
দেবন্বিতা চক্রবর্তী : বনগাঁ: দিন দিন কমছে খেঁজুর গাছের সংখ্যা। অভাব শিউলির। শীত কম পরায় রসের পরিমানও তুলনায় কম। বেশি খাটুনি এবং খরচতো রয়েছেই। আর এইসবের মিলিত ফল আসল নলেন গুড়ের পাটালির অভাব। এতরকম সমস্যার মধ্যেও বিশেষ পরিচিতদের আবদার মেনে এখনও প্রতি বছর কিছু পরিমান আসল নলেনের পাটালি তৈরি করে দেন বনগাঁর হাতেগোনা দুএকজন গুড় প্রস্তুতকারী।
নগরায়নের কারনে একদিকে যেমন একের পর এক গাছ কাটা চলছে, অন্যদিকে জ্বালানি হিসেবে উৎকৃষ্টি খেঁজুর গাছ মোটা দাম দিয়ে কিনে নিচ্ছেন ইটভাটা, টালিভাটার মালিকেরা। ফলে দিন দিন খেঁজুর গাছের সংখ্যা কমছে। তার উপর রয়েছে শিউলির (যিনি গাছ কাটেন) অভাব। এছাড়াও কড়া শীতের সময়কালও কমে গেছে। সব মিলিয়ে খেঁজুর গাছের থেকে সংগৃহীত রসের পরিমানও আগে থেকে কমে গেছে। অথচ খেঁজুর গুড়ের পাটালি, দানা বা ঝোলা গুড়ের চাহিদা সর্বকালেই রয়েছে। আর সেই চাহিদা মেটাতে গিয়ে ভেজাল দেবার প্রবনতা বাড়ছে। বনগাঁর নতুনগ্রাম এলাকার এক গুড় প্রস্তুতকারক কৃষক রাধেশ্যাম দাস জানালেন, 'রসের পরিমান দিন দিন এতোটাই কমে যাচ্ছে যে, তা জাল দিয়ে আসল গুড়ের পাটালি করা কঠিন হয়ে পরছে। অথচ বাজারের চাহিদা মেটাতে বিক্রেতারা প্রতিনিয়ত তাগাদা দেন। ফলে খেঁজুর রসের সঙ্গে চিনি মেশাতেই হয়। যেমন দাম, চিনির পরিমানও তেমন।' তিনি আরও জানান, 'অনেক জায়গায় শুনেছি, নলেন গুড়ের পাটালি তৈরির নামে আলু সেদ্ধ, রং আর সুগন্ধী মিশিয়ে পাটালি তৈরি করে তা খুব কম দামে বাজারে বিক্রি হয়। আমাদের এখানে এরকম কোনও অস্বাস্থ্যকর জিনিস ব্যবহার কার হয় না।' বিষয়টি প্রত্যক্ষ করতে সাতসকালে নতুনগ্রামে রাধেশ্যামবাবুর বাড়িতে হাজির হয়ে দেখা গেল, গাছ থেকে সদ্য পেরে নিয়ে আসা রসের হাঁড়ি উনুনে বসানো পাত্রে ঢেলে তা পাটকাঠির জ্বালানি দিয়ে জাল দিচ্ছেন তাঁর স্ত্রী। সঙ্গে পরিমান মতো চিনি মেশানো হলো। এরপর রং আনান জন্য চিনি পুড়িয়ে তারসঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়।
এইভাবে বেশ কিছুক্ষণ জাল দেবার পর সেই পাত্র নামিয়ে জীবানু নষ্ট করতে তাতে সামান্য চুন মিশিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে 'বিজ মারার' কাজ সারা হলো। এরপর মাটির ছোট ছোট পাত্রের উপর কাপড় বিছিয়ে একটু একটু করে ঢেলে দেওয়া হল সেই তরল গুড়। কিছুক্ষণ পরই তা জমে পাটালিতে পরিনত হল। এরপর তা পাত্রে তুলে পাইকারি বাজারে পাঠিয়ে দেওয়া হল। তবে তিনি জানান, প্রতিবারই পৌষের শেষে অথবা মাঘের শুরুতে যখন রসের পরিমান আরও বাড়বে, তখন পরিচিত কয়েকজনের জন্য শুধু খেঁজুর রস দিয়ে আসল গুড় তৈরি করতে হয়। তার খাটনি এবং দাম যেমন বেশি, পাশাপাশি স্বাদে–গন্ধেও তা অতুলনীয়।
———————————