দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ সোমবার মেদিনীপুরে জনসভা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। ২০১১-তে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে অন্তত বার তিরিশেক তিনি এই জেলায় এসেছেন। কখনও জনসভা, কখনও বা প্রশাসনিক বৈঠক করতে। কিন্তু এদিনের সভা রাজনৈতিক দিক থেকে আলাদা মাত্রা পেয়েছে। মঞ্চ থেকে কী বার্তা দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় , তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে গোটা রাজ্য।
লকডাউনের পর গতমাসে বাঁকুড়ায় প্রথম জনসভা করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দল ও একুশের লড়াইয়ের উদ্দেশে সেই মঞ্চ থেকে ধারালো বার্তা ছিল যথেষ্টই। বিশেষ করে দিদি জানিয়ে দিয়েছিলেন, সব ব্লকের পর্যবেক্ষক এখন তিনিই।
কিন্তু আজ সোমবার, মেদিনীপুরের কলেজ মাঠে যে সভা করতে চলেছেন তৃণমূলনেত্রী তা যেন আক্ষরিক অর্থে ‘ঐতিহাসিক’। ৯৮ সালে তাঁর অনুগামীদের নিয়ে কংগ্রেস ভেঙে বেরিয়ে এসেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গত বাইশ বছরে তাঁর হাতে গড়া সেই দলের ওঠা পড়া যাই থাকুক, ভাঙনের সংশয় কখনও ছিল না। অথচ এখন, ভাঙনের সংশয় যেন গ্রাস করতে চাইছে। দিদির দল ভেঙে বেরিয়ে যেতে চাইছেন দাদার অনুগামীরা। এবং ক্রমশই সেই সংক্রমণ বাড়ছে। অর্থাৎ দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
গত ২৭ নভেম্বর শুভেন্দু অধিকারী রাজ্য মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দেওয়ার পরই মেদিনীপুরে সভার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। মেদিনীপুর শুভেন্দুর ঘরের মাঠ। এর আগে দেখা গিয়েছিল, ১০ নভেম্বর নন্দীগ্রামে শুভেন্দুর সভার পাল্টা সভা করেছিল তৃণমূল। কিন্তু সেই সভা আড়েবহরে শুভেন্দুর সভার ধারে কাছেও ঘেঁষতে পারেনি। ফলে মেদিনীপুরে নেত্রীর সভা ঘোষণা হওয়ার পর অনেকে ধরে নেন, শুভেন্দুকে মোকাবিলার জন্য নিজেই মাঠে নামছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
রবিবার সন্ধ্যায় পশ্চিম মেদিনীপুর পৌঁছে গিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। তার আগে বিকেলে মেদিনীপুর কলেজ-কলেজিয়েট স্কুল মাঠে প্রস্তুতি ঘুরে দেখেন দলের সর্বভারতীয় সভাপতি সুব্রত বক্সি। জেলা নেতৃত্বের সঙ্গেও বেশ কিছুক্ষন আলোচনা করেন তিনি। জনসভাকে ঘিরে ইতিমধ্যেই সেজে উঠেছে পুরো এলাকা। পতাকা, ব্যানার, হোর্ডিংয়ে নেত্রীর ছবিতে ভরে গিয়েছে গোটা শহর। পুলিশি নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। শুভেন্দু অধিকারী মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই সভা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছে জেলার রাজনৈতিক মহলও। তবে একটা বিষয় নজরে পড়েছে সবারই। এর আগে প্রতিটি সভায় মুখ্যমন্ত্রীর পাশাপাশি শুভেন্দু অধিকারীর কাটআউট, ব্যানার দেখা গেলেও এবার তা নেই। সভাকে সফল করতে গত ৭দিন ধরে গ্রাম থেকে শহর, পাড়ার অলিগলিতে প্রচার করেছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। ২০১৮ সালের অগস্ট মাসে এই মাসে সভা করেছিলেন তৃণমূল নেত্রী। তারপর ফের আবার আড়াই বছর বাদে।
সূত্রের খবর, রবিবার সন্ধ্যায় মেদিনীপুর সার্কিট হাউসে পৌঁছনোর পর রাতে এক এক করে বেশ কয়েকজন জেলা নেতাকে ডেকে কথা বলেন নেত্রী। যদিও এ বিষয়ে জেলা তৃণমূল নেতৃত্ব কোনও মন্তব্য করতে চায়নি। আসার পথে পূর্ব মেদিনীপুরের কয়েকজন তৃণমূল নেতার সঙ্গেও তিনি কথা বলেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গিয়েছে।
ঘরোয়া আলোচনায় দলের এক নেতা অবশ্য বলেন, মেদিনীপুরের সভা হল প্রতীকী। শুধু মেদিনীপুর নয়, রাজ্যে দলকে সঙ্ঘবদ্ধ করার লক্ষ্যেই বার্তা দিতে পারেন নেত্রী। ‘বিশ্বাসঘাতকদের’ ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে মেপে নেওয়ার কথা বলতে পারেন আজকের সভা থেকে।
এই প্রতিবেদন যখন লেখা হচ্ছে, ততক্ষণে পূর্ব, পশ্চিম মেদিনীপুর ও আশপাশের জেলা থেকে ক্রমশই ভিড় জমতে শুরু করেছে মেদিনীপুর কলেজ মাঠে। জানা গিয়েছে, মঞ্চে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে থাকতে পারেন লালগড়ের জন সাধারণের কমিটির নেতা ছত্রধর মাহাতো, রাজ্যসভা সাংসদ মানস ভুইঞাঁ, রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী, মহা সচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ।
কিন্তু কৌতূহল হল, দুই মেদিনীপুরের সমস্ত বিধায়ক ও ব্লক সভাপতি উপস্থিত থাকবেন কী?
