ফেসবুক পোষ্ট সংগৃহীত:১৯৪১ সালের জানুয়ারি। সুভাষচন্দ্র তখন গৃহবন্দি। ১৭ জানুয়ারি ছদ্মবেশে গৃহত্যাগ করলেন। রেলযোগে পেশোয়ার হয়ে, পাহাড় ডিঙিয়ে জালালাবাদের পথে পৌঁছে গেলেন আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে। একমাত্র সঙ্গী ভগৎরাম তলোয়ার। আর সুভাষচন্দ্র তখন বোবা–‌কালা ‘‌মোল্লা জিয়াউদ্দিন’‌। ওই নামেই তৈরি হল পাসপোর্ট। ইতালীয় দূতাবাসের সহযোগিতায়, আফগানিস্তান থেকে এর পর রাশিয়ার মধ্যে দিয়ে তিনি পৌঁছে গেলেন জার্মানি।


জার্মানিতেই তৈরি করলেন ইন্ডিয়ান লিজিয়ন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ সৈন্য হিসেবে আফ্রিকান ফ্রন্টে যে ভারতীয়রা গিয়েছিলেন, তঁাদের অনেকেই জার্মান ও ইতালীয় বাহিনীর হাতে যুদ্ধবন্দি। রয়েছেন জার্মানির নানা বন্দিশিবিরে। সুভাষচন্দ্র এঁদের জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করলেন। প্রথমে মাত্র দশজন স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসা সৈনিককে নিয়ে শুরু হল যাত্রা। ১৯৪১ সালের ২ অক্টোবর পূর্ণাঙ্গ ব্যাটেলিয়নের কুচকাওয়াজে সুভাষচন্দ্র অভিবাদন গ্রহণ করলেন। এখানেই ১৯৪২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সৈনিকরা তঁাকে ‘‌নেতাজি’‌ রূপে বরণ করে নিলেন। তখন থেকেই তিনি নেতার নেতা নেতাজি। দূরদর্শী নেতাজি বিবেচনা করে দেখলেন, অতদূর থেকে ভারতে সামরিক অভিযান চালানো প্রায় অসম্ভব। তাঁকে যেতে হবে দক্ষিণ–‌পূর্ব এশিয়ায়। জাপানে তখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় বিপ্লবী রাসবিহারী বসু। বিমানে জার্মানি থেকে জাপান যাওয়া বিপজ্জনক।

তাই ঠিক হল সাবমেরিনে যাবেন নেতাজি। আফ্রিকা মহাদেশ ঘুরে ম্যাডাগাস্কারের ৪০০ মাইল দূরে এক জায়গায় জার্মান সাবমেরিন থেকে তাঁকে যেতে হবে জাপানের পাঠানো অন্য সাবমেরিনে। সাড়ে তিন মাস সমুদ্রের গভীর দিয়ে যাত্রা। সঙ্গী শুধুমাত্র আবিদ হাসান। পৌঁছলেন ইন্দোনেশিয়ায় মালয় বন্দরে। সেখান থেকে বিমানযোগে জাপান।
তখন প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল একটি কেন্দ্রীয় প্রশাসনের, যার নিয়ন্ত্রণে থাকবে স্বাধীনতা সংগ্রামের ভাবনাচিন্তা ও কাজকর্ম। নেতাজি তাঁর সমুদ্রযাত্রার সময়ই পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন। সেইমতো ১৯৪৩ সালের ২১ অক্টোবর সিঙ্গাপুরের ক্যাথে সিনেমা হলে, বাছাই করা পূর্ব এশীয় প্রতিনিধিদের সামনে ‘‌অন্তর্বর্তিকালীন স্বাধীন ভারত সরকার’‌ স্থাপনের কথা ঘোষণা করলেন।

