দেশের সময়,ঠাকুরনগর: তৃণমূল সুপ্রিমো মতুয়া-গড় বনগাঁর গোপালনগরে দাঁড়িয়ে বার্তা দিয়েছেন ঠাকুডর বাড়িতে ভাঙনের জন্য দায়ী বিজেপি। অভয়বাণী দিয়েছেন, মতুয়া হোন বা অন্য কোনও গোষ্ঠী, এ রাজ্যে থাকতে কোনও শংসাপত্র লাগবে না। রাজনৈতিক মহল যখন বলছে মতুয়া ভোট টানতে মোক্ষম চাল দিয়েছে শাসক দল, তখনই মতুয়া-গড়ে অস্তিত্বরক্ষায় সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপাচ্ছে বিজেপি। স্বয়ং অমিত শাহ ১৯ ডিসেম্বর সভা করবেন বনগাঁয়। তার আগে শনিবার সোজা ঠাকুরবাড়িতে হাজির হলেন কৈলাস বিজয়বর্গীয়।
এদিনের বৈঠকে ঠাকুর পরিবারের তরফে হাজির ছিলেন শান্তনু ঠাকুর, সুব্রত ঠাকুর, মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুররা। কেন এই বৈঠক? কৈলাস বিজয়বর্গীয় বলছেন, শিষ্টাচারই এই বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু বাতাসে ভাসছে অন্য কথা।
দিন কয়েক আগেই মতুয়া মহাসমাজের নাগরিকত্ব পাওয়ার বিলম্ব নিয়ে নিয়ে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় মুখ খুলেছিলেন শান্তনু ঠাকুর।
বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্র মানেই মতুয়া ভোট। বরাবর তৃণমূলের সঙ্গে থাকা মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষেরা গত লোকসভা নির্বাচনে দু’হাত উপুড় করে ভোট দিয়েছিলেন বিজেপি-কে। তাঁদের ভোটে জিতেই সংসদে যান ঠাকুর পরিবারের সদস্য শান্তনু। কিন্তু সম্প্রতি নাগরিকত্ব আইন সিএএ,প্রয়োগে বিলম্ব নিয়ে প্রকাশ্যেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। রাস উৎসবের সময়ে উত্তর ২৪ পরগনার গাইঘাটার ঠাকুরনগরে সারা ভারত মতুয়া মহাসঙ্ঘের নতুন কমিটি গঠন উপলক্ষে আয়োজিত সভায় নাগরিকত্ব আইন প্রয়োগ নিয়ে মতুয়া সমাজের ‘হতাশা’ প্রকাশ করেন শান্তনু। এমনও বলেন যে, ‘‘নাগরিকত্বের জন্য কেন বার বার আমাদের ভিক্ষা চাইতে হচ্ছে? কেন বার বার আন্দোলন করতে হচ্ছে? কংগ্রেস, সিপিএম, তৃণমূল, বিজেপি— সকলের কাছে আমরা ভিক্ষা চেয়েছি। অধিকার কেউ দেবে না। অধিকার আদায় করে নিতে হবে।’’
দূর থেকে দেখলে সেই ক্ষোভ প্রশমন এবং ঐক্যের বার্তা দেওয়া কৈলাস বিজয়বর্গীয়র আজকের যাত্রার উদ্দেশ্য বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক মহল। কিন্তু সূত্রের খবর, অতি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা নিয়েই আজ কৈলাস বিজয়বর্গীয়র ঠাকুরবাড়ি যাওয়া।
শোনা যাচ্ছে মন্ত্রীসভায় দ্রুত বড়রদবদল ঘটতে চলেছে। সাংসদদের অনেককেই নানা নতুন দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে। সেক্ষেত্রে মোদী সরকারের তালিকায় রয়েছে শান্তনু ঠাকুরের নাম। যদিও কোন দায়িত্ব হতে পারে তাঁর? পূর্ণমন্ত্রী না প্রতিমন্ত্রী হবেন তিনি, তা নিয়ে কিছুই জানা যায়নি। তবে দ্রুতই এই বিষয়ে জানানো হবে বলে সূত্রের খবর। আর সে কথাই নাকি কৈলাস বিজয়বর্গীয় কানে তুলে দিয়েছেন শান্তনু-সহ বৈঠকে উপস্থিত অন্যান্যদের। শান্তনু কি শেষপর্যন্ত বিজেপির টোপ গিলবেন? নাকি এই সুযোগে মতুয়া, রাজবংশীয় টিকিট নিয়ে দরকষাকষিটাও সেরে নেবেন, সেটাই দেখার।
