দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ এবার সিরিয়াল কিলার বাংলায়। মহিলাদের প্রতি তার ছিল প্রচণ্ড ঘৃণা। আর তার জেরেই সে করে গিয়েছে একের পর এক খুন। নেপথ্যে ছিল প্রেম। প্রথমে প্রেমের প্রস্তাব। তারপর বেশ কিছুদিন প্রেম।
তারপর প্রেমিকাকে খুন। আপাতত সিনেমার চিত্রনাট্য বলে মনে হলেও আসলে এটা বাস্তব ঘটনা। গত ৩ মাস ধরে কুখ্যাত এই সিরিয়াল কিলারকেই খুঁজে চলেছিল পূর্ব বর্ধমানের কালনার পুলিস। বর্ধমান রেঞ্জের পুলিস এই ব্যক্তির খোঁজে রীতিমতো তৎপরতা দেখিয়েছে। তদন্তে নামার আগে পুলিসের কাছে খবর আসতে থাকে এলাকা জুড়ে একের পর এক খুন হচ্ছে।
খুনের চরিত্র মিলিয়ে দেখা যায়, প্রত্যেকটি খুনের নিশানা কোনও না কোনও মহিলা। উঠে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য।
২৭ জানুয়ারি কালনার আনুখাল গ্রামে রহস্যজনক ভাবে খুন হয়েছিলেন পুষ্পা দাস নামে এক মাঝবয়সি মহিলা। ২১ মে কালনার গোয়ারাতে খুন হন আরও এক মহিলা, একই ভাবে। ফের মে মাসেরই ২৭ তারিখে মন্তেশ্বরের বাঘাসনে খুন হন অঞ্জনা রায়। এরই মাঝে আবার মেমারির সাতগাছিয়ায় একই দিনে খুন করা হয় দুই মহিলাকে। হুগলির বলাগড়েও খুন হয়ে যান আরও এক মহিলা।
আপাত দৃষ্টিতে এই খুনগুলি পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত না হলেও, একটা জায়গায় এসে মিলে গিয়েছিলেন তদন্তকারীরা। কারণ প্রতিটা ক্ষেত্রেই খুনের কায়দা অবিকল এক, এবং তা খুব একটা প্রচলিত নয়। প্রতিটা ক্ষেত্রেই পুলিশ দেখে, মৃত মহিলাদের গলায় বিশেষ রকমের চেনের প্যাঁচের চাপে ক্ষত তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ শ্বাসরোধ করে খুন করতে গিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে কোনও ধাতব চেন।
ফরেন্সিক তদন্তে পরিষ্কার হয়, মৃতদের গলার ক্ষতর যে প্যাটার্ন, তা একই। এবং তা তৈরি হয়েছে সাইকেলের একটি নির্দিষ্ট চেনে। অর্থাৎ সাইকেলের চেন পেঁচিয়েই মারা হয়েছে তাঁদের। এবং আরও কাকতালীয় ভাবে, প্রতিটা ক্ষেত্রেই খুন হয়েছেন কোনও না কোনও মহিলা। এবং ঘটনার সময়ে তাঁরা প্রত্যেকেই ঘরে একা ছিলেন। কারও কারও গলার প্যাঁচের পাশাপাশি মাথায় ভারী লোহার রডের আঘাতেরও চিহ্ন মেলে।
শুধু তা-ই নয়। বর্ধমানের আরও ছ’টি এলাকা থেকে খবর আসে, গলায় সাইকেলের চেন ছুড়ে হামলা করা হয়েছে আরও বিভিন্ন মহিলার উপরে। একটি এদিক ওদিক হওয়ার জন্য প্রাণে বেঁচে গিয়েছে তারা। এগুলির মধ্যে সাম্প্রতিকতম ঘটনাটি ঘটেছে গত বৃহস্পতিবার, কালনার সিঙ্গেরকোণে। এক নাবালিকার উপর আচমকা সাইকেলের চেন ছুড়ে হামলা করে অজ্ঞাতপরিচয়, হেলমেটধারী দুষ্কৃতী। বর্ধমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে ওই নাবালিকার।প্রাথমিক তদন্তে পুলিশেরা সন্দেহ করে, সব ক’টি খুন এবং হামলার পিছনে রয়েছে একটাই মাথা
পুলিস সূত্রে খবর, কালনায় পর পর ৬ মহিলাকে খুন করা হয়েছে। সিরিয়াল কিলার কামারুজ্জামান সরকারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাকে জেরা করে পুলিস জানতে পারে, মুর্শিদাবাদ থেকে এসে কালনায় থাকতে শুরু করেছিল সে। পেশা বলতে ছিল ভাঙের ব্যবসা। ধৃত মোটরবাইক পছন্দ করত।