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপ্রধান ও সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক রূপে শপথ নিলেন। মন্ত্রিসভায় রইলেন ২১ জন মন্ত্রী ও উপদেষ্টা। ২২ অক্টোবর রাতে প্রধানমন্ত্রীর বাসগৃহে মন্ত্রিসভার দ্বিতীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হল এবং মন্ত্রিসভা সর্বসম্মতিক্রমে ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। মন্ত্রিসভা এই যুদ্ধ ঘোষণা করার ভার প্রধানমন্ত্রীর ওপর ন্যস্ত করল। প্রধানমন্ত্রী নেতাজি সুভাষ রাত ২টোর পর সিঙ্গাপুর রেডিও মারফত যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। কিন্তু রাশিয়া ও চীনকে এই যুদ্ধের আঙিনার বাইরে রাখলেন।
শুরু হয়ে গেল আজাদ হিন্দ সরকারের সামরিক অভিযান। মাতৃভূমি শত্রুর দখলমুক্ত করার পবিত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ল আজাদি সেনারা। ১৯৪৩ সালের ডিসেম্বরেই এই স্বাধীন ভারত সরকারের হাতে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের শাসনভার চলে এল। ২৯ ডিসেম্বর নেতাজি তঁার সহযোগীদের নিয়ে বিমানযোগে পৌঁছে গেলেন পোর্ট ব্লেয়ার। ৩০ ডিসেম্বর ১৯৪৩ পোর্ট ব্লেয়ারের জিমখানা মাঠে প্রথমবারের জন্য ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। স্বাধীন ভারত সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপ্রধান রূপে দেশপ্রেমিক ভারতবাসীর মুকুটে গুঁজে দিলেন এক মহাগর্বের পালক।

যুদ্ধ তখন চলছে পূর্ণগতিতে। ৪ ফেব্রুয়ারি আজাদ হিন্দ সেনা ভারত–‌বর্মা সীমান্ত অতিক্রম করল। কর্নেল সৌকত আলি মালিকের নেতৃত্বে ভয়ানক লড়াই ও বহু শহিদের রক্তের বিনিময়ে ১৪ এপ্রিল মণিপুরের মৈরাং শহরতলি দখল করে নিল। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। নানা অসুবিধের মুখে সর্বাধিনায়কের নির্দেশে পশ্চাদপসারণে বাধ্য হল আজাদ হিন্দ সেনা। আগস্টের ৬ ও ৯ তারিখে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে আমেরিকা অ্যাটম বোমা ফেলল। আজাদ হিন্দ বাহিনীর প্রধান সাহায্যকারী দেশ জাপান আত্মসমর্পণে বাধ্য হল। তা সত্ত্বেও জাপান জানাল, ভারতকে ইংরেজের দখলমুক্ত করতে তারা নেতাজিকে সবরকম সাহায্য করতে প্রস্তুত। নেতাজি তঁার শেষ বক্তৃতায় দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, ভারত এবার স্বাধীন হবেই এবং তা হবে দু’‌বছরের মধ্যে।


১৮ আগস্টের তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনার কথা আমরা শুনেছি। কিন্তু বিচারপতি মনোজকুমার মুখার্জির তদন্ত রিপোর্ট পরিষ্কার বলছে, ওই সময় তাইহোকুতে কোনও বিমান দুর্ঘটনা ঘটেনি। তা হলে বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির যে মৃত্যু হয়নি, সে বিষয়ে সন্দেহ থাকার কথা নয়। কিন্তু প্রশ্ন হল, তা হলে নেতাজি গেলেন কোথায়?‌ পরিকল্পিত উপায়েই এই বিমান দুর্ঘটনার কথা জাপান সরকারের তরফে প্রচার করা হল। নেতাজির একমাত্র ভারতীয় বিমান সহযাত্রী কর্নেল হবিবুর রহমান জানিয়েছিলেন, বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু হয়েছিল। এ কথা অনুমান করা যে কোনও মানুষের পক্ষেই সম্ভব যে, হবিবুর পরিকল্পনা অনুযায়ী এবং সৈনিকের মন্ত্রগুপ্তির দায় নির্বাহ করতেই জীবনের শেষ পর্যন্ত একই কথা বলে গেছেন, যদিও নানা ইঙ্গিতে তিনি বুঝিয়ে দিতে চেষ্টা করেছেন যে, তাঁর কথা যেন বিশ্বাস করা না হয়। নেতাজির অন্তর্ধান নিয়ে বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট গবেষক প্রচুর পরিশ্রম করেছেন এবং সর্বোপরি বিচারপতি মনোজকুমার মুখার্জির পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান আমাদের সামনে যে সম্ভাব্য পরিণতির কথা ভাবতে সাহায্য করেছে, তাতে এই বিশ্বাস জন্মায় যে, নেতাজি একটি বিমানে মাঞ্চুরিয়ার পথে দাইরেন যাত্রা করেন এবং সেখান থেকে একটি জিপ গাড়ি করে রাশিয়া সীমান্ত পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেন। এই সময় আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করলে এ কথা ধরে নেওয়া যায় যে, রাশিয়ার শাসক স্ট্যালিন, যিনি নিশ্চিতভাবেই নেতাজি সুভাষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, তাঁকে ইংরেজ কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দিতে চাননি। তাই তাঁকে বেশ কিছুদিন অন্তরিন রাখা ছাড়া বোধহয় তাঁর অন্য উপায় সেই সময় ছিল না। এই প্রসঙ্গে দ্বিতীয় নেতাজি কমিশনের কাজে একটি সাক্ষ্যের উল্লেখ করতে হয়। বিষয়টি প্রায় অবিশ্বাস্য ও ভয়ঙ্কর হলেও এক্ষেত্রে কোনও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার কোনও কারণ থাকতে পারে না। দ্বিতীয় নেতাজি তদন্ত কমিশন, অর্থাৎ বিচারপতি খোসলা কমিশনে জনৈক শ্যামলাল জৈন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে শপথ নিয়ে তাঁর সাক্ষ্যে বলেন,‌ আজ আমি শপথ নিয়ে যে কথা বলছি তা সবৈব সত্য ঘটনা। ১৯৪৫ সালের ২৬ অথবা ২৭ ডিসেম্বর আমাকে জওহরলাল নেহরু ফোন করে ব্যারিস্টার আসফ আলি সাহেবের বাড়িতে আসতে বলেন। আমি টাইপরাইটার–সহ আসফ আলি সাহেবের বাড়ি পৌঁছলে শ্রী নেহরু তাঁর কোটের পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে তাঁর জন্য চার কপি টাইপ করে দিতে বলেন।

