দীনেশ এক বছর আগেই তৃণমূল ছাড়তে চেয়েছিলেন দাবি বিজয়বর্গীয়র, ভোটের আগে তৃণমূল কি এতে বড় ধাক্কা খেল?

0
2168

দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ তৃণমূল ছাড়ার জন্য এক বছর আগে থেকে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন দীনেশ ত্রিবেদী ?এমনই চাঞ্চল্যকর দাবি করেছেন রাজ্য় বিজেপি-র কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক কৈলাশ বিজয়বর্গীয়। শুক্রবার দীনেশের ইস্তফার পর বিজয়বর্গীয় দাবি করেন, তৃণমূলে তিনি কাজ করতে পারছেন না বলে এক বছর আগেই নাকি তাঁকে জানান ব্যারাকপুরের প্রাক্তন সাংসদ। এরপরেই আক্ষেপের সুরে কৈলাশ বলেন, ‘দীনেশ ত্রিবেদী দল ছাড়তে বড্ড দেরি করে ফেলেছেন।‘ যদিও বিজেপি-তে আসতে চাইলে দরজা খোলা বলেও জানিয়েছেন তিনি।

উল্লেখ্য, বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক আগে রাজ্য়সভায় দাঁড়িয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন দীনেশ ত্রিবেদী। এদিন রাজ্যসভায় দীনেশ ত্রিবেদী বলেন, ‘আমি আজ রাজ্যসভা থেকে ইস্তফা দিচ্ছি। আমার রাজ্যে অশান্তি হচ্ছে। আমরা সেখানে কিছু বলতে পারি না। কাজ করা সম্ভব হচ্ছিল না। দলের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। দলীয় নেতৃত্ব আমাকে এখানে পাঠিয়েছে। আমার দমবন্ধ হয়ে আসছিল। রাজ্যে হিংসা নিয়ে কিছু করতে পারছিলাম না। আমার অন্তরাত্মা বলল, এখানে বসে যখন কিছুই করতে পারছি না তখন ইস্তফাই দেওয়া উচিত। বাংলার জন্য কাজ করতে থাকব।’

দীনেশ ত্রিবেদীর এই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে কৈলাশ বিজয়বর্গীয় বলেন, ‘সৎ ব্যক্তিদের তৃণমূলে কোনও জায়গা নেই। তৃণমূল যাচ্ছে এবং বিজেপি আসছে তা স্পষ্ট।‘ এদিকে এই প্রসঙ্গে বিজেপি-র রাজ্য় সভাপতি দিলীপ ঘোষ জানান, ‘ভালো মানুষ, খারাপ দলে গিয়ে ফেঁসে গিয়েছিলেন। বিজেপি-তে আসতে চাইলে স্বাগত।‘

পাশাপাশি এদিন বনগাঁ উত্তরের বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস প্রসঙ্গে দিলীপ ঘোষ জানান, তিনি দলবদল করছেন না। তাঁর কথায়, ‘এই সময় অন্য দল ছেড়ে সকলে বিজেপি-তে যোগদান করতে চাইছে। কেউ বিজেপি ছেড়ে যাবে না।‘

প্রসঙ্গত, সোমবার বিধানসভার শেষ দিনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে দলবদলের জল্পনা উস্কে দিয়েছিলেন বনগাঁ উত্তরের বিজেপি-র বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস। এর মধ্যে বিশ্বজিতের বাড়িতেও পুলিশি নিরাপত্তার প্রস্তাব যাওয়ায় জল্পনা বেড়েছিল। কিন্তু, এই নেতা আপাতত দলেই থাকছেন বলে জানান দিলীপ ঘোষ।

রাজ্যসভায় মমতার প্রথম সাংসদ দীনেশ কেমন ছিল বিগত দিনগুলি:

তৃণমূলের জন্মের গোড়ার দিকের কথা। সম্ভবত সেটা ১৯৯৮ সাল। সাহারার বিমানে কলকাতা থেকে ২৫ জন তৃণমূল বিধায়ক দিল্লি গিয়েছিলেন মিটিং করতে। দিদির সঙ্গে আগেই মিটিং হয়ে গিয়েছিল তাঁর। সেই প্রথম দলের বাকিদের সঙ্গে মিটিং হয়েছিল গুজরাতি ভদ্রলোকের। নাম দীনেশ ত্রিবেদী। রাজনীতিক। তবে ব্যবসাও রয়েছে বড়।
তার পর থেকে লম্বা একটা সময় দিল্লিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লোক বলতে দীনেশ ত্রিবেদীকেই চিনতেন অনেকে। তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পর থেকেই দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন দীনেশ। বাজপেয়ী জমানায় বিজেপি তৃণমূলের বোঝাপড়ার অন্যতম সেতুবন্ধও ছিলেন তিনি। তা ছাড়া অনেকে বলেন, ঠেকা-বেঠেকায় দলের মধুসূদন দাদাও ছিলেন দীনেশ ত্রিবেদী।

