সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত হয়েও জীবন যুদ্ধে সফল বর্ধমানের মেয়ে দেবস্মিতা

0
1280

শ্রাবণী হালদার : আজও কোন প্রতিবন্ধকতা আটকাতে পারেনি পশ্চিম বর্ধমান জেলার দুর্গাপুরের দেবস্মিতা নাথকে। ছোটবেলা থেকেই সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত হওয়ার কারণে নানান বাধা তাঁর সামনে এসেছে। এমনকি তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলিতে রয়েছে দুর্বিষহ স্কুল জীবনের ঘটনা। যার কারণে স্কুলের কথা খুব একটা তিনি মনে করতে চান না। কিন্তু বর্তমানে দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও আজ তাঁর জয়জয়কার ৷

দেবস্মিতা বর্তমানে ইংলিশ অনার্স নিয়ে পড়াশোনা করছেন। পাশাপাশি আবৃতি জগতে নিজেকে এতটাই ব্যস্ত রাখেন, তাঁর মাঝে ছোটবেলার মুহূর্তগুলি খুব একটা মনে পড়ে না। স্কুল জীবনে কখনো বা চুরির অপবাদ, কখনো বা ঠান্ডায় মাটিতে বসিয়ে রাখা , আবার কখনো বা টিফিন খেতে না দেওয়া । এই সমস্ত তিক্ত অভিজ্ঞতা গুলিকে তিনি আজ কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন। আর তাঁর জীবনের পাশে শক্ত লাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছেন মা সুমিতা নাথ।

দেবস্মিতা নাথ সেলিব্রাল পালসি নামক রোগে আক্রান্ত। মস্তিষ্কে ব্রেনের বিকাশ খুব দেরি করে ঘটে। কোনোদিন পুরোপুরি সুস্থ হয় না তাই আর পাঁচজন বাচ্চার মত দেবস্মিতা কিন্তু বড় হয়ে ওঠেনি। কিন্তু বাবা-মার অক্লান্ত পরিশ্রমে শেষ পর্যন্ত তিন বছর বয়সে কথা বলতে শেখা দেবস্মিতার।

সাড়ে চার বছর বয়সে দেবস্মিতার কবিতা জগতে প্রথম পুরস্কার প্রাপ্তি “রুমির ইচ্ছা” কবিতা বলার মাধ্যমে। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি এই একরত্তি মেয়েকে। তারপর থেকেই শুরু হয় বিভিন্ন আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা।তার পাশাপাশি বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে ও বেতার শিল্পী হিসেবে কাজ করা শুরু হয়।
এছাড়া রবীন্দ্র ,নজরুল, সুকান্ত ইত্যাদি কবি সাহিত্যিকদের জন্মদিনে তাদের কবিতা আবৃতি পাঠ লেগেই থাকতো। তবে অনুষ্ঠানগুলি দেবস্মিতা বরাবর বসেই করে।

যাইহোক জীবনে সব প্রতিকূলতাকে জয় করে কবিতা জীবন এগিয়ে চলেছে দেবস্মিতা ৷ মাত্র আট বছর বয়সে রাজ্য কবিতা প্রতিযোগিতা তে প্রথম স্থান অর্জন করে। মাত্র ১৩ বছর বয়সে ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছাত্রী হওয়ার সুবাদে জীবনে একটা বড় পরিবর্তণ এলো। গুরুসূত্র ধরেই জগন্নাথ ও উর্মি মালা বসু, প্রদীপ ঘোষ প্রমুখ ও ব্যক্তি বর্গের কাছে আবৃত্তি অনুশীলনে সুযোগ পায়। ১৪ বছর বয়সে এটি টিভি চ্যানেলে দেবস্মিতার অটোবায়োগ্রাফি বার করে যেটির নাম ছিল “shining star” । বিভিন্ন জেলা থেকে অনুষ্ঠানের জন্য ডাক আসতে শুরু হয়।
১৩ থেকে ১৪ বছর বয়স থেকে বিভিন্ন নামেই দামি কোম্পানির এড এ ভয়েজ দেবার কাজ শুরু করে সে। এসব কিছুর মাধ্যমে যে অর্থ দেবস্মিতা উপার্জন করে করেছে সেগুলি করণাকালীন সময়ে বাবার হাতে তুলে দেয় দুস্থ মানুষের সাহায্যের জন্য।

