দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ ২০১৫ সাল। ইরাকের মসুলের পর সিরিয়ার রাক্কাতেও তখন কোণঠাসা ইসলামিক স্টেট (আইএস)। লাগাতার বিমান হানা চলছে। ভয়ঙ্কর আকাশযুদ্ধে ছিন্নভিন্ন সিরিয়া। একটি অডিও বার্তায় আইএস জানায়, জর্ডন বাহিনীর বিমানহানায় প্রাণ গেছে মার্কিন মানবাধিকার কর্মীর। নাম কায়লা জেন মুলার। ২০১৩ সালে সিরিয়ার সীমান্ত থেকে যাঁকে অপহরণ করেছিল ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড দ্য লেভান্টের (ISIL)জঙ্গিরা। নিজের ডেরায় আটকে রেখে দিনের পর দিন ধর্ষণ করেছিল আইএস প্রধান আবু বকর আল-বাগদাদি। যৌনদাসী করে বারংবার হাত বদল হয়েছিল আইএসের ডেরায়। আইএস প্রধানের বিরুদ্ধে মার্কিন বাহিনীর এই অভিযান উৎসর্গ করা হয়েছে সেই তরুণীরই নামে।
বয়স তখন ২৬, হাসিখুশি, পরোপকারী কায়লা আচমকাই উধাও হয়ে যান
অ্যারিজোনার প্রেসকটের বাসিন্দা কায়লা মুলার নদার্ন অ্যারিজোনা ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক। তুখোড় ফল করা এই মেধাবী ছাত্রী কলেজে থাকতেই নানা সমাজ সেবামূলক কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। অ্যারিজোনার মানবাধিকার সংগঠনের হয়ে বিশ্বের নানা দেশে কাজ করেছেন কায়লা। ভারত ও তিব্বতে তাঁর অভিযান বেশি। মূলত ঘরহারা উদ্বাস্তুদের জন্য দীর্ঘদিন লড়াই চালিয়েছেন কায়লা। সিরিয়া ও আফ্রিকার আদিবাসীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য-চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়ে তাঁর ভূমিকা ছিল সক্রিয়।
২০১০ সাল। মধ্যপ্রাচ্যে নিজের টিম নিয়ে পৌঁছন কায়লা। তাঁর স্লোগান ছিল, “বোমা নয়, খাবার চাই, আশ্রয় চাই।” দক্ষিণ তুরস্কে সিরিয়ার উদ্বাস্তুদের নিয়ে কাজ শুরু ২০১২ সালে। সিরিয়া তখন রক্তাক্ত। আকাশ-বাতাসে বারুদের গন্ধ। অনাহার, অপুষ্টিতে মৃত্যু হচ্ছে শত শত শিশুর। গণধর্ষণে রক্তাক্ত পাঁচ বছরের কিশোরী থেকে যুবতীরা। সিরিয়ার আলেপ্পোতে এই মৃত্যুপথযাত্রীদেরই উদ্ধারের কাজ শুরু করেন কায়লা।
২০১৩ সাল। সিরিয়ার একজন ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে আলেপ্পোর হাসপাতাল ঘুরে তুরস্কে ফিরে আসছিলেন কায়লা। আলেপ্পোতে তখন লাগাতার বোমাবর্ষণ চলছে। বেশিক্ষণ সেখানে থাকা বিপজ্জনক। রাস্তাতেই তাঁদের গাড়ি ঘিরে ধরে জঙ্গিরা। অপহরণ করা হয় দু’জনকেই। পরে অবশ্য শোনা গিয়েছিল, সেই ডাক্তারকে নাকি ছেড়ে দেয় আইএস জঙ্গিরা। কিন্তু কায়লার কোনও খোঁজ মেলেনি।
জোর করে বিয়ে করে বাগদাদি, বেঁধে রেখে দিনের পর দিন চলে ধর্ষণ
মার্কিন মানবাধিকার কর্মী কায়লা মুলারকে অপহরণ করে পরোক্ষে মার্কিন বাহিনীকে চরম হুঁশিয়ারি দিতে চেয়েছিল আইএস। তাদের তরফেই বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়, কায়লাকে নাকি বিয়ে করেছে আইএস প্রধান। তবে এই খবরের সত্যতা জানা যায়নি। গোয়েন্দা সূত্র মারফত যে তথ্য সামনে আসে সেটা ছিল আরও ভয়ঙ্কর। বছর ছাব্বিশের তরুণীকে নিজের যৌনদাসী বানিয়ে নিয়েছিল বাগদাদি। ডেরায় বেঁধে রেখে দিবারাত্র চলত ধর্ষণ। রক্তাক্ত, ছিন্নভিন্ন যোনি নিয়ে মৃত্যুর অপেক্ষা করছিলেন কায়লা।
২০১৪ সাল। ইরাকে ঢুকে সে দেশের বেশ কয়েকটি শহর জোরজবরদস্তি দখল করে নিয়েছে ইসলামিক স্টেট। উত্তর ইরাকের সংখ্যালঘু ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের কিশোরী ও মহিলাদের ওপর চলছে অমানুষিক শারীরিক অত্যাচার। তাদের নির্বিচারে বানানো হচ্ছে যৌন ক্রীতদাসী। মানবাধিকার সংগঠন ‘হিউম্যান রাইট্স ওয়াচ’-এর শাখা ‘ওমেন রাইট্স ডিভিশন’ জানিয়েছিল, জঙ্গিদের যৌন-ক্ষুধা মেটানোর জন্য মহিলাদের খেলনার মতো ব্যবহার করা হচ্ছে। কিছুদিন পর সেই সব মহিলার হাতবদলও হচ্ছে অন্য ডেরায়। কায়লার ক্ষেত্রেও তেমনটাই হয়েছিল বলে জানা যায়। বাগদাদির চাহিদা মিটে গেলে তাকে নাকি পাচার করে দেওয়া হয়েছিল সিরিয়ার অন্য জঙ্গিদের ডেরায়।