এ ছাড়াও একটা বড় মাইলফলক রয়েছে। তা হল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তথা তৃণমূল কংগ্রেসের প্রথম রাজ্যসভা সাংসদ ছিলেন দীনেশ ত্রিবেদী। ২০০২ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত দীনেশ রাজ্যসভায় তৃণমূল সাংসদ ছিলেন। পরে ২০০৯ সালে ব্যারাকপুর থেকে লোকসভা ভোটে জিতেছিলেন।

শুক্রবার সেই দীনেশ ত্রিবেদীই রাজ্যসভায় দাঁড়িয়ে তাঁর অন্তরাত্মার কথা বলেছেন। পষ্টাপষ্টি জানিয়েছেন, তৃণমূলে তাঁর দম বন্ধ হয়ে আসছে। বাংলায় যে রাজনৈতিক সন্ত্রাস চলছে তাতে তিনি ভারাক্রান্ত। আর নিতে পারছেন না। তাই রাজ্যসভা থেকে ইস্তফা দিচ্ছেন।

রাজ্যসভায় এখনও সাড়ে পাঁচ বছর মেয়াদ বাকি রয়েছে দীনেশের। প্রশ্ন হল, এরকম সিদ্ধান্ত তিনি কেন নিলেন? বিজেপির সঙ্গে কি তাঁর কোনও বোঝাপড়া হয়েছে? সেই সঙ্গে এও কৌতূহলের বিষয় যে, ভোটের আগে তৃণমূল কি এতে বড় ধাক্কা খেল?
পরের প্রশ্নে উত্তর সন্ধান করা যাক আগে। দীনেশের ইস্তফায় তৃণমূল আদৌ ধাক্কা খেল কিনা তার উত্তর সন্ধানে একটু পিছনের দিকে তাকাতেই হয়। দিল্লির রাজনীতির পর্যবেক্ষকরা বলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুঃসময়ের সঙ্গী ছিলেন দীনেশ ত্রিবেদী। ২০০১ সালে বিধানসভা ভোটে পরাস্ত হওয়ার পর দিল্লিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একপ্রকার নিঃসঙ্গ ছিলেন। পরে বিজেপির সঙ্গে বোঝাপড়া করে কেন্দ্রে দফতর বিহীন মন্ত্রী হয়েছিলেন।

সে সময়ে মমতার যেন অখণ্ড অবসর। সি-ফোরের ফ্ল্যাটে থাকতেন। কিন্তু কোনও কাজ নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে রঙ, তুলি, ক্যানভাস কিনে এনে দিতেন দীনেশ ত্রিবেদী। তার আগে পর্যন্ত সিন্থেসাইজার বাজিয়ে গান করা বা শুধু সেই যন্ত্র বাজানো ছিল মমতার ফেভারিট পাস টাইম। বাজপেয়ী জমানায় মমতা যেদিন দ্বিতীয়বার শপথ গ্রহণ করে ফ্ল্যাটে ফেরেন, দেখা যায় রঙ-তুলি নিয়ে বসে পড়েছেন তিনি। গোটা বৈঠক খানায় ছড়ানো ক্যানভাসে গণেশের ছবি। গণেশের কানে ছিল জবাফুল। মমতা বলতেন, ওটা দিয়েই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড দেখছেন গণেশ।

সে যাক। ছবি আঁকায় উৎসাহ দেওয়ার নেপথ্যে নাকি অন্যতম ব্যক্তিই ছিলেন দীনেশ। তবে দীনেশ ঘনিষ্ঠদের মতে, মমতা তথা তৃণমূলের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব তৈরি হতে শুরু করেছিল ২০১১ সাল থেকেই। সেই সময়ে রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী পদের দায়িত্ব নেওয়াই রেলমন্ত্রীর পদ ছাড়েন মমতা। সেই পদে দীনেশকে বসিয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী।


