শরৎকাল মানেই পুজোর মাস| অন্য কোনো কিছুতে তখন আর মন বসে না| মন ছুটে যায় অনাবিল আনন্দের দিগন্তে। বাঙালির কাছে পুজোর সময় টা ছুটি, খাওয়া দাওয়া ,শপিং আর পুজোর দিন গুলোতে প্যান্ডেল এ এসে সীমাবদ্ধ | পুজো নিয়ে সেই ছোটোবেলার মতো উৎসাহ বা সেই বাধ ভাঙ্গা উচ্ছাস টা এখন কার ছোটদের মধ্যেও ততটা প্রতিফলিত নয়| তারা জানে যে পুজো মানে দামি পোশাকের হাতছানি| মা বাবার হাত ধরে শপিং মল এ ঘুরে বেড়ানো| আর যারা teen age তারা জোট বেঁধে সেলফি বা বিভিন্ন রেস্তোরা, বা দামী হোটেলে গিয়ে একটি পদের ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করা| তাহলে কি কোথাও হারিয়ে গেল বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দূ্র্গা পূজার প্রাসঙ্গীকতা ..?
এই প্রশ্ন টাতেই অনেকে আপত্তি তুলতে পারেন| পুজো তো এখন আরো জাকজমক ভাবে পালিত হয়| তবে কেন হঠাৎ নেতিবাচক পরিস্থিতির মধ্যে জড়িয়ে পড়া? কথাটি ঠিক যে অতি রঞ্জিত সব কিছুকেই আমরা মানিয়ে নিতে পারি ,এটি ভাল অভ্যাস| কিন্তু মায়ের আগমন বা প্রত্যাবর্তনের একটি আলাদা পদচিহ্ন আছে সেটা কতটা অনুভব করা যায়| সবাই আজকাল এতো ব্যস্ত যে এসব ভাবার জন্য কোনো সময় নেই| শহরের পুজোতে ফের অার একবার অকালবোধন করা হচ্ছে আজকাল…. যারা বুঝলেন না তাদের জন্য বলি মহালয়া তে মায়ের চক্ষুদান হয় কিন্তু মন্ডপে ঠাকুর বসিয়ে ঠাকুরের সামনে ভিড় তৈরী করাটা কোন নিয়মে পড়ে তা জানি না| এটা একরকম অকাল বোধন ই বটে|
খুব মনে পড়ে ছোটবেলায় হঠাৎ একদিন ভোরে উঠলে দেখা যেত উঠোন বিছিয়ে ছড়িয়ে আছে শিউলি ফুল| আর মনের গভীর অতল থেকে কেউ যেন জানিয়ে যেত…ও..আয় রে ছুটে আয় পুজোর গন্ধ এসেছে..
পাশের মাঠে প্যন্ডেল বাধার জন্য যে বাঁশ বাধা হোত তাতে পাড়ার কচিকাচারা ঝুলোঝুলি করত| আর বাবা মায়ের সামর্থ কম থাকলে ও ছাপোষা নতুন জামা থেকে যে গন্ধ টা লেগে থাকত তাতে দামী ব্র্যন্ডের ছাপ না থাকলেও পুজোর জামার তকমা টা লেগে যেত| পাড়ায় বড়জোড় একটা কি দুটো পুজো তাও দশমী তে বিসর্জন… এখন তো দ্বাদশী আর রবিবারে মা কে বিসর্জন দেওয়াটা রীতি হয়ে গেছে.
আর কুমোরের বাড়ী তে রোজ ঠাকুরের একটু একটু করে সেজে ওঠা দেখতে যাওয়ার মধ্যে যে আনন্দ টা ছিল তা কি আর ফিরে আসে?
একটু বড় হওয়ার সাথে সাথে পুজোয় বেরোনো প্রেমের গানের ক্যাসেট যখন নচিকেতা ,শ্রীকান্ত আচার্য বা শুভমিতা র গলায় শোনা যেত তখন প্রথম প্রেমের হাতছানি টা অনেকেই অগ্রাহ্য করতে পারত না| প্রেম এখন ও হয় কিন্তু পুজোর দিন গুলোর সাথে হারিয়ে যাওয়া টা নেই| পুজোর গন্ধ বলতে আর একটি জিনিস এর কথা মনে এসে যায় তা হল পূজাবার্ষিকী| নিজের জন্য বরাদ্দ ছোটদের বই পেলেই তার গন্ধ নেওয়া আর নিজের বই গোগ্রাসে শেষ করার পর চুপিচুপি বড়দের বই পড়ীর মজা বুঝি আজকালকার বাচ্চারা আর পাবে না| পুজোর হোমওয়ার্ক শেষ করতেই তাদের পুজোর ছুটি শেষ|
আজকের জাকজমকের মধ্যে কোথায় যেন সেই সাবেকি পুজোটা হারিয়ে যাচ্ছে| ছোটদের সাথে বড়রাও এখন পাঠ্য বিষয়ের বাইরে অন্য কোনো বিষয়ে যোগ দেওয়া থেকে বিরত থাকেন| ছোটো থাকতে মা কে দেখতাম পূজার সময় মন্ডপ ছেড়ে বেরতে চাইতেন না| আমাদের ও পাড়ার বয়স্ক দাদু দিদিমা রা গল্প বলে ভুলিয়ে রাখতেন| সাবেকি পুজো বললেই এখন সবাই ভাবে যে বনেদী বাড়ীর পূজো| এটা ভুল ধারনা| এমন অনেক বাড়ী আছে যেখানে নিষঠা ভরে মায়ের পুজো হয় ও বাড়ীতে পুজোর অনেক রীতিনীতি আজ ও পালিত হয়| মোট কথা হয়ত থিম পুজোর আড়লে ঢাকা পড়ছে বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব, হারিয়ে যাচ্ছে সেই সব নস্টালজিক মূহূর্ত, যন্ত্রসর্বস্ব জীবনে পুজোও কি অনুভবের বেড়াজাল টপকে চলে যাচ্ছে সেরা হওয়ার ইঁদুর দৌড়ে? একটি বার ভেবে দেখলে ক্ষতি কি! কোটি কোটি টাকার মন্ডপ আলোকসজ্জা আর সোনার প্রতিমার জেল্লা না বাড়িয়ে মানুষের মধ্য জেগে উঠুক শুভ চেতনা আর অপরের প্রতি সহানুভুতি৷…আর পুজোর গন্ধ লেগে থাকুক সবার অভ্যন্তরে…কাশফুলের দোলায় বেজে উঠুক তার আলোকবেনু…।