দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ পর পর ৯ দিন। তার মধ্যেই দৈনিক সংক্রমণ ৮ লাখের চৌকাঠে এসে থামল। আমেরিকার রেকর্ডও ভেঙে করোনা সংক্রমণের নিরিখে বিশ্বে নতুন রেকর্ড গড়ল ভারত। এমন ভয়ঙ্কর সংক্রমণ আগে কখনও দেখা যায়নি। গত বছরও ধাক্কাটা সামলে ওঠা গিয়েছিল। কিন্তু এবছর করোনা যেন লাগামহীন। তার ওপরে একের পর এক নতুন মিউট্যান্ট প্রজাতি ছড়িয়ে পড়ছে ভারতে। বল্গাহীনভাবে বেড়ে চলেছে আক্রান্তের সংখ্যা। মৃত্যুতেও রাশ নেই। দৈনিক মৃত্যু সাড়ে তিন হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
শনিবার কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৪ লাখ ১ হাজার ৯৯৩ জন, মৃত্যু হয়েছে ৩৫২৩ জনের। এদিকে করোনাকে হারিয়ে একদিনে সুস্থ হয়ে উঠেছেন ২ লাখ ৯৯ হাজার ৯৮৮ জন। এখনও পর্যন্ত দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ১ কোটি ৯১ লাখ ৬৪ হাজার ৯৬৯ জন, সুস্থ হয়ে উঠেছে ১ কোটি ৫৬ লাখ ৮৪ হাজার ৪০৬ জন। এদিকে দেশে করোনা প্রাণ কেড়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ৮৫৩ জনের। এই মুহূর্তে দেশে সক্রিয় করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৩২ লাখ ৬৮ হাজার ৭১০ জন।
ভাইরাস সক্রিয় রোগীর সংখ্যাও সাঙ্ঘাতিকভাবে বাড়ছে দেশে। এখনই কোভিড অ্যাকটিভ রোগীর সংখ্যা ৩২ লাখের বেশি। অ্যাকটিভ কেসের হার ১৭ শতাংশ। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই হারে ভাইরাস সক্রিয় রোগী বাড়তে থাকলে সংক্রমণের হার আরও বাড়বে। বেশি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে সংক্রমণ। কোভিড পজিটিভিটি রেটও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
করোনায় মৃত্যু যেন তাণ্ডব করছে দেশে। হাজার হাজার করোনা রোগীর মৃত্যু হচ্ছে। দৈনিক মৃত্যু চার হাজার ছুঁতে চলেছে। দিল্লি, মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ুর ছবিটা ভয়ানক। রাজধানীতে যেন মৃত্যুমিছিল শুরু হয়েছে। শ্মশানে ঠাঁই নেই, গণচিতা জ্বলছে। নতুন করে কবর খোঁড়া হচ্ছে।
গত তিন-চার সপ্তাহে শুধুমাত্র নথিভুক্ত মৃতদেহ ৩৯৮২টি। সূত্রের খবর, প্রকৃত সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি, কারণ নথিভুক্ত না করেই অগণিত মৃতদেহ দাহ হয়ে যাচ্ছে। দিল্লির দুটি হাসপাতালে ইতিমধ্যেই অক্সিজেনের অভাবে কোভিড রোগীর মৃত্যু হয়েছে। বহু হাসপাতালেই নিয়মিত অক্সিজেনের টানাটানি পড়ছে।
অনেক হাসপাতালে রোগীকেই সঙ্গে করে অক্সিজেনের সিলিন্ডার নিয়ে যেতে হচ্ছে। সিলিন্ডার ফুরিয়ে গেলে অক্সিজেন ভরানোর জন্যও দীর্ঘ লাইন পড়ছে। হাসপাতালে কোভিড বেড নেই, অক্সিজেন সিলিন্ডারের অভাব, হাসপাতালের বাইরে রোগীর লাইন, পরিজনদের কান্না সব মিলিয়ে ছবিটা মর্মান্তিক। মহারাষ্ট্রেরও একই অবস্থা। সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না কিছুতেই। অক্সিজেনের ঘাটতি মেটাতে বিদেশ থেকে মেডিক্যাল অক্সিজেন নিয়ে আসার চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় সরকার। ব্রিটেন, আমেরিকা, ফ্রান্স, জার্মানি করোনা মোকাবিলায় ভারতের পাশে দাঁড়িয়েছে।
