা পুজোয় হবে না কোনও প্রতিযোগিতাও।
উলুবেড়িয়া যদুরবেড়িয়া এলাকায় প্রচুর মৃৎশিল্পীর বাস৷ পুজোর মরশুমে একের পর এক বিশালায়তন মূর্তি তৈরি করেন, তেমনই একজন মৃৎশিল্পী নারায়ণ পাল জানান “গত বছর ছ থেকে আট ফুট উচ্চতার বিশ্বকর্মা করেছিলাম। হাওড়ার বিভিন্ন এলাকার কারখানা থেকেই সেই সব বিশ্বকর্মার বরাত এসেছিল। এক একটি মূর্তির দাম ছিল কমবেশি দশ হাজার টাকা। এবছর সেই সব কারখানা থেকেই বরাত এসেছে ছোটো ঠাকুরের। যার দাম বারশো টাকা। গত বছর ছোট বড় মিলে বিশ্বকর্মা তৈরি করে ছিলাম প্রায় একশো মত। সব বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। এই বছর মাত্র দশটি পাচঁ ফুট উচ্চতার বিশ্বকর্মা তৈরি করেছি। সেগুলো এখনও পর্যন্ত কোন বায়না পর্যন্ত হয়নি ,বিক্রি হবে কিনা তাও বুঝতে পারছি না”।
সামনে পুজো, তার আগে বড়রকমের আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা সব এলাকার কুমোরদের মধ্যে হতাশার জন্ম দিচ্ছে। সে ছবি আরও স্পষ্ট হল বনগাঁ শিমুলতলা পটুয়াপাড়ার মৃৎশিল্পী স্বপন ভট্টাচার্য্যও প্রদীপ ভট্টাচার্য্যদের সঙ্গে কথা বলে। দেশের সময় কে এই দুজনে প্রায় একই কথা বলেন। তাদের কথায়, “আমপান ঝড়ে এমনিতেই এলাকায় অনেক ক্ষতি হয়েছে । অনেক তৈরি করা ঠাকুর নষ্ট হয়ে গেছে।
তারপর প্রায় ছমাস ধরে চলল লকডাউন। লকডাউনের জন্য কারখানা থেকে এই বছর কোনও বড় ঠাকুরের বরাত পাইনি।ছোটো ঠাকুর বানালে কম দামে বিক্রি হয়। এবছর সেই বিক্রির সম্ভাবনাও অনেক কম। সব মিলিয়ে পুজোর মরশুমে কত আর লাভ করবো! সংসার চালানোই দায় হয়ে যাচ্ছে।” ঠাকুর গড়ার শ্রমিকদের কে এবার কাজে নিতে পারিনি, অনেক শ্রমিক এবছর ঠাকুর গড়ার কাজ ছেড়ে কেউ ভ্যান রিক্স চালাচ্ছেন, কেউ আবার সবজি বিক্রি করে দিন কাটাচ্ছেন৷ আমপানে অনেকের ঘর ভেঙেছিল,তাঁদের মাথার উপর চালটুকুও জোটেনি।ক্ষতিপূরণের টাকা এখন তাঁদের কাছে শুধু স্বপ্ন।
করোনা আবহে সবথেকে বেশি ক্ষতির মুখে পরেছে ছোটো ও মাঝারি শিল্পাঞ্চলগুলি। লকডাউনে এমনিই টাকা বেশ কয়েকমাস কাজ নেই৷ তার উপর ক্ষতির ধাক্কা সামলাতে পুজোর বিপুল বাজেটে কাটছাঁট করেছেন প্রায় প্রতিটি কারখানা কর্তৃপক্ষ। তিথি মেনে ১৭ ই সেপ্টেম্বর বিশ্বকর্মা পুজো। তার আগে বিরাট আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন এলাকার মৃৎশিল্পীরা। নুন আনতে পান্তা ফুরোচ্ছে তাদের। মন ভালো নেই শ্রমিকদেরও৷ সব মিলিয়ে বিশ্বকর্মা পুজোকে কেন্দ্র করে এইসব এলাকার চেনা জৌলুসে এবছর গ্রহণের ছায়া। ক্ষতি কাটিয়ে কবে আবার চেনা ছন্দে ফেরে হাওড়ার শিল্পাঞ্চল থেকে বনগাঁ সীমান্ত এলাকা, সেটাই দেখার।