দীনেশ এমবিএ পাশ। জীবনের শুরুতে দু’বছর শিকাগোর একটি বহুজাতিক সংস্থায় কাজ করেছিলেন। সংস্কারের ভাবনা তাঁর মাথায় ছিলই। রেলমন্ত্রী পদের দায়িত্ব নিয়ে দীনেশ ত্রিবেদী তাঁর প্রথম রেল বাজেটেই ঢালাও সংস্কারের পথে হাঁটেন। মমতা নাকি তার বিন্দু-বিসর্গও আগাম জানতেন না। দীনেশ বাজেট পেশ করার পরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং যখন প্রশংসায় মুখর, তখন এদিকে নেত্রী রেগে আগুন। মমতার মুড বুঝে রেলমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দেন দীনেশ।

শুক্রবার দীনেশ জানিয়েছেন, সেদিনও অন্তরাত্মার ডাক শুনতে পেয়েছিলেন তিনি। জানা গিয়েছিল, চোদ্দো সালের লোকসভা ভোটে দীনেশকে নাকি দলে টানতে চেয়েছিল বিজেপি। এমনিতে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহর সঙ্গে তাঁর পুরনো যোগাযোগ। তবে সেই প্রস্তাব থাকলেও দিদিকে ছেড়ে তিনি যাননি। কিন্তু তৃণমূলে যে তিনি মানিয়ে চলতে পারছেন না তাও স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছিল।


২০১৬ সালে বিধানসভা ভোটের মধ্যেই দীনেশ বলেছিলেন, আমি দলের সভাপতি পদে থাকলে অপরাধের ঘটনায় অভিযুক্তদের টিকিটই দিতাম না। তাতেও অনেকের রাগ হয়। ভোটের ফল প্রকাশের পরে দীনেশকে ঠারেঠোরে বার্তাও দেওয়া হয়। তার পর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিক্ততা কমে আসে। গত সেপ্টেম্বর মাসে দীনেশকে রাজ্যসভায় নির্বাচিত করে তৃণমূল। কিন্তু শুধু সেটুকুতেই যে প্রাক্তন রেলমন্ত্রী খুশি বা সন্তুষ্ট নন তা শুক্রবার স্পষ্ট হয়ে গেল।


অনেকের মতে, বাংলায় দীনেশের যে হেতু সে অর্থে কোনও জনভিত্তি নেই এবং মমতার আলোয় আলোকিত ছিলেন, তাই তাঁর ইস্তফায় বিশেষ প্রভাব পড়বে না। তবে এর ভিন্ন মতও রয়েছে। যাঁরা মনে করছেন, ব্যাপারটা উল্টো ভাবেও দেখা যায়। তৃণমূলের বর্তমান ব্যবস্থায়, দলের প্রথম দিনের একজন নেতা, দুঃসময়ের মধুসূদন দাদা আবেগের সম্পর্ক ছিঁড়ে দিলেন। তাঁদের কথায়, এমন নয় যে প্রতিটা বুলেটই প্রাণঘাতী হবে। কিন্তু এটা অনস্বীকার্য যে তা কিছু না কিছু ক্ষত তৈরি করে দিয়ে যায়।

রাজ্যসভায় দীনেশ ত্রিবেদীর আরও সাড়ে পাঁচ বছর মেয়াদ বাকি ছিল। সেই সব পরোয়া না করে দীনেশ ত্রিবেদী ইস্তফা দেওয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই নানা কৌতূহল ও জল্পনা তৈরি হয়েছে। অনেকে ধরেই নিচ্ছেন যে বিজেপির সঙ্গে তাঁর বোঝাপড়া হয়েছে। যেহেতু দীনেশ রাজ্যসভায় এদিনের বক্তৃতায় জন্মভূমির কথা বলেছেন, সে কারণে অনেকে আবার মনে করছেন, গুজরাতের রাজনীতিতে সক্রিয় হতে পারেন তিনি। তবে সূত্রের মতে, একুশের বিধানসভা ভোটে বাংলার রাজনীতিতেই সক্রিয় দেখা যাবে দীনেশকে। তাঁকে ব্যবহার করেই তৃণমূলের অস্বস্তি বাড়াতে চাইবে বিজেপি।
এক প্রাক্তন বাম সাংসদের কথায়, গুজরাতিরা ব্যবসায় কাঁচা হয় না। নির্ঘাত লাভজনক চুক্তি করে তবেই পুরনো চুক্তি ভাঙা হয়েছে।

Previous article৩৩৩ দিন পর অনলাইন ক্লাস ছেড়ে ফের চেনা ক্লাসরুমে শুরু পড়াশোনা, খুশি পড়ুয়ারা
Next article‌স্বেচ্ছা নির্বাসন’‌ ছেড়ে রথে উঠলেন রূপা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here