দীর্ঘদিন খবরের কাগজে কাজ করার সূত্রেই জানি, নামী সাংবাদিক থেকে বার্তা সম্পাদক, বিভাগীয় সম্পাদক অথবা আলোকচিত্র বিভাগের প্রধানদের অনেকেরই সাফল্যের পিছনে রয়েছে বহু মানুষের নীরব পরিশ্রম। তারা হলেন সেই কাগজেই কাজ করা ততটা নামডাক হয়নি এমন সহকর্মীরা। এরা কেউ এনে দিয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ খবরের টিপস বা সংবাদ। দিয়েছেন বিশ্লেষণের নতুন অ্যাঙ্গেল। জীবন বিপন্ন করে তুলেছেন চমকে দেওয়ার মত ছবি। এই নীরব কর্মীরা তাদের প্রাপ্য পান না বললেই চলে। অথচ তাদের পরিশ্রম, মেধা অবলীলাক্রমে আত্মসাৎ করে কিন্তু নাম কামিয়েছেন, মাইনে বাড়িয়েছেন, দখল করেছেন গুরুত্বপূর্ণ পদ, এমন কাগুজে বাঘদের অনেককেই আমি চিনি। কিন্তু খারাপ তখনই লাগে যখন দেখি সাফল্য পাওয়ার পর সহকর্মীদের বেমালুম ভুলে যেতে, পিছনে কলকাঠি নাড়তে, এমনকি চাকরি ছাড়তে বাধ্য করতেও। কলকাতার সংবাদপত্র জগতে এ ঘটনা বহুকাল ধরেই চলছে। করোনার দুঃসময়ে তা চরমে উঠেছে।
বেশ কিছুদিন ধরেই খোলা মাঠে কচুকাটা করার মত কোপ পড়ছে সাংবাদিক ও চিত্রসাংবাদিকদের রুটিরুজিতে। নির্বিচারে চলছে ছাঁটাই। ফ্রিল্যান্সার হিসেবে জীবন শুরু করে রীতিমত ২০-২৫ বছর ধরে দাপিয়ে সাংবাদিকতা করা সাংবাদিকদেরও চাকরি যাচ্ছে কোন নোটিশ ছাড়াই। তার কী অপরাধ তিনি জানেন না! দুঃখের কথা মালিকদের নির্দেশে এই অপকর্মটি করছেন একেবারে নামগোত্রহীন সাংবাদিক নামধারী কিছু বিবেকহীন জীব! তাদের ছেঁটে দেবার আগে একবারও ভাববার প্রয়োজন অনুভব করছেন না যে এই মানুষগুলি ক্যামেরা আর পেন ছাড়া আর কিছু জানেন না। এই বয়সে তারা অন্য কোথাও কাজ পাবেন এমন সম্ভাবনাও কম। তাহলে কোথায় যাবে এরা ? পরিবার পরিজন নিয়ে এদের আগামী দিনগুলো চলবে কিকরে ? চিত্রসাংবাদিকদের অবস্থা আরও বেশি খারাপ। এদের চাকরির নিরাপত্তা, বেতন, অন্যান্য সুযোগসুবিধা চিরকালই কম। ম্যানেজমেন্ট সর্বদাই এদের প্রতি উদাসীন। এরাই মালিকদের আক্রমণের সবচেয়ে বড় শিকার। এইসময়ও তাদের চাকরিই বেশি চলে যাচ্ছে।
আমরা সবাই জানি সাংবাদিকদের জীবনটাই ২৪*৭ খবরকে দান করা। তাদের কাজের যা ধরণ তাতে বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করার পরিস্থিতি তাদের কোনোদিন তৈরি হয়না। খবরের পিছনে ছুটতে ছুটতেই তাদের জীবন কেটে যায়। ফলে যারা মানুষের জীবনের আলো-অন্ধকার তুলে ধরেন তাদের ঘরের অন্ধকার ও হাহাকারের কথা কেউ জানতেও পারেন না। যে কারণে আজ নিজেদের বিপন্নতার কথা জানানোর মত কোন মানুষই তাদের পাশে নেই। আসলে সবাই ভাবেন কাগজে কাজ করে তো, ও ভালোই রোজগার করতো, চালিয়ে নিতে পারবে। আদতে কাহিনী কিছু অন্য, সত্যিই অন্য। তারা আজ চূড়ান্ত অবহেলিত।
অথচ এই নিয়ে কোথাও কোনো কথা নেই। এদের হয়ে সবথেকে বেশি আওয়াজ তোলা উচিত যাদের সেই ক্লাস সাংবাদিকদের উদাসীনতা দেখে অবাক হচ্ছি তাদেরই সহকর্মীদের প্রতি। কাজ হারানো কলিগদের এই চূড়ান্ত দুঃসময়ে তাদের হয়ে দু কলম লেখার মতো সময়, ইচ্ছা, বিবেক ওই নামিদামি সাংবাদিকদের কারও কাছে নেই। তারাও কিন্তু একসময় এদের থেকেই ছবি, খবর নিয়েই আজ চূড়ান্ত সফল। আজ তাদের জীবনযাপন বিলাসবহুল। অথচ তাদেরই সাথে কাজ করা এই অল্প মাইনের সহকর্মীদের এই দুর্দশায় তাদের পাশে দাঁড়ানো তো দূর তাদের জন্য একটু আওয়াজ তোলার পর্যন্ত মানসিকতা ওই উচ্চ শ্রেণীভুক্ত সাংবাদিকদের নেই।
যাদের পরিশ্রমের জোরে কাগুজে বাঘদের রমরমা তারা তাদের প্রাক্তন সহকর্মীদের বিপন্নতা নিয়ে নীরব নির্লিপ্ত। নিজেদের বামপন্থী, প্রগতিশীল বলে দাবি করেন অথচ আপনাদেরই পাশে বসা মানুষগুলো যেভাবে হঠাৎ ‘নেই’ হয়ে গেলেন তাদের কথা কি আপনাদের একটুও মনে পড়ে না?
