তাতাই বাইরে বাইরে ঘুরতে খুুব ভালবাসে কিন্তু পরীক্ষার চাপে চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়ে বেশ কয়েক দিন হয়ে গেল কোত্থাও যাওয়া হয়ে উঠছে না ৷ তাই মনটা খুবই খারাপ হয়ে আছে তার ৷ স্কুলে ও এখন টানা ছুটি পাওয়া যাবে না , সেই পুজোর সময় ছাড়া ৷
কি করা যায়? চুপিচুপি সবার চোখের আড়ালে বাবাকে সে রাজি করিয়ে নিল মাত্র একদিনের জন্য যাতে কোথাও টুক করে ঘুরে আসা যায় , কারন সে জানে বাবা ও তার মতোই ভ্রমন পিপাসু ৷ কিন্তু কোথায় যাওয়া যায়? গুগল গুরুদেব এর মহিমায় জানা গেল এক দিনের জন্য বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়া ও মুকুটমনিপুর হয়ে উঠতেই পারে আদর্শ ভ্রমন স্থল ।
যেমন ভাবা তেমন কাজ , পরের দিন ভোরে বাবা ছেলে সামান্য প্রয়োজনীয় জিনিস চটপট ব্যাগে ভরে ৭.৪৫ এর রূপসী বাংলা এক্সপ্রেসে চড়ে পড়ল ৷ হাওড়া ছাড়তেই দুপাশে অসাধারন সব দৃশ্যপট পিছনে ফেলে ট্রেন এগোচ্ছে দ্রুত গতিতে ৷ তাতাই এর তো খুব মজা… সে জানলার কাছে বসে দৃশ্য উপভোগে ব্যস্ত ।
বিষ্ণুপুর
প্রায় ১০ টা নাগাদ ওরা নামল প্রত্ন প্রাচীন শহর বিষ্ণুপুর স্টেশানে । সেখান থেকে রিকশা বা টোটোতে লাল মাটির রাস্তা দিয়ে প্রাচীন স্থাপত্য গুলো ঘুরিয়ে দেখানো হয় ৷ তবে প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য টিকিট ২৫ টাকা , এরবারই কাটলে চলে কিন্ত তাতাই এর বয়স ১৫ এর নীচে তাই তার টিকিট লাগবে না …
প্রথমেই যাওয়া হবে এখানকার স্থাপত্যকীর্তির অন্যতম নিদর্শন ঝামাপাথরের তৈরী রাসমঞ্চ ৷ বিষ্ণুপুর মল্ল বংশেররাজাদের হাতেই তৈরী বলা যায়, সেই মোগল সাম্রাজ্যের আমলে ও তাদের দখলেই ছিল এই স্থল ৷ তাতাই গল্প শুনতে শুরু করল বাবার কাছে……১৬৯৪ সালে মল্ল রাজা দু্র্জয় সিং তৈরী করেন বিষ্ণুপুর শাঁখারি বাজারে মদনমোহনের মন্দির ,তারও আগে ১৬০৭ সালে বীর হাম্বিরের তৈরী এই দেউলধর্মী রাসমঞ্চ ৷
রাধা কৃষ্ণের যুগলে এথানে রাস উৎসবের আয়োজন করতেন মল্লরাজারা ৷ স্পটে পৌঁছে তাতাই তো অবাক… আরে এতো মিশরীয় পিরামিডের ধাঁচে তৈরী! আর সেটা ৩টি গ্যালারিতে ৬৪ টা প্রকেষ্ঠে বিভক্ত যেখানে অনেকে মিলে ভালই লুকোচুরি খেলা যায় ৷
স্থানীয় জায়গা থেকে খোঁজ পাওয়া গেল যে ফি শনিবার এখানে হাট বসে আর সেদিন আদিবাসীরা মাদল বাজিয়ে গান নাচের সাথে সাথে তাদের পোড়া মাটির পশরা সাজিয়ে বসে ও কিভাবে সেই কাজ করা হয় তার একঝলক নির্দশন ও জানা যায় ৷
পাশেই মাঠে শীতের সময় জাতীয় মেলা হিসাবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বিষ্ণুপুর মেলা বসে ৷ তাতাই ভাবল ওই সময় আবারএরকম একটা ঝটিকা সফর করলে হয়৷ তাতাই তড়িঘড়ি কিনল একটা মাটির শঙ্খ, আর কিছু পোড়া মাটির মূর্তি , শঙ্খটা অবশ্য মায়ের জন্য ।
বেশীক্ষণ সময় নষ্ট না করে এর পর ওরা চলল পরবর্তী স্থান শ্যামরায় ৷ ১৬৪৩ সালে রঘুনাথ সিং এর তৈরী শ্যামরায় অসাধারন অলংকরনে এ বিখ্যাত, টেরাকোটার কাজে ওদের চোখ টেরিয়ে যাওয়ার জোগাড় ৷ দেওয়ালে ফুটে উঠেছে গোপগোপিনী সহ শ্রীকৃষ্ণের রাস উৎসব ও পুরানের দেবদেবীদের নানান বর্ণময় দৃশ্য ।
