লিখছেন~
দেবাশিস রায়চৌধুরী
চকৌরি না কি চৌকরি !দু’রকম নামই শুনলাম।যাই হোক নামে কিবা যায় আসে?তাছাড়া এক মানুষের যদি একাধিক নাম (শ্রীকৃষ্ণের অষ্টোত্তর শত নাম)থাকতে পারে তাহলে জায়গার নাম বা একের বেশি হলে ক্ষতি কী ?যদিও চৌকরি নামটা প্রচলিত তবু আমরা কিন্তু ওই চকৌরি নামটাই বেছে নিয়েছি।এখানে ঠান্ডা প্রায় মুন্সিয়ারির কাছাকাছি। এখন ছয় ডিগ্রি, রাতে আরও নামতে পারে।হোটেল চত্ত্বরে কনকনে ঠান্ডায় আমরা দল বেঁধে হিহি করতে করতে নেমে পড়লাম।তবে এটা ভাবার কোনও কারণ নেই যে আমরা শীতে কাবু হয়ে হিহি করছি। আসলে বাসের মধ্যে আমদের ননস্টপ হাহা হিহি চলতেই থাকে।ছোটোদের গ্রুপে সংস্থিতা, আত্রেয়ী, পাপান,সবচেয়ে উচ্চকিত।বড়দের গ্রুপে অলক,পুঁটে,সুষমাদি হাসির আনলিমিটেড ডাটা প্যাকেজ সাপ্লাই করে যাচ্ছেন। মাঝেমধ্যে এদের নেটওয়ার্ক যখন থাকছে না, পিউ সেই দায়িত্ব নিয়ে নিচ্ছে। তবে পিউ যে কোন গ্রুপে এই বিষয়ে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছানো আজও সম্ভব হয় নি।কখনও মনে হয়েছে বড়দের গ্রুপের কনিষ্ঠ সদস্য আবার পর মুহূর্তে মনে হয়েছে ছোটোদের গ্রুপের বয়োজ্যেষ্ঠ দলনেত্রী।মোদ্দাকথা হল আমাদের দলে হাহা হিহি কখনও কিছু কম পড়ে নাই।এই হোটেলও বেশ পছন্দসই।তিনতলা বিল্ডিং-এর উল্টো দিকে চারটে কটেজ।এর মধ্যে একটা আমদের জন্য বরাদ্দ হল।ফ্রেস হয়ে গরম কফি আর চিকেন পকোড়া খেতে খেতে আড্ডা শুরু হয়।
কিছুক্ষণ পর রাতের খাবারের জন্য ডাক আসে।খাবার আয়োজন দোতলায়।আজ প্রথম আমাদের গ্রপের সবাই একই হোটেলে আছি।এ’কদিন বাস আর ছোট গাড়ির যাত্রীদের এক হোটেলে স্থান সংকুলান হয়নি।আজ খাবার টেবিলে অনান্যদের সাথে দেখা হল।ইচ্ছে থাকলেও কনকনে ঠান্ডার জন্য খাবার টেবিলে আড্ডা হল না।জমিয়ে আড্ডা দিতে গেলে শীতে জমে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।তাই অনিচ্ছা নিয়ে উঠতে হল।ছোটোদের অবশ্য থোড়াই কেয়ার ওদের হইহুল্লোড় চলতে থাকল।অপূর্ণ সাধ নিয়ে অগত্যা সেঁধিয়ে যাই কটেজান্দরে।রাতে বেশ ভালো ঘুম হয়।
ঘুম ভাঙতে সামান্য দেরি হয়।গতকাল সারাদিন জার্নি করার পর শরীর ক্লান্ত ছিল।তাছাড়া ব্রেকফাস্ট করেই বেরিয়ে পড়তে হবে সেইজন্য আলসেমি জড়িয়ে ছিল শরীরে।তবু বিছানা ছেড়ে জানলায় গিয়ে দাঁড়াই আর পর্দা সরিয়ে দিতেই নির্বাক, স্থির হয়ে যাই।দুধ সাদা পাহাড়গুলো রঙিন পোষাক পরে নিয়েছে আগেই।তারা যেন কার আসার আশায় উন্মুখ হয়ে আছে।আমিও
