মলয় গোস্বামী:

জানলার ফাঁসা দিয়ে একফালি ভোরের আলো ঢুকেছে । যেন ওই আলো আমাকে হালকা ভাবে নাড়া দিয়ে বলল, ওঠ । সকাল হয়েছে ।  আমি আড়ামোড়া ছেড়ে বললাম, এত সকালে ডেকে দিলে ? কত রাত করে যে শুয়েছি তা তোমাকে কী বলব !    উঠে পড়লাম । মনে হচ্ছে খুব শান্ত । নানা রকমের পাখির ডাক শুনতে পাচ্ছি । দরজা খুলে দিতেই অবাক হয়ে গেলাম । দেখছি, বারান্দায় কয়েকটি কাশফুল মেঝেতে শুয়ে আছে ! আশ্চর্য! কে রেখে গেল ! আর এখন তো বৈশাখ মাস ! এখন কি কাশফুল ফোটে ? সে তো আশ্বিনে !    চারদিকে তাকিয়ে কাউকেই দেখতে পাচ্ছি না । কিন্তু আমি বেশ বুঝতে পারলাম যে , কেউ রেখেছে অবশ্যই ।     হঠাৎ আমাদের ছায়ামাখা আমগাছ তলায় তাকিয়ে চমকে উঠলাম ! অরুণিমা দাঁড়িয়ে আছে । মুখে মুচকি হাসি । দুটো ভুরু নাচিয়ে বলল, কী ব্যাপার ?     সে তো আমার জিগ্যেস করার কথা । তুমি _এত_ সকালে ! আর ওই কাশফুল তুমিই রেখেছ ওখানে ?     হ্যাঁ তো ।    কেন ?     সে বলব’খন । চোখ মুখে জল দিয়ে , পাঞ্জাবি পায়জামা চাপিয়ে চলো , বের হবো ।    আরে ! পাগল মেয়ে তো তুমি ! আর কাশফুল পেলে কোত্থেকে ? এখন কি কাশফুল ফোটে ?     শোনো , অত কথা বলার সময় নেই । তাড়াতাড়ি করো । হারি আপ । অরুণিমা এরকমই । উঠল বাই তো কটক যাই ।     এতক্ষণ যেন কথা বলছিলাম একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে । কাশফুল… অরুণিমা… ভোর … এই সব যেন এক অন্য পৃথিবীতে নিয়ে ফেলেছিল আমাকে । এবার দেখি আরো বিস্ময় আমাকে চমকে দিল ।   ও কী ! অরুণিমা কী পরেছে ! ছোটবেলার মতন গাউন ফ্রক , চুলে দু’বিনুনি । হেসেই চলেছে । ওর হাতেও দেখি কয়েকটি কাশফুল ।     এ কী অরুণিমা ! তুমি এমন ড্রেসে ! চুল বেঁধেছ ওইভাবে !  আর কাশফুল পেলে কোত্থেকে ?     অত কথা বলার সময় নেই । খুঁজতে জানলে সবকিছু পাওয়া যায় । এখন এরকম সাজতে মন হয়েছে । চলো আজ বিশেষ দিন আমাদের ।       তার মানে ?        চলো তো । এরপর ও রেগে যাবেই । ওকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি ।অতএব তৈরি হয়ে ,. কাশফুল ঘরে খাটের ওপর রেখে . মাকে বলে অরুনিমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ।      কোথায় যাব আমরা ?     যাব কাশফুলের দেশে ।     সে কি এখন আছে ?      সবই আছে । আমরাই তো ধ্বংস করে দিচ্ছি । চলো অনেক দূরে কোথাও ।     আমি যেন আমার অরুণিমাকে আজ চিনতে পারছিনা । ও গেয়ে উঠল —- দূরে কোথায় দূরে দূরে … আমার মন বেড়ায় ঘুরে ঘুরে ….      গানের মধ্যে ডুবে গিয়েছিলাম আমি । বুঝতেই পারিনি কোথায় , কতদূর চলে এলাম ।      দেখি —- বিশাল একটা মাঠ …. ধানক্ষেত … দূরে নিজে নিজে জন্মনেওয়া পুকুর , বেশ কিছু কাশফুল তাদের শাদা মাথা নাড়াচ্ছে । যেন ওরা আমাদের অভিবাদন জানিয়ে বলছে , এসেছ ? খুউব ভালো হয়েছে , এসো এসো ।      পেছন ফিরে তাকাতে দেখি অরুণিমা হাততালি দিতে দিতে দৌড়ে আসছে আমার কাছে । ওর ফ্রক দুলছে । দুলছে বেণী ।     এসে আমার একটা হাত ধরে বলল , দৌড়াও দৌড়াও … উইই দ্যাখো রেল লাইন । আমাকে ট্রেন দ্যাখাও ।   আমি কেমন হয়ে পড়লাম ! অরুণিমা কি অন্য কোথাও চলে গিয়েছে ? ও কি একটা উপন্যাসের চরিত্র হয়ে যাচ্ছে !     আমি ওকে কাছে টেনে নিয়ে বললাম , শোনো শোনো , কী দেখতে চাও তুমি ?    ও বলল , আমি রেলগাড়ি দেখতে চাই । আমি সবুজ চাই । আমি চাই সরল পৃথিবী । সেখানে তুমি আমাকে নিয়ে যাবে মলয় ?     আমি একটা হাত ধরে নিয়ে চুপ করে ওকে দেখতে থাকি ।   হঠাৎ ট্রেনের হুইসেল … । ও হাততালি দিয়ে উঠলো ।     শোনো শোনো রেলগাড়ি আসছে । চলো । দৌড়ে চলো ।  সে সময় আমাদের অনেক দূরে রেখে ইলেকট্রিক ট্রেন ভীমবেগে চলে গেল চারদিক কাঁপিয়ে ।    কাশফুল মাথা নাড়ালো ।    ফ্রকপরা অরুণিমা আমার হাত ধরে ট্রেনলাইনের ওইপারের ঘন গাছপালার ওপরের আকাশের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ওখানে কী দেখতে পাচ্ছ ?     কেন ? নানা রকম মেঘ !,      মেঘের মধ্যে কাউকে দেখতে পাচ্ছ ?        হ্যাঁ পাচ্ছি , অনেক বড় একজন মানুষের ছবি ।         ঠিক বলেছ । উনি সত্যজিৎ রায় । নমস্কার করো ।আমরা দুজনেই মেঘের দিকে তাকিয়ে হাতজোড় করে প্রণাম করলাম । #########    এই ওঠ্ ওঠ্ … আর কত ঘুমিয়ে থাকবি ? বেলা অনেক হয়ে গেছে ।     মা আমাকে ধাক্কা দিয়ে তুলে দিল, ওই দ্যাখ অরুণিমা এসেছে । কতক্ষণ হয়ে গেল !       আমি তখন একভাবে মা-র মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here