দেশের সময় , বাগদা: শনিবার সন্ধ্যায় ‘বন্ধু বিয়োগ’-এর যন্ত্রণা তার সঙ্গে একটা চাপা কষ্টে একদম চুপ করে গিয়েছিল বছর চারেকের অনন্যা। পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সদস্যের যাবতীয় আব্দারের ঠিকানা ছিল তাঁর প্রিয় বড়মা। সম্পর্কে বাবার ঠাকুমা। তবে ঠিক যেন বন্ধুর মতো ছিল ওরা দু’জনে।
প্রিয় বড়মার মৃতদেহ নিয়ে শ্মশানের উদ্দেশে রওনা হওয়ার কিছুক্ষণ বাদেই বিষয়টি নজরে আসে অনন্যার অভিভাবকদের। বাড়ির সকলেই শ্মশানে যাবেন তাহলে এই অবস্থায় বাড়িতে একা থাকবে কীভাবে অনন্যা! বাধ্য হয়েই ঠাকুমার শেষকৃত্যে তাকে সামিল করেছিলেন তার বাবা। আর তাতেই ঘটল অঘটন। নদিয়ার হাঁসখালিতে ভয়ানক গাড়ি দুর্ঘটনায় বাবা-মায়ের সঙ্গে প্রাণ গেল অনন্যারও।
বাগদা থানা এলাকার মুহুরি পরিবারের বয়জেষ্ঠ্য সদস্যার মৃত্যুতে শোকার্ত ছিল ওই পরিবারের সকলেই৷ নবতিপর সদস্য শিবানী মুহুরির (৯২) শেষকৃত্যে সামিল হয়েছিলেন প্রায় সকল সদস্যরাই। এমনকি বাদ পড়েনি চার বছরের অনন্যাও । আর সেই শেষকৃত্যে মর্মান্তিক পরিণতি হল। ভয়াবহ পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হল মুহুরি পরিবারের দশ সদস্যের।
শ্মশানযাত্রায় সামিল না হওয়ায় বাড়িতেই ছিলেন বৃদ্ধার এক নাতনি দীপালি বিশ্বাস। তাঁর কথায়, ‘ঠাকুমার মৃত্যুর পর তাঁর সৎকারের জন্য পরিবারের সকলেই শ্মশানের উদ্দেশ্যে রওনা হন রাত পৌনে ১০টা নাগাদ। আমরা রাত দেড়টা নাগাদ আচমকাই একটি ফোন পাই। জানতে পারি পথ দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে আমাদের পরিবারের গাড়িটি। তখনও ভাবতে পারিনি এমন দূর্ঘটনা ঘটেগেছে , পরিবারের অনেকের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু, ততক্ষণে সব শেষ। জানতে পারি ছোট্ট অনন্যাও আর বেঁচে নেই। তাঁর মা-বাবা অর্থাৎ আমার দাদা-বৌদিরও ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়েছে।
শবযাত্রীদের ওই দলটির সঙ্গে আলাদা গাড়িতে ছিলেন ন পারমাদন এলাকার এক বাসিন্দা পিন্টু হালদার। দুর্ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে পিন্টু বলেন, ‘‘দেহ এখান থেকে নবদ্বীপ শ্মশানের উদ্দেশে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। চিত্রশালী এলাকায় দুর্ঘটনা ঘটে। দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাকের পিছনে ধাক্কা মারে গাড়ি। ওখানে ১৪-১৫ জন মারা যান। হাসপাতালেও ৪-৫ জন মারা যান। ওই মুহুরি বাড়ির ১০ জন মারা গিয়েছেন। তার মধ্যে এক শিশুও রয়েছে।’’
শবযাত্রীদের ওই দলটিতে থাকা মুহুরি পরিবারের অন্তত ১০ জন মারা গিয়েছেন। নিহত হয়েছেন প্রয়াত শিবানীর মেজ ছেলে বৃন্দাবন মুহুরি (৬০), তাঁর দুই মেয়ে, ভাইয়ের স্ত্রী জয়ন্তী মুহুরি (৫০), পুত্রবধূ অনিতা মুহুরি (২২), মেয়ে মুনমুন মুহুরি (২১), নাতনি খুশি (৪) এবং আরও কয়েক জন আত্মীয়। এ ছাড়া বিজয় মণ্ডল (৬৫), হাজারি বিশ্বাস (৮৫), সুকুমার বিশ্বাস (৫২), গোপাল সরকার (৬৩), অমর বিশ্বাস (৫০) ও অমলেন্দু বিশ্বাস (৪৭) নামে দুই ভাই, শ্যাম বিশ্বাস (৫৫)-সহ কয়েক জন প্রতিবেশীরও মৃত্যু হয়েছে ওই দুর্ঘটনায়।
মূলত চাষাবাদই পেশা মুহুরি পরিবারের। তবে কর্মসূত্রে ওই পরিবারের কয়েক জন বিদেশেও থাকেন। এলাকায় অভিজাত পরিবার হিসাবেই পরিচিতি। দুর্ঘটনার খবর আসতেই ভিড় জমতে শুরু করে মুহুরি বাড়ির সামনে। একসঙ্গে এত জনের মৃত্যু খবরে গোটা পাড়া এখন থমথমে। শনিবার রাতের ঘটনার জেরে শোকের ছায়া নেমে এসেছে পারমাদন এলাকায়।
আহত এক যাত্রী বলেছেন, ‘‘রাস্তা খারাপ ছিল। কুয়াশাও ছিল। তার মধ্যেই জোরে গাড়ি চলছিল। হাঁসখালির কাছে এসে পাথরবোঝাই লরিতে ধাক্কা মারে আমাদের গাড়ি।’’ দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগও তুলেছেন মৃত ব্যক্তিদের পরিবারের লোকেরা। ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে হাঁসখালি থানার পুলিশ।
হাঁসখালি থানার SP জানিয়েছেন, বেপরোয়া গতিবেগের জন্যই এই দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। এদিকে, চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ তুলেছে মৃতের আত্মীয়রা।
এই ঘটনায় শোকপ্রকাশ করে টুইট করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
Heartbroken to hear about the road accident in Nadia.