আপনারা কি পারেননা একটু তাদের প্রতি সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিতে। আপনারা তো আজ স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত, কোনো অভাব নেই দৈনন্দিন জীবনে। এতো বৈভব আপনাদের এক একজনের যে কলকাতা ছাড়িয়ে অন্যান্য রাজ্যেও শুনি সম্পত্তির বহর, তাও বিচারবুদ্ধি কি আপনাদের বলছে না একটা ফান্ড করে ওদের একটু সাহায্যের ব্যবস্থা করা হোক। এটা কি খুব অসুবিধার হবে আপনাদের ক্ষেত্রে ? গত তিনমাস লকডাউনে আমি নিজে মানবিক পরিসেবা করতে গিয়ে বহু মানুষের সংযোগে এসে বুঝেছি আমি যদি খেতে পাই তাহলে ওদের জন্য একটু খাবারের ব্যবস্থা করাটা খুব একটা অসুবিধার নয়। শুধু একটু হাত বাড়িয়ে রাখার মানসিকতা থাকতে হবে।
কালকেই আমার পরিচিত একজন সাংবাদিক ফোন করেছিলো, যার নিজের কাজ তো গেছেই। সাথে ওর সাথে কাজকরা অনেকেরই গেছে। খুব হতাশ হয়ে আমায় বলছিলো, ” অশোকদা এই লকডাউনে পরিযায়ী শ্রমিকদের খবর করতে করতে আমরাও পরিযায়ী হয়ে যাবো বুঝতে পারিনি। এতো বছর ধরে এতো কাজ করে আজ এই বিপদ নেমে আসবে কোনোদিন ভাবিনি। তবে এই পেশায় উপরে উঠতে গেলে মেধা, বুদ্ধি, দূরদৃষ্টিই শেষ কথা বলেনা, ম্যানেজমেন্টের নজরে আসতে গেলে ওদের হয়ে ছাতা ধরাটাও খুব জরুরী। কিন্তু একটা জিনিস ভেবে অবাক হয়ে যাচ্ছি যে সাংবাদিকদের সঙ্গে এতবছর কাজ করলাম তাদের আমাদের প্রতি উদাসীনতা দেখে। তাদের দেখি সোশ্যাল মিডিয়ায়, ইউটিউবে নিজেদের জীবনের উত্তরণের গল্প বলতে। ফুল, পাতা, পাহাড়, জঙ্গল, শান্তিনিকেতন, চা-ওয়ালা, সম্পাদকের গুনগান করতে। মুক্তোঝড়ানো কলম আর ক্ষুরধার বক্তব্যের ছোঁয়ায় সেসব পাঠক, শ্রোতা, দর্শকদের কাছে বাহবা কুড়োচ্ছে। সময় শুধু নেই লেখার আমাদের জন্য সহানুভূতির দু লাইন। সময় শুধু নেই আমাদের হয়ে একটু গলা ফাটানোর। চাকরি গেছে বলে ওদের থেকে চাকরি বা কোনো সুযোগ সুবিধাও তো চাইনা আমরা। কিন্তু একবার ফোন করেও কি জিজ্ঞাসা করা যায়না রাতারাতি বেকার হয়ে গিয়ে আমরা কেমন আছি ?”
খুব দুঃখ হয়, কষ্ট হয়, রাগও হয় যখন এরা আমাকে ফোনে এইসব বলে। ভাবনা হয় আমার। কিন্তু আমার একার ভাবনায় এদের জন্য কিছু করা আমার সামর্থে নেই। তবে আমার সাংবাদিক জীবনের অভিজ্ঞতায় এটুকু বিশ্বাস করে বলতে পারি সাংবাদিক ও চিত্রসাংবাদিকরা সরকারি কাজে কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারবে। এদের বহুবছরের অভিজ্ঞতা সরকারকে সমৃদ্ধ করতে পারে। সরকারের এমন অনেক কাজ থাকে যেখানে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল ব্যক্তিদের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে তারা সেই দায়িত্ব সেভাবে পালন করতে না পেরে ছেড়ে দিয়েছেন। এমন কিছু কিছু জায়গায় সরকার মনে করলে এই সাংবাদিকদের সুযোগ দিতে পারেন। এটা করার সময় সেই চিত্রসাংবাদিক বা সাংবাদিকের অতীতের সরকার বিরোধিতার কথা মনে রাখলে চলবে না। তার পেশাদার দক্ষতাই এখানে বিচার্য। মনে রাখতে হবে খবরের কাগজের পেশাদারদের অনেক কাজের পিছনে ম্যানেজমেন্টের নির্দেশ থাকে। এরা আন্তরিক, পরিশ্রমী, দ্রুত কাজ করায় বিশ্বাসী। এদের মেধা ও কর্মদক্ষতা সরকারের কাছে খুবই উপযোগী হবে বলে আমার মনে হয়।
রাজ্য সরকার বহু ক্ষেত্রে নানা ধরণের উদ্ভাবনী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাজের এই ধারাটার ওপর বিশ্বাস আছে বলেই এই কথাগুলি বললাম। এতে বাঁচবে বহু পরিবার এবং মানব সম্পদেরও সঠিক ব্যবহার হবে।