‘তালের বড়া খেয়ে নন্দ নাচিতে লাগিল’, গ্রাম বাংলার এই গান আজ আমাদের মুখে না থাকলেও স্মৃতিতে রয়ে গেছে; ঠিক সেরকমই নন্দের সেই তালের বড়াও আজ স্থান পেয়েছে আমাদের স্মৃতিতে৷
একসময় বাঙালির ঘরে ঘরে নন্দের জন্মোৎসবের সময় থেকেই শুরু হয়ে যেত তালের বড়া বানানোর প্রস্তুতি; আজকের টেকস্যাভি বাঙালি সেসব তো দেখেই নি, আর যারা দেখেছে তাদেরই আজ স্মৃতি রোমন্থন করতে হয় ‘মা ঠাকুমার হাতের তালের বড়ার’।
বাঙালির জন্মাষ্টমী অথবা নন্দোৎসব উপলক্ষ্যে আজ কিছু কিছু বাড়িতে এই দিনে নন্দের প্রিয় তালের বড়া প্রস্তুত হলেও, মূলত: এর স্থান হয়েছে পাড়ার মিষ্টির দোকানে যেন বাঙালির নিয়ম রক্ষার লড়াইয়ের খাতিরে; কিন্তু বাড়িতে নিজে হাতে এই তালের বড়া তৈরী ও ঐতিহ্য বজায় রাখার যে আনন্দ এবং তার যে স্বাদ ও গন্ধ তা কিন্তু খাদ্যরসিক বাঙালির ওই মিষ্টির দোকানের তালের বড়ায় রসনা তৃপ্তি মোটেই হবে না। পিজা, বার্গার, প্যাটিস, ফ্রিটাটা অথবা গার্লিক ব্রেড বাঙালি আজ অনায়াসেই বানিয়ে ফেলে কিন্তু হারিয়ে যাওয়া এই তালের বড়া আর তার ঐতিহ্য আবার যদি, শুধু গ্রাম বাংলা নয় শহুরে বাঙালির ঘরে ফিরিয়ে আনা যায় তাহলে কেমন হয়? আর সেই জন্যই এবারের দেশের রান্নাঘরে রইলো তালের তৈরী বেশ কিছু হারিয়ে যাওয়া রেসিপি৷
তালের বিভিন্ন পদ বানাতে গেলে সবার আগে বাজার থেকে তাল কিনে এনে তার মোটা খোসা বা খোলা ছাড়িয়ে নিতে হবে। এরপর খোলা ছাড়ানো তাল বেতের মোটা ঝুড়িতে ঘষে তালের মারি বা ক্বাত বের করে নিতে হবে; যেভাবে আমরা পিয়াঁজ কুরুনীতে পিয়াঁজ ঘষে তার কি বের করি৷ এরপর তালের এই ক্বাত কখনো চালের গুড়ি আবার কখনো ময়দা কিংবা আটার সাথে মিশিয়ে বিভিন্ন পদ বানাতে হবে৷ তালের এই ক্বাত দিয়ে তালের ফুলুরি, পিঠে, সেঁকা বড়া, পোড়া পিঠে, লুচি, পরোটা, তালের ক্ষীর ইত্যাদি বিভিন্ন পদ্ধতিতে বানানো যায়৷
তালের ফুলুরি –
এইভাবে তালের সব ফুলুরি ভেজে নিতে হবে।
পদ্ধতি: নারকেল কোৱা ও চিনি দিয়ে নারকেলের পুর বানিয়ে রাখতে হবে৷
এবার তালের মাড়িকে গরম করে নিতে হবে৷ একটি বড়পাত্রে চালের গুড়ি নিয়ে এরমধ্যে গরম করা তালের মাড়িঢেলে খুব তাড়াতাড়ি চালের গুড়ি ও তাল মেখে নিতে হবে, তাল ঠান্ডা হওয়ার আগে; মাখা হলে এটি একটি ময়দারদেলার মতন দেখতে হবে।এর থেকে গোল লেচি কেটে নিতেহবে৷
লেচি গুলোকে আঙুলের সাহায্যে গোল করে পিঠেরআকারে গড়ে এর ভিতর নারকেলের পুর দিয়ে মুখ ভালোভাবে বন্ধ করে দিতে হবে৷একই ভাবে সবকটি পিঠে গড়েনিতে হবে৷