স্তব্ধ হয়ে চেয়ে থাকি। আর আমাকে বিস্ময়ে আবিষ্ট রেখে, আচমকা পাহাড়দলের পিছন থেকে আকাশে লাফিয়ে ওঠে,টুকটুকে
লাল বল।ক্রমশ তার ঔজ্জ্বল্য বাড়তে থাকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না।এতক্ষণে মনে হয় একটাও ছবি তোলা হয়নি।আসলে সম্মোহিত অবস্থায় স্বাভাবিক চিন্তা ভাবনা লুপ্ত হয়ে যায়।অবশ্য মনে পড়লেও কাঁচঘেরা জানলায় দাঁড়িয়ে ছবি তোলা সম্ভব ছিল না,কারণ কাঁচের ওপারে তারজাল লাগানো।মন অদ্ভূত প্রসন্নতায় ভরে যায়।ঘরের বাইরে বেরোতেই শীত কাঁপিয়ে দিয়ে যায়।পায়ে পায়ে কটেজের পিছনে বাগানে পৌঁছে যাই।রোদ্দুরের আদুরে ওম গায়ে মাখি।চারিদিকে আজ এত আলো, প্রকৃতি আজ এত উচ্ছসিত, কেন জানি না মনে হল এসব আয়োজন শুধু আমার জন্যই। নিজেকে ধন্য মনে হয়। অস্ফুটে উচ্চারণ করি,”জীবন, হে মহাজীবন ‘ প্রাণে আর মনে দাও শীতের শেষের
তুষার-গলানো উত্তাপ’।”
এত ভাবনার অবকাশ বড় কম।ঘরেঘরে ‘শয্যাচা’ পৌঁছে দিতে সুকুমার দোরেদোরে টোকা দিয়ে সুপ্রভাতের সাথে চা বিস্কুট পরিবেশন করে দিয়েছে।আমরা কয়েকজন বেরো মানুষ ঘরের বাইরে চাপর্ব সেরে নিই।নিত্যদিনের মতো হারুদা হাঁক পেড়ে জানিয়ে দেন বেশি দেরী করা যাবে না,ব্রেকফাষ্ট করেই বেরিয়ে পড়তে হবে।লাগেজ যেন রেডি থাকে।
ঘন্টা দুয়েক পর আবার বাগানে এসে দাঁড়াই।বাসে মালপত্র ওঠানো চলছে সেই ফাঁকে সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি।নিয়মমাফিক ফটোশ্যুট,সেলফির উদযাপন শেষ হয়েও হতে চায় না।হারুদা অনেক কাকুতিমিনতি করে সবাইকে বাসে ওঠাতে সক্ষম হলেন।চকৌরিকে বিদায় জানিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হল।মাত্র কয়েক ঘন্টার রাত্রিবাসএই জনপদে। কিন্তু হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া চকৌরিকে মনে থাকবে আজীবন।
বাস চলতে থাকে। আজ কৌশানিতে আমাদের যাত্রা শেষ হবে।চলন্ত বাস পেরিয়ে চলে পথ আর দুপাশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা পাহাড়-মাটির সখ্যতা,আকাশ-পাহাড়ের মিলন আকুতির, দৃশ্য আশ মিটিয়ে দেখতে থাকি।নারাণদার কিছু সমস্যা হচ্ছিল তাই অল্পসময়ের জন্য বাস দাঁড়াল।বাস থামতেই অনেকেই ঝুপঝাপ নেমে পড়লাম।এইরকম ছায়ারোদ্দুরমাখা পাহাড়ি পথে অন্যমাত্রার মাদকতা আছে।পাইনগাছের ফাঁক দিয়ে পঞ্চচুল্লি উঁকিঝুঁকি মারছে।সামনের পথে বাঁক ঘুরতেই দেখি তিনটে ঘোড়া চুপচাপ দাঁড়িয়ে, অদূরে চারটি কিশোর কী যেন করছে।