চারিদিকে পাহাড়। জঙ্গলের মধ্যে এই রিসর্টটা। সামনে দিয়ে পাকা রাস্তা উঁচু নিচু হতে হতে এঁকেবেঁকে চলে গেছে। পেরোলেই জঙ্গল নিয়ে পাহাড় উঠে গেছে। পিছন দিকে এঁকেবেঁকে চলে গেছে একটা পাহাড়ি ঝোরা। সারাদিন সারারাত কুলকুল কুলকুল। নদী পেরোলেই পাহাড়। গাছপালা গায়ে মেখে আকাশমুখি।
রিসর্টটার নাম অরণ্যবাস। সত্যিই অরণ্যে বাস। চারিদিকে ফুল। একটা পাহাড়ের পরে প্রপার্টিটা। অনেকটা বড় জায়গা জুড়ে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পাথুরে কটেজগুলো। প্রচুর গাছ। ঝুরি ঝুরি আমলকি পেকে হলুদ হয়ে রয়েছে গাছে। মাটিতেও পড়ে রয়েছে প্রচুর। হেঁটে হেঁটে নেমে উঠে নিজের কটেজে যেতে গিয়ে ট্রাভেলার হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে। বাতাসভর্তি শিউলির মিষ্টি গন্ধ। সামনে দিয়ে পাহাড় হড়হড় করে নেমে গেছে, নিচে নদীর দিকে। ওপার থেকে পাহাড় ডিঙিয়ে একটা হাওয়া আসে বেশ। গাছপালায় শব্দ হয়।
এখানে পল্লব ম্যানেজার ছিল। পল্লব আমাদের বন্ধু। একবার রাজনগর থেকে মোটর সাইকেল নিয়ে আরাবল্লির পেটের মধ্যে দিয়ে পল্লবের কাছে হাজির হয়েছিলাম। অরণ্যবাসে। আমি আর জীবনদা। সে প্রায় তেরো চোদ্দ বছর আগে। এসে দেখলাম গহীন জঙ্গলের ছায়ায় ঢাকা এক অপূর্ব এথনিক লিভিং। পল্লব আমাকে দিয়ে ক্যুরিয়ারে পুঁইশাকের বীজ আনিয়েছিল। সেই বীজ থেকে হওয়া শাক খাওয়ালো সেবার। পল্লব মারা গেছে বেশ কিছুদিন হল। কিন্তু আমি আরাবল্লীতে আসলেই আমাকে অরণ্যবাসে টেনে নিয়ে যায় নিয়মিত। টেনে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয় কটেজের প্রকৃতিমুখী বড় বারান্দায়। নিচে দিয়ে মৃদুশব্দে বয়ে যায় ঝোরা। পার হলেই ফরেস্ট এরিয়া। গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় জল খেতে আসে তেন্দুয়া। আমাকে একা জংলি পাহাড়ের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায় পল্লব। আর আমি মোবাইলের সংযোগবিহীন এই অরণ্যবাসে ডিটক্সিকেটেড হতে থাকি।
কেউ ডাকে না। কোনও রিংটোন ভেসে আসে না। কোথাও টুং শব্দে ব্যাঙ্কের চেক ক্লিয়ার হবার মেসেজও ঢোকে না। কেউ ভিডিওকল করেনা। ফেসবুকে সেদিন কেউ ডিপি চেঞ্জ করেনা। সারা দিন রাত ডিটক্সিকেশন চলে। শরীর থেকে ক্লান্তি নেমে যায় কত! মন থেকে নেমে যায় সব বিষ... যখন এরকম মানুষ ছেড়ে মোবাইল ছেড়ে মানুষ একলা হয়ে যায়, তখনই সে নদীর কাছে গিয়ে বসে। গাছের গায়ে হাত বোলায়। প্রতিটা দূরবর্তী পাখির ডাক আলাদা আলাদা করে শুনতে পারে। প্রতিটা শব্দ কোন দিক থেকে আসছে, চোখ বন্ধ রেখে তাও নিঁখুত বলে দিতে পারে। কারণ মানুষ, তখন নিজের কাছে ফিরে আসে...