হাঁড়িতে জল গরম করে জল ফুটতে আরম্ভ করলে, একটি তেল মাখানো স্টিলের ঝাঁঝরির মধ্যে পিঠে গুলোসাজিয়ে সেটিকে হাঁড়ির ওপর বসিয়ে চাপা দিতে হবে (যেপদ্ধতিতে মোমো তৈরী হয়)।
মিনিট দশেক বাদে ভাপা হয়েগেলে নামিয়ে পিঠে গুলো অন্য পাত্রে সাজিয়ে ঠান্ডা হলেপরিবেশন করতে হবে৷
তালের সেঁকা বড়া–
উপকরণ: তালের মাড়ি ১ কাপ, চালের গুঁড়ি ২ কাপ, ১ কাপচিনি, নুন ১ চা চামচ, ২ বড় চামচ সর্ষের তেল৷
পদ্ধতি: একটিপাত্রে গরম করা তালের মাড়ি দিয়ে চালের গুঁড়ি নুন ও চিনিমিশিয়ে ভালো ভালো ভাবে মেখে নিতে হবে৷
লেচি কেটে বড়ারআকারে গড়তে হবে৷ যাওয়া অথবা ফ্রাই প্যান তেল বুলিয়েগরম করতে দিয়ে হবে; এবার বড়া গুলো টাওয়ার মধ্যে দিয়েঅল্প তেল বুলিয়ে লাল করে সেঁকে নিতে হবে।বিকেলে চায়েরসাথে গরম গরম পরিবেশন করা যেতে পারে৷
তালের পোড়া পিঠে –
উপকরণ: তালের মাড়ি ১ কাপ, দেড় কাপ চালের গুঁড়ি, ১ চা চামচ নুন, গুঁড়ো করা চিনি হাফ কাপ, নারকেল কোৱা হাফ কাপ, বড় কলাপাতা ১ টা
পদ্ধতি: কলাপাতা ধুয়ে নিতে হবে।একটি বড় পাত্রে তালের মাড়ি, চালের গুঁড়ি, নুন, চিনি ও নারকেল কোৱা ভালো ভাবে মিশিয়ে আটা বা ময়দা মাখার মতন মেখে একটি দলা তৈরী করতে হবে৷এই দলাটিকে চৌকো অথবা গোল আকার দিয়ে কলাপাতায় ভালো ভাবে মুড়ে সুতো দিয়ে বেঁধে দিয়ে হবে। এবার এটিকে মাইক্রোওয়েভে ১৫-২০ মিনিট বেক করতে হবে।কলাপাতার রং কালো হয়ে এলে বের করে নিতে হবে। একটু ঠান্ডা ঠান্ডা হলে মন্ডটি কলাপাতা থেকে বের করে পিস্ পিস্ করে কেটে পরিবেশন করতে হবে৷
তালের লুচি –
উপকরণ : তালের মাড়ি দেড় কাপ, ময়দা ৩ কাপ, তেল ১ বড় চামচ, নুন ১ চা চামচ, ৫০০ গ্রাম সর্ষের তেল।পদ্ধতি: ময়দায় ময়ান দিয়ে নিতে হবে৷ এরপর তালের মাড়ি দিয়ে ভালো করে ময়দা মেখে নিতে হবে। লেচি কেটে লুচির আকারে বেলে তেলে ভাজতে হবে৷ তালের আলুর দম অথবা সাদা আলুর তরকারির সাথে গরম গরম পরিবেশন যেতে পারে৷
এই একই পদ্ধতিতে তালের রুটি ও তালের পরোটাও বানানো যেতে পারে৷ সেক্ষেত্রে তেলের পরিমান খুবই সামান্য হবে৷
তালের ক্ষীর –
উপকরণ: তালের মাড়ি বড় ১ বাটি, ১ কাপ চিনি, নারকেল কোৱা ১ কাপ, দুধ ১ কাপ, এলাচ ২টি ভেঙে টুকরো করা, তেজপাতা ১ টি৷
পদ্ধতি : তালের মাড়ি কড়ায় অথবা ফ্রাই প্যানে গরম করতে হবে, ফুটতে শুরু করলে এর মধ্যে চিনি, দুধ, নারকেল কোৱা ও তেজ পাতা দিয়ে আঁচ কমিয়ে ভালো করে মেশাতে হবে, যেন তোলা ধরে না যায়৷বেশ ঘন ক্রীমের মতন হয়ে এলে এলাচ গুঁড়ো ছড়িয়ে নামাতে হবে। ঠান্ডা হলে কিছুটা নারকেল কোৱা দিয়ে গার্নিশ করে পরিবেশন করতে হবে। এটি একটি ভালো ডেসার্ট৷ রইল ভিডিও:
রেসিপি সৌজন্যে: সরমা সাউ ও আরতি সাউ ৷