আমার জন্য ভেবো না, জঙ্গিদের সঙ্গে আপস কোরো না’..কায়লার শেষ চিঠি ছিল তাঁর মাকে
কায়লার বাবা কার্ল মুলার ও মা মার্সার আবেদনে তখন সিরিয়া তোলপাড় করে কায়লাকে খুঁজছে মার্কিন ডেল্টা ফোর্স ও নেভি সিল। কিন্তু তরুণীর খোঁজ নেই। বারে বার ডেরা বদলে কায়লাকে আড়াল করেছে আইএস। শর্ত রাখা হয়েছে, আইএস জঙ্গি ৮৬ বছরের আফিয়া সিদ্দিকিকে ছেড়ে দিলেই মুক্তি মিলতে পারে কায়লার। তবে আইএসের এই শর্ত মানতে রাজি হননি তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা।
জঙ্গি ডেরায় বন্দি থাকা অবস্থায় পরিবারকে শেষ চিঠি লেখেন কায়লা। আইএসের শর্ত লিখে সেই চিঠি পাঠিয়ে দেওয়া হয় কায়লার পরিবারের কাছে। তাতে তরুণী লিখেছিলেন, “নিজের মুক্তির জন্য কুখ্যাত জঙ্গি নেতার মুক্তি চাই না। এই শর্তে রাজি হয়ো না মা। সব অত্যাচার সয়েও আমি মনোবল হারাইনি। তুমিই তো বলতে, ঈশ্বর আছেন। সেই সৃষ্টিকর্তার হাতেই আমি সব কিছু ছেড়ে দিয়েছি।”
পরিবারকে লেখা কায়লার এই চিঠিই সামনে এনেছিল এক মার্কিন সংবাদমাধ্যম
২০১৫ সাল..রাক্কাতে পতন হচ্ছে আইএসের..কায়লার মৃত্যুর খবর পেল পরিবার
রাক্কাকে আইএসের দখলমুক্ত করতে তখন জোরদার মার্কিন মদতপুষ্ট সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্স (এসডিএফ)। আরব ও কুর্দিশদের নিয়ে গড়া সেই বাহিনীতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রয়েছে ওয়াইপিজি মিলিশিয়া। তিন বছর ধরে রাক্কা কার্যত ‘রাজধানী’ হয়ে উঠেছিল আইএসের। ইরাকি বায়ু সেনা ফালুজা, বাবিল প্রভৃতি জায়গায় আইএস জঙ্গিদের উপরে আঘাত হেনেছে। সঙ্গে রয়েছে মার্কিন বিমান হামলা। সৌদি আরব, জর্ডন, বাহারিন, সংযুক্ত আরব আমিরশাহির মতো সুন্নি প্রধান দেশকে সঙ্গে নিয়ে সিরিয়ায় ততদিনে আইএসকে কোণঠাসা করে ফেলেছে আমেরিকা।
৬ ফেব্রুয়ারি। জর্ডনের বায়ুসেনার পাইলট মুয়াথ আর-কাসাসবেহকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারে আইএস জঙ্গিরা। সেই নির্মম হত্যালীলার ভিডিও সামনে আনে তারা। তখনই সিরিয়ার কয়েকটি ভাঙাচোরা বাড়ির ছবি দেখিয়ে আইএস দাবি করে, এই বাড়িতেই আটকে রাখা হয়েছিল কায়লা মুলারকে। জর্ডনের এয়ার স্ট্রাইকে প্রাণ গিয়েছে তাঁর। যদিও এই তথ্য মানতে রাজি ছিল না আমেরিকা। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পর্ষদের তরফে জানানো হয়, কায়লাকে অন্য কোথাও লুকিয়ে রেখেছে আইএস। ২০১৬ সালে আমেরিকার কয়েকটি সংবাদমাধ্যম দাবি করে, সত্যি সত্যিই মৃত্যু হয়েছে কায়লার। তবে মৃত্যুর কারণ কী সেটা জানা সম্ভব হয়নি। বিমানহানা নাকি আইএসের অকথ্য নির্যাতন—কায়লা মুলারের মৃত্যু আজও রহস্যই থেকে গেছে।
কোথায় আমার মেয়ের মৃতদেহ? আজও কেঁদে চলেছেন কায়লার বাবা-মা
আইএস প্রধান আবু বকর আল-বাগদাদির মৃত্যুতেও মুখে হাসি ফোটেনি কার্ল ও মার্সার। কার্ল বলেছেন, “মার্কিন সেনার সাফল্যে আমরা গর্বিত। বাগদাদি মরেছে এর থেকে খুশির খবর আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু আমার মেয়ের মৃতদেহের কোনও খোঁজ মিলল? কোথায় আমার মেয়ে, ফিরিয়ে এনে দিতে পারো?”
মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের উপদেষ্টা রবার্ট ও’ব্রায়েন জানিয়েছেন, অপারেশন বাগদাদির নাম দেওয়া হয়েছে আইএস ডেরায় নিহত মার্কিন মানবাধিকার কর্মী কায়লা মুলারের নামে। কায়লার মা মার্সা বলেছেন, “ওবামা যদি সেদিন সঠিক সিদ্ধান্ত নিতেন, আমার মেয়ে ঘরে ফিরে আসত। ওর সৎকারও করতে পারিনি আমরা। যে পৈশাচিক নির্যাতন চলেছিল ওর উপর তার কোনও ক্ষমা হয় না।”