এরপর ১৬৫৫ তে তৈরী জোড়বাংলা বা ক্ষেত্র ৷ বাংলার চালার ছাদে তৈরী শিখর এর প্রধান বৈশিষ্ট্য ৷ এক্ষেত্রে তাতাই দেখল সব মন্দিরেই টেরাকোটার কাজে সবসময় যে দেবদেবীর মূর্তি খোদাই হয়েছে তা নয় , জোড়বাংলা তে টেরাকোটার কাজে ফুটে উঠেছে তৎকালীন সমাজ জীবনের মূর্তি, শিকারের ছবি, যুদ্ধের ছবি , যা বহুবছর ধরে বয়ে নিয়ে চলেছে বাংলার স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের প্রাচীনতার সাক্ষর ।
এই ক্ষেত্রের পাশেই রয়েছে রাধেশ্যাম মন্দির , এখানে কিন্তু আবার টেরাকোটাও নেই আর পোড়ামাটির কাজ ও নেই ৷আশ্চর্যজনক ভাবে এখানে প্রধানত বাংলার চালার ছাদে মাকড়া পাথরের ভাস্কর্য ।
মাকড়া পাথর মানে কি তাতাই জানে না তাই তার বাবা কে বলে দিতে হল স্থানীয় ভাষায় মাকড়া পাথর মানে আমরা যাকে ল্যাটেরাইট মাটি বলি সেটাই ৷ দূর থেকে জোড়বাংলার স্থাপত্য ও ভাস্কর্য কীর্তি দেখে ওরা বিস্মিত হয়ে গেল ।
দেড় ঘন্টার লেগে গেল এত গুলো মন্দির দেখতে, কিন্তু বিষ্ণুপুরের দক্ষিণ টুরিস্ট লজের পিছনে এসে আরও এক চমক , এখানে এসে দেখা গেল “দলমাদল”কামান যা তখন কার দিনে ১লক্ষ ৮৫ হাজার টাকায় তৈরী করেন রাজা গোপাল সিং বর্গীহানা থামানের জন্য | তাতাই এর জীবনে এই প্রথমবারের এতবড় কামান দর্শন হল ।
বাঁকুড়া
এবার তাতাই বায়না ধরল এতটা পথ এসে শুধু বিষ্ণুপুরদেখে সে ফিরে যাবে না , বাঁকুড়া টাও ঘোরাতে হবে তাকে , তার বায়না সামলাতে না পেরে তাতাই এর বাবা আবার ওনলাইনে টিকিট কেটে ফেললেন আরণ্যক এক্সপ্রেসে , ১১.৪৫ ই বিষ্ণুপুর স্টেশন থেকেই ছাড়ে ৷
তাতেই দুজনে উঠে বাঁকুড়ার উদ্দেশ্যে রওনা হল , পথে টুকিটাকি কিছু খেয়ে নেওয়া হল দুজনে ৷আধ ঘন্টায় আরণ্যক ওদের পৌঁছে দিল বাঁকুড়া স্টেশনে ৷ স্টেশন থেকেই একটা অল্টো গাড়ি ভাড়া করে দুজনে সড়কপথে বেড়িয়ে গেল সোজা মুকুটমনিপুর , স্টেশন থেকে ৫০ কিমি র পথ ।
পথে দেখা গেল অসাধারন রোড পেন্টিং ৷ এবার মুকুটমনিপুর নেমে ওরা দেখল ,লগ গেট পেরিয়ে কংসাবতি ভবন ,আর টুরিস্ট লজের কেয়ারি করা বাগান ছাড়িয়ে দূরে দিকচক্রবলয়ের মতো অনুচ্চ পাহাড় টিলা আর সামনে কাকচক্ষু জল বুকে বয়ে চলেছে সুন্দরী কংসাবতি নদী ৷
তাতাই জল দেখেই তৎক্ষণাৎ জামা খুুলে ঝাঁপ দিল অগভীর কাঁচের মতো জলে । প্রচন্ড গরমে ঠান্ডা জলে স্নান করে তার শরীর ঠান্ডা হল ৷ অনতিদূরে ১১ কিমির কংসাবতি বাঁধ দেখা যাচ্ছে আর অনবদ্য সূর্যাস্তের শোভা মুগ্ধ করছে ওদের । বোটিং ও করা যায় কিন্তু তাতাই দের এবার ফিরতে হবে যে …।
গ্রামের পথে নয়নাভিরাম প্রকৃতির কোলে সবুজ ছাওয়া লেকের জল ছেড়ে তাতাই কে তোলাই মুশকিল হয়ে পড়েছিল ৷ আঁকা বাঁকা মেঠো পথ হঠাৎ কেমন যেন শেষ হয়ে গেল , সারা দিনের দৌঁড় ঝাঁপে তাতাই ক্লান্ত ঠিকই কিন্তু বিকেলে ৫.৩০ টার ফেরার ট্রেন রূপসী বাংলা তে চড়েও তার চোখে ভাসছিল টেরাকোটার কাজে বিষ্ণুপুরের মন্দির , পোড়ামাটির কাজ, কংসাবতী নদী, সুন্দর গ্রাম্য পরিবেশ । তবে শুশুনিয়া পাহাড় টা ঘোরা হল না এই তার আফশোস ।
তাতাই আর তার বাবার মতো অচেনা নিরিবিলি জায়গায় যেতে ইচ্ছুক যারা আছেন তারা একদিনের জন্য টুক করে ঘুরে আসতেই পারেন লাল মাটির সাড়ানে , একটুকরো প্রাচীন বাংলার অস্বাদ পেতে ৷