পূর্ব মেদিনীপুরের জেলা সভাপতি হলেন কাঁথির সাংসদ শিশির অধিকারী। রবিবারই দেখা গিয়েছে, পায়ে ক্ষত নিয়ে বসে রয়েছেন শিশিরবাবু। তাঁর ডান পায়ের নখ ভেঙে ঢুকে গিয়েছে। ফলে অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। তবে সূত্রের খবর, শিশিরবাবু জেলার সমস্ত বিধায়ক ও ব্লক সভাপতিকে এদিনের বৈঠকে উপস্থিত থাকতে বলেছেন।
জেলা রাজনৈতিক সূত্রের মতে, পূর্ব মেদিনীপুরে জেলা জুড়ে শুভেন্দুর পোস্টারে ছয়লাপ হয়ে গিয়েছে। তবে কৌশলগত ভাবে হয়তো শুভেন্দুও চাইবেন না যে কোনও বিধায়ক বা ব্লকের নেতা এদিনের সভায় অনুপস্থিত থাকুন। কারণ, তা করলে তিনি নজরে পড়ে যেতে পারেন। তাই আগামী দিনে যাঁদের দল ছাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তাঁরাও হয়তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এদিনের সভায় উপস্থিত থাকবেন।
২০১১ সালে জঙ্গলমহল থেকে ব্যাপক সমর্থন পেয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস। ২০১৬-তেও তাই। তবে গত লোকসভা ভোটে জঙ্গলমহলে বেশ কিছু জায়গায় থাবা বসায় গেরুয়া শিবির। ২০২১ এর নির্বাচনে জঙ্গলমহলের মানুষের কতটা সমর্থন আদায় করতে পারে শাসকদল সেটাই এখন দেখার। সোমবারের জনসভায় জেলার কেশপুর, খড়্গপুর গ্রামীন, সবং, পিংলা, শালবনি সহ বেশ কয়েকটি জায়গা থেকে বেশি লোক আনার ওপর জোর দিয়েছে দল। জেলার বিভিন্ন ব্লকে প্রকাশ্যে দাদার অনুগামীদের প্রভাব চোখে পড়লেও কেশপুরে এখনও অনুগামীদের দেখা যায়নি। দলের কো-অর্ডিনেটর বিধায়ক শিউলি সাহা বলেন, ‘কেশপুরের মানুষ বরাবর দিদির সঙ্গে থেকেছেন। ২০২১ সালেও দিদির সঙ্গেই থাকবেন।
কেশপুর সহ জেলার সমস্ত বিধানসভা এলাকা থেকে হাজার হাজার মানুষ আসবেন।’ বিজেপির জনবিরোধী নীতির প্রতিবাদে গত ৭ দিন ধরে নানা ভাবে প্রচার করেছে তৃণমুল কংগ্রেস। জেলা তৃণমূলের সভাপতি অজিত মাইতির দাবি, ‘নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনসভায় ২ লক্ষ মানুষ উপস্থিত হবেন। দিদির সঙ্গেই মেদিনীপুর। সোমবার আরেকবার মেদিনীপুরের মানুষ তা প্রমাণ করে দেবেন।’ ইতিমধ্যেই সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচির সাফল্য তুলে ধরে বাড়ি বাড়ি প্রচার শুরু করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। তবে সবকিছু ছাপিয়ে একটাই আগ্রহ তৈরি হয়েছে প্রাক্তন মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারীকে নিয়ে। তাঁর রাজনৈতিক দোলাচলের মধ্যে সোমবারের জনসভায় দলের কর্মী সমর্থকদের কী বার্তা দেন মুখ্যমন্ত্রী। সেদিকে তাকিয়ে সবাই।