কাগজটা হাতে লেখা ও আমার পক্ষে বুঝে ওঠা কঠিন। তাই লেখাটি আমায় বেশ কয়েকবার পড়তে হয়েছিল। তাতে যা ছিল, আমি আমার স্মৃতিতে যা আছে তা তুলে ধরছি:‌ লেখা ছিল ‘‌২৩ আগস্ট দুপুরে সুভাষচন্দ্র বসু একটি জাপানি বোমারু বিমানে চড়ে দাইরেন (‌মাঞ্চুরিয়া)‌ নেমে চারজন জাপানি অফিসারের সঙ্গে জিপে করে রুশ অধিকৃত এলাকার দিকে চলে যান।’‌ টাইপ করা সম্পূর্ণ হলে নেহরুজি সব ক’‌টি কপি নিয়ে নেন এবং নিজের লেটারহেড থেকে চারটি পাতা শ্যামলাল জৈনকে দিয়ে একটি চিঠি টাইপ করতে বলেন। চিঠিটি নেহরু মুখে মুখে বলে দিয়েছিলেন। চিঠিটি লেখা হয়েছিল ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলিকে— ‘‌Dear Mr. Atlee, Bose, your war criminal, has been allowed to enter the Russian territory by Stalin. This is a clear treachery and betrayal of faith‌ by Russians, as Russia has been an ally of the British-‌Americans. Please take note of it and do what you consider proper and fit.‌’‌
যদিও বিচারপতি খোসলা সম্ভবত তাঁর নেহরু–ভক্তির কারণেই শ্যামলাল জৈনের সাক্ষ্যের ওপর কোনও গুরুত্ব দেননি। তবে দেশবাসী তাদের নিরপেক্ষ ভাবনায় মনে করেছে যে, একজন বৃদ্ধের সম্পূর্ণ মস্তিষ্কপ্রসূত এমন একটি ভয়ানক সাক্ষ্য দেওয়ার কোনও কারণ নেই। কাজেই এই বিবরণকে সত্য বলে ধরে নিলে বিমান দুর্ঘটনার তত্ত্ব খারিজ হয়ে যায়, যে কথা পরবর্তী কালে বিচারপতি মনোজকুমার মুখার্জি প্রামাণ্য হিসেবে তাঁর রিপোর্টে জানিয়ে দিয়েছেন। এর পর নেতাজির ঠিক কী হয়েছিল, তার সঠিক বিবরণ পাওয়া মুশকিল। তবে বিভিন্ন সূত্রের বিবরণ পর্যালোচনা করলে জানা যায় যে, নেতাজি ১৯৫০ বা তার পর অবধি রাশিয়ায় ছিলেন। পরবর্তী কালে রুশরা সম্ভবত নেতাজির দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে আর রাখতে চায়নি।‌‌‌‌‌ তবে আমরা দৃঢ়তার সাথে স্বীকার করি দেশের নেতা নেতাজি৷ *এই লেখাটি লেখকের ফেসবুক পেজ থেকে সংগৃহিত’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here