আরও একটা প্রশ্নও থাকছে, শান্তনুকে তুষ্ট করে চিড়ে ভিজবে? কৈলাস বিজয়বর্গীয়র দাবি, মতুয়ারা বিজেপির থেকে যা পেয়েছে, তাঁরা অন্য কোনও ছাতার তলায় যাবেন না।মতুয়াদের একটি সূত্রের খবর,এর পর সাংসদ শান্তনু কোন বিষয়ে আর প্রকাশ্যে কিছু বলবেন না। কারণ, মতুয়া সমাজের দাবি যে পূরণ করা হবে, সেই মর্মে তাঁকে আশ্বাস এবং প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছেন কৈলাস।
বিজেপি সূত্রে খবর, শান্তনু ও কৈলাসের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ কথা হয়। মতুয়াপ্রধান এলাকাগুলিতে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে কাদের প্রার্থী করা যেতে পারে, তা নিয়ে শান্তনুর দাবিদাওয়াও শোনেন কৈলাস। বিজেপি সূত্রে আরও জানা গিয়েছে, ওই বৈঠকে জানুয়ারি থেকেই নাগরিকত্ব আইন প্রয়োগ শুরু করার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে রাজ্য সফরে এসে অমিত শাহও কিছু বলতে পারেন বলে আলোচনা হয়েছে।
গোপালনগরে মমতার সভা থেকে মতুয়াদের খুশি হওয়ার মতো অসংখ্য ঘোষণার পরেও শান্তনুর বক্তব্য অস্বস্তির কারণ হয় বিজেপি-র। বনগাঁর সভা থেকে মমতা মতুয়া সম্প্রদায়ের গুরু হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মদিন মধুকৃষ্ণ ত্রয়োদশী তিথিকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করেন। সেই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে শান্তনু প্রকাশ্যেই বলেন, ‘‘হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মতিথিতে ছুটি ঘোষণা একটি ভাল পদক্ষেপ।’’
শান্তনুর ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল মূলত রাজ্য বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষের একটি মন্তব্য ঘিরে। গোপালনগরে বিজেপির এক সভায় দিলীপ জানিয়েছিলেন, এক বছরের মধ্যে হিন্দু উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। তারই প্রেক্ষিতে শান্তুনু পরে বলেন, ‘‘ এক বিশেষ নেতার কাছে শুনলাম, এক বছর পরে নাকি সোসাইটিতে নাগরিক আইন চালু হবে। এত দেরি হলে আমাদের আর তার দরকার নেই। পরবর্তীকালে এমনিই আমরা নাগরিকত্ব পাব।’’ একই সঙ্গে শান্তনু জানান, আগামিদিনে মতুয়া সমাজ কোনও সিদ্ধান্ত নিলে তিনি তার সঙ্গেই থাকবেন। মতুয়াদের সিদ্ধান্ত ছেড়ে রাজনীতির কথা ভাববেন না।
শান্তনুর ক্ষোভপ্রকাশের পরে তা নিয়ে রাজনীতিতে নামে তৃণমূলও। গত ১০ ডিসেম্বর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বনগাঁয়া জনসভা করেন। তার আগেই তৃণমূলের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সভাপতি তথা রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক শান্তনুকে তৃণমূলের মঞ্চে আসার আহ্বান জানান। জ্যোতিপ্রিয় বলেন, ‘‘শান্তনু যদি মতুয়াদের জন্য কাজ করতে চান, তা হলে হাত মেলাতে আমাদের কোনও ক্ষতি নেই। তবে আমাদের প্ল্যাটফর্মে এসে ওঁকে কাজ করতে হবে। বিজেপির প্ল্যাটফর্মে থেকে নয়।’’
এর পরই নড়েচড়ে বসে গেরুয়া শিবির, শান্তনুর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েদেন,তারই রেশধরে শনিবার শান্তনুর মানভঞ্জনে কৈলাস বিজয়বর্গীয়র ঠাকুরনগর মতুয়াবাড়ীর এই সাক্ষাত বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক মহল।