বয়স তখন মাত্র ১৩ সারা বাংলা আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করে দেবস্মিতা। ১৭ বছর বয়সে প্রথম সিডি “প্রণামী” প্রকাশিত হয়। কুড়ি বছরের শুরুতে দ্বিতীয় সিটি “শ্রদ্ধার্ঘ্য” প্রকাশিত হয় একই জায়গা থেকে। কলকাতায় প্রথম দেবস্মিতার অনুষ্ঠান শুরু হয় সুজাতা সদনের মাধ্যমে। সেখান থেকে এই নির্বাচিত হয় জাতীয় পুরস্কারের জন্য এবং জাতীয় পুরস্কারও যুক্ত হয় তার মুকুটের শীর্ষ পালক হিসেবে।

প্রথম সিডি রিলিজের পর বাংলার প্রাক্তন রাজ্যপাল কেশরী নাথ ত্রিপাঠী দেবস্মিতার সাথে সাক্ষাতের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সাক্ষাতে সিডিটির রিলিজ হয় উনার হাত ধরে। প্রথম সিডি এত জনপ্রিয়তা পাই যে,ডাক আসতে থাকে বাংলাদেশ থেকে। বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মে আবৃতির জন্যও ডাক আসেতাঁর৷ সোশ্যাল প্লাটফর্মে কবিতা শোনার পর করোনা কালে মোট ৪৫০টি লাইভ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। তার মধ্যে বেশ কতগুলি আন্তর্জাতিক মানের। বাংলাদেশ ,ইতালি, দুবাই আমেরিকা ,প্রভৃতি দেশ থেকে অনলাইন ইন্টারভিউ নেয়া হয় দেবস্মিতা।

মাত্র কুড়ি বছর বয়সে দেবস্মিতা ভূষিত হয় অগণিত সম্মানে মনন সাহিত্য পত্রিকা, সিন্ধুরা একাডেমি অফ কালচার, নতুন দিশারী, বিভিন্ন জেলার ডিজিটাল মিডিয়া,কলকাতার নিউজ মিডিয়া সহ সেভ হিউম্যান রাইটস ,কাজী নজরুল ইসলাম ,উসাশ্রী কালচার একাডেমী থেকে উষা শ্রী সম্মান, জীবনানন্দ দাশ স্মৃতি সম্মান,কলকাতা বইমেলাতে শঙ্খ ঘোষ মঞ্চ থেকে শঙ্খ ঘোষ স্মৃতি সম্মান, শরৎ স্মৃতি সম্মান,শ্যামল স্মৃতি সম্মান, কবি ঈশ্বর গুপ্ত স্মৃতি সন্মান , গীতাঞ্জলি সম্মান বি আর আম্বেদকর সম্মান, বিশ্ববাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি সম্মান, বিশ্ববাংলা নারী সম্মান, বাংলার গর্ব সম্মান, বকখালি সাহিত্য উৎসব থেকে কবি শামসুল হক স্মৃতি সম্মান, আসামের কৃষ্ঠি সম্মান, আসামের বঙ্গ মৈত্রী সন্মান, সহ আন্তর্জাতিক সম্মানও তার ঝুলিতে কিছু কম নয়, আন্তর্জাতিক সাহিত্য সন্মান, ভারত ও বাংলাদেশ মৈত্রী সম্মান, নেপাল ও ভারত দলিত মৈত্রী আন্তর্জাতিক সম্মান ,আন্তর্জাতিক বাংলা সাহিত্য সম্মান রয়েছে তাঁর ঝুলিতে ৷

বর্তমানে দেবস্মিতা IGNU তে ইংরেজি স্নাতক বিষয়ের ছাত্রী। এখন দেবস্মিতার আবৃত্তি নেশা থেকে পেশায় পরিণত হয়েছে। তবে এখন দেবস্মিতা খুব ব্যাস্ত, নিজের পড়াশোনা, আবৃতি অনুষ্ঠান অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে। তবু সপ্তাহে একদিন অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া কিছু বাচ্চাকে পড়াশোনা ও আবৃতি কবিতা আবৃত্তি শেখায়।

এমন প্রতিকূলতার মধ্যে দেবস্মিতা যেভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করিয়েছে তা সমাজের কাছে একটি দৃষ্টান্ত৷ আগামী দিনের পরবর্তী প্রজন্ম অনুপ্রাণিত হবে দেবস্মিতার জীবন কাহিনীর মধ্য দিয়ে।

Previous articleHelth tips: বদলাবে মুখের স্বাদ, রোগবালাই থেকে দূরে রাখবে টার্কির মাংস
Next articleRaksha Bandhan : এবছর নয়া চমক! মুখ্যমন্ত্রীর ডিজাইন করা ‘জয় বাংলা’ রাখি বাঁধা হবে বাংলার ভাইদের হাতে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here