করোনা কেন এত প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে তার কারণ হল একাধিক মিউট্যান্ট স্ট্রেন ছড়িয়ে পড়েছে ভারতে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার ডবল মিউট্যান্ট প্রজাতি কী তা বুঝে উঠতে না উঠতেই নতুন প্রজাতি থাবা বসিয়েছে দেশে। এই প্রজাতি আবার ট্রিপল মিউট্যান্ট, মানে পর পর তিনবার এর জিনের গঠন বিন্যাস বদলে গিয়ে আরও ছোঁয়াচে হয়ে গিয়েছে। সব মিলিয়ে করোনার পাঁচ থেকে ছটি প্রজাতি এখন দেশেরই নানা রাজ্যে রাজত্ব শুরু করে দিয়েছে। তাদের আবার বদলও হচ্ছে। ধারাবাহিকভাবে মিউটেশন বা জিনের বিন্যাস বদলে চলেছে ভাইরাস। এই রূপ বদলের কারণেই নতুন নতুন প্রজাতির দেখা মিলতে শুরু করেছে, আর সে কারণে সংক্রমণের হারও দ্রুতগতিতে বেড়ে চলেছে।
তবে কানপুরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (আইআইটি) ও হায়দরাবাদ আইআইটি-র গবেষকরা বলেছেন, মে মাসের ১১ থেকে ১৫ তারিখের মধ্যে দেশে ভাইরাস সক্রিয় রোগীর সংখ্যা ৩৩ থেকে ৩৫ লাখে পৌঁছবে। এটাই হবে সর্বোচ্চ। তারপরে এক ধাক্কায় সক্রিয় রোগীর সংখ্যা কমতে থাকবে। মে মাসের শেষে এসে কোভিড অ্যাকটিভ কেসের হার একেবারেই কমে যাবে। যদি ভিড়, মেলামেশা, জমায়েতে লাগাম পরানো যায় তাহলে সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণ আসবে, তা না হলে ভাইরাস আরও ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়ে ছড়িয়ে পড়বে।
প্রসঙ্গত, আজ থেকেই দেশজুড়ে শুরু হয়েছে ১৮ ঊর্ধ্বদের টিকাকরণ। এর মধ্যেই টিকার দামের বৈষম্য নিয়ে মাথা চাড়া দিয়েছে বিতর্ক। টিকা ইস্যু নিয়ে আদালতের একাধিক প্রশ্নের মুখে কেন্দ্র। রাজ্য ও কেন্দ্রের ক্ষেত্রে টিকার দামে বৈষম্য কেন? কেনইবা কেন্দ্র নিজে দেশবাসীর জন্য ১০০ শতাংশ টিকা না কিনছে না? একইসঙ্গে কোন রাজ্য আগে টিকা পাবে আর কোন রাজ্য পরে তা কিসের ভিত্তিতে ঠিক করছে কেন্দ্র? সেই জবাবও তলব করেছে আদালত। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে বেসামাল দেশ। এমন পরিস্থিতিতে টিকা, অক্সিজেন, জীবনদায়ী ওষুধ সহ একাধিক ক্ষেত্রে চূড়ান্ত অব্যবস্থা নিয়ে আগেই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা দায়ের করে সুপ্রিম কোর্ট। সেই মামলাতেই করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আদালতের একাধিক চোখা প্রশ্নবাণের মুখে মোদী সরকার। আদালতের মতে, টিকাকরণ প্রক্রিয়া নিয়ে চুড়ান্ত অব্যবস্থা চলছে। বণ্টন থেকে টিকার দাম পুরো মাত্রায় বৈষম্যে ভরা। এমন কী টিকা কেনার প্রক্রিয়াতেও রয়েছে ধোঁয়াশা। এদিন বিচারপতি রবীন্দ্র ভাট কেন্দ্রের কাছে জানতে চান, অন্যান্য দেশ অ্যাস্ট্রাজেনিকার টিকা যেখানে অনেক কম দামে পাচ্ছে সেখানে ভারতে তা এত দাম হওয়ার কারণ কী? একইসঙ্গে তিনি এও জানতে চেয়েছেন, একই টিকা কেন্দ্র ১৫০টাকায় পেলে রাজ্যকে কেন তাঁর জন্য ৩০০-৪০০ টাকা খরচ করতে হবে!