— Mamata Banerjee (@MamataOfficial) November 28, 2021
I offer my deepest condolences to the bereaved families and pray for the speedy recovery of those who were injured.
May God give them the strength to get past this difficult time. (1/2)
টুইট করে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, নদিয়ার পথ দুর্ঘটনার কথা শুনে আমি মর্মাহত। নিহতদের পরিবারের প্রতি আমার গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। যাঁরা আহত হয়েছেন তাঁদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করছি। ঈশ্বর তাঁদের এই কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার শক্তি দিন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গ সরকার দুর্ঘটনা কবলিতদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। যা দরকার, সরকার তাই করবে। দুঃখের সময় সরকার তাঁদের পাশে আছে। সেইমত রবিবার সন্ধ্যায় রাজ্যের বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বাগদার পারমাদন গ্রামের দুর্ঘটনাগ্রস্থ প্রতি পরিবারের হাতে দু’লক্ষ টাকার চেক তুলেদেন।এদিন উপস্থিত ছিলেন বাগদার বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস এবং ডিএম সহ স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব৷
নদিয়ার পথ দুর্ঘটনায় মৃতের পরিবারকে অনুদানের কথা ঘোষণা করেছেন প্রধামন্ত্রী । মৃতের পরিবাররে প্রতি সমবেদনা জানিয়ে ‘দুর্ঘটনায় আহতরা দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুক’, বলে টুইট করেছেন মোদী।
PM Narendra Modi has announced an ex-gratia of Rs 2 lakhs each from PMNRF for the next of kin of those who have lost their lives due to the road accident in Nadia, West Bengal. Rs 50,000 would be given to the injured: PMO pic.twitter.com/dDwQAdCuu2
— ANI (@ANI) November 28, 2021
প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেছেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের নদিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের নিকট-আত্মীয়কে প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় ত্রাণ তহবিল থেকে এককালীন ২ লক্ষ টাকা অনুদান দেওয়া হবে। দুর্ঘটনায় আহতদের ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে।’ ভয়াবহ এই সড় দুর্গটনায় আগেই তিনি শোকপ্রকাশ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গের নদিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনায় আমি অত্যন্ত মর্মাহত। মৃতের পরিবারকে সমবেদনা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। দুর্ঘটনায় আহতরা দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুক বলে বার্তা মোদীর।
এদিকে, শোকজ্ঞাপন করে মুখ্যমন্ত্রীকে খোঁচা দিয়ে রাজ্যপাল ট্যুইটে লেখেন, মৃত ও আহতদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর পাশাপাশি পথ নিরাপত্তা নিয়ে ভাবা দরকার।
Deeply pained at reported death of 18 people and 5 others injured in Nadia District after the vehicle they were travelling in collided with a truck parked on the side of road.
— Governor West Bengal Jagdeep Dhankhar (@jdhankhar1) November 28, 2021
Expect all efforts @MamataOfficial to the family of deceased and injured. Need to promote Road Safety.
নদিয়ার ঘটনা নিয়ে শোক প্রকাশ করেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। অমিত শাহ ট্যুইটে বলেন, পশ্চিমবঙ্গের নদিয়ায় পথ দুর্ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো মানুষদের প্রতি সমবেদনা রইল। এই কঠিন পরিস্থিতিতে ঈশ্বর ওঁদের সহায় হোন। আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি।
পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলায় ঘটে যাওয়া পথ দুর্ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। এই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো মানুষদের প্রতি আমার সমবেদনা রইল। ঈশ্বর ওনাদের এই কঠিন পরিস্থিতিতে সহায় হোন। আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি।
— Amit Shah (@AmitShah) November 28, 2021
হাঁসখালি দুর্ঘটনায় শোকপ্রকাশ করেও আক্রমণ শুভেন্দু অধিকারীর। বিরোধী দলনেতা ট্যুইটে লেখেন, কলকাতা পুরসভার নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত পরিবহণমন্ত্রী। প্রশ্ন হল, কত দুর্ঘটনা রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘুম ভাঙাবে? কত দুর্ঘটনা হলে তিনি বুঝবেন যে জেলার পরিবহণ দফতরে কর্মীর সংখ্যা কম, কাজ চালাচ্ছে প্রশিক্ষণহীন সিভিক পুলিশ। যাদের প্রথম কাজ, রাস্তায় গাড়ি থেকে টাকা তোলা।