তবে মহিলাদের বেছে বেছে কেন খুন? পুলিসের দাবি, মহিলাদের ওপর কোনও সুপ্ত ঘৃণার জেরেই একের পর এক খুন করে গিয়েছিল কামরুজ্জামান। প্রতিটি খুনই সে গলায় সোনার চেনের ফাঁস দিয়ে ঘটিয়েছে। আর খুনের পর মহিলাদের মূল্যবান কিছু জিনিস লুঠ করে পালাত কামরুজ্জামান। অভিযোগ, খুনের পর মৃতদেহের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে জড়াত অভিযুক্ত। সেটাকে জয়ের স্মারক হিসাবে বাড়িতে রেখে দিত সে। এটাকে মানসিক রোগ বলে মনে করা হচ্ছে।
সূত্রের দাবি, মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা কামরুজ্জামান, পূর্ব বর্ধমানের সমুদ্রগড়ে এসে বসবাস শুরু করে। তার সেখানের বাড়িতে স্ত্রী , দুই ছেলে এবং এক মেয়েকে নিয়ে সংসার ছিল। আপাতভাবে শান্ত কামারুজ্জামান কীভাবে এমন একের পর এক খুনের ঘটনা ঘটাতে পারে তা নিয়ে হতবাক এলাকাবাসীরা। পুলিসের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে ধোপদুরস্ত জামা কাপড়ের পাশাপাশি হেলমেট পরে ঘুরে বেড়াত অভিযুক্ত কামরুজ্জমান সরকার।
শেষমেশ রবিবার রাতে ধরা পড়ে সিরিয়াল কিলার কামরুজ্জামান সরকার! কালনার সুজনপুর গ্রামের বাসিন্দা, ‘ভাল মানুষ’ বলে এলাকায় পরিচিত কামরুজ্জামান যে এমন কাণ্ড করতে পারে, তা যেন অবিশ্বাস্য সকলের কাছে!
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, দেড় বছর আগে মুর্শিদাবাদ জেলার কালিনগর এলাকা ছেড়ে সপরিবার বর্ধমানে চলে আসে কামরুজ্জামান। স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে কালনার সুজনপুর গ্রামে বসবাস শুরু করে। গ্রামে রীতিমতো শান্তশিষ্ট মানুষ হিসেবেই পরিচিত ছিল সে। প্রতিদিন সকালে সেজেগুজে মোটরবাইক নিয়ে কাজেও বেরোত। তবে সে কী কাজ করত, তা অবশ্য কেউ টের পেত না।
কামরুজ্জামান লাল-কালো রঙের একটি মোটরবাইক ব্যবহার করত বলে জানা গিয়েছে। তার সঙ্গে থাকত একটি নাইলনের ব্যাগ, যাতে রাখা থাকত সাইকেলের চেন ও রড। অপরাধ করার সময় সে মাথায় হেলমেট পরে যেত।
তবে এই ঘটনার পরে অনেকেই বলছেন, কামরুজ্জামানের নিঃশব্দ কাজকর্ম ও চলাফেরা নিয়ে কিছু কিছু মানুষ সন্দেহ করতেন বটে। কৌতূহলও ছিল। অনেকই জানতেন, সে ভাঙাচোরা জিনিসের ব্যবসা করে। তবে সে যে ঠান্ডা মাথায় পরপর মানুষ খুন করে বাড়ি ফিরত, তা কেউ দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। গ্রামের সুপরিচিত ও শান্ত মুখ কামরুজ যে এত বড় ‘সিরিয়াল কিলার’, তা জেনে চমকে যায় গ্রামবাসীরা!
এই আক্রমণের থেকে বেঁচে যাওয়া মহিলাদের কাছ থেকে অপরাধীর বর্ণনা শুনে সিআইডির বিশেষজ্ঞ পুলিশ অফিসারদের দিয়ে খুনির স্কেচ আঁকানো হয়। কিছু অস্পষ্ট সিসিটিভির ফুটেজও জোগাড় হয় অপরাধস্থল থেকে। এর পরেই কয়েকটি বিষয় নিশ্চিত হয়ে গোটা জেলা জুড়ে নাকা তল্লাশি শুরু করে পুলিশ। রবিবার রাতের নাকাতেই অবশেষে পুলিশ সাফল্য পায়।ধরা পড়ে যায় কামরুজ্জামান সরকার।
কামরুজ্জামানের কাছ থেকে প্রচুর গয়নাও উদ্ধার করেছে পুলিশ। তবে জানা গিয়েছে, সে সবই প্রায় ইমিটেশনের গয়না। অল্প কিছু গয়না কেবল সোনা ও রুপোর। তার কাছ থেকে পুলিশ তিনটি মোবাইল ফোনও উদ্ধার করে। সোমবার তাকে বর্ধমান আদালতে তোলা হলে ১৩ দিনের পুলিশি হেফাজত ঘোষণা করেন বিচারক।
পুলিশ জানিয়েছে, এই তদন্তের কিনারা করতে গেলে পুনর্নির্মাণ করতে হবে গোটা ঘটনার । তবেই একের পর এক খুনের আসল ছবি পরিষ্কার হবে।
পুলিশ সূত্রের খবর, এখনও জেরা চলছে কামরুজ্জামানের। ঠিক কী কারণে সে এমনটা ঘটাত, তা স্পষ্ট হয়নি। তবে সে তীব্র মানসিক সমস্যার শিকার বলেই আন্দাজ করছে পুলিশ।