কৌতুহলবশত এগিয়ে যাই।দেখি একজায়গায় নতুন ইট সাজানো রয়েছে ওরা সেখান থেকে হাতেহাতে ইট তুলে নিয়ে ঘোড়াগুলোর কাছে যাচ্ছে।ঘোড়াদের শরীরের দুপাশে লম্বা বস্তা ঝোলানো ওরা ওই বস্তায় এক এক করে ইট সাজিয়ে রাখছে। কেয়া কর রহি হ্যায় ? এই রকম হিন্দি শুনেই বোধহয় ওরা একসাথে হেসে ওঠে।বাচ্চা লোগদের মুস্কারাহাট বড়িয়া লাগে।থোড়া পুছতাছের পর জানা গেল ইস পাহাড়িয়াকা নীচে ওদের গাঁও।ইসি ইটসে নয়া মকান বানানো হবে।ওদের নাম সূরজ,রাজু,আরিফ আর গোবিন্দা।ইস্কুল ভি যায়।সিক্সথ স্ট্যান্ডার্ড, সেভেন্থ স্ট্যান্ডার্ড, আর নাইথ স্ট্যান্ডার্ড মে সূরজ,রাজু,গোবিন্দা পড়ালিখা করে।আরিফ মাথা নীচু করে থাকে।মুখে লজ্জা, বেদনা দুটোই মাখামাখি হয়ে আছে।বাসের হর্ণ বেজে ওঠে।ফলে ফিরতে হয়।জানা হয় না সূরজদের গ্রামের নাম,ওদের স্কুলের নাম অজানা রয়ে যায়।রাজু,গোবিন্দারা স্কুলে গেলেও আরিফের কেন স্কুল যাওয়া হয়নি এই প্রশ্নের উত্তরও আর জানা হয়ে উঠল না।
এরপর যাত্রাবিরতি হয় বাগেশ্বরে।এখানে সরযু নদী আর গোমতী নদী মিলিত হয়েছে।দুই নদীর সঙ্গমস্থলে মন্দির।পাথরের তৈরি মন্দিরে প্রাচীন স্থাপত্যের ছাপ।কথিত আছে ঋষি মার্কেন্ডেয় এখানে শিবের দর্শন লাভের জন্য তপস্যা করেছিলেন।তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে শিব তাঁর সামনে বাঘ রূপে হাজির হন।সেজন্যই এই জায়গার নাম বাগেশ্বর।পনেরো শতকের মাঝামাঝি সময়ে চাঁদবংশের রাজা লক্ষ্মীচাঁদ এই মন্দির নির্মান করেন।
শিবরাত্রি তিথিতে বাগেশ্বরে প্রচুর ভক্ত সমাগম হয়।মন্দির চত্ত্বর বেশ পরিচ্ছন্ন।পাণ্ডার বালাই নেই।নদীসঙ্গমের ঘাট ও পাড় বাঁধানো।হালকা নীল ও স্বচ্ছ জলধারা দেখে দুটো নদীকে চিনে নেওয়া সহজ হয়।
বাগেশ্বর মন্দির দেখে আবার চলা শুরু হয়।মন্দির থেকে অনেকটা হেঁটে পার্কিং জোন। পাহাড়ি রাস্তায় চড়াই পথে হেঁটে এসে প্রায় সবাই ক্লান্ত।খিদে তার অস্তিত্ব জানান দিতে শুরু করেছে।তবে অপেক্ষা দীর্ঘ হয় না কিছুক্ষণের পরে বাস আবার থামে।সুকুমার জানায় এখানেই লাঞ্চ সেরে নিতে হবে।জায়গাটা খুব মনোরম। উদার প্রকৃতি বাড়িয়ে রেখেছে আথিতিয়তার হাত।দূরে আকাশ ছোঁয়া বরফপাহাড়ের শৃঙ্গ,পাশে অরণ্যভূমি।ঠান্ডা হাওয়া আর ওমমাখা রোদ্দুর। পিকনিকের জমি প্রস্তুত হয়েই ছিল।আমরা টুপটাপ নিজেদের ছড়িয়ে দিলাম মাত্র।সত্যিসত্যি পিকনিকের আমেজে জমে গেল দুপুরের খাওয়া। আমরা নেমেছি বৈজনাথ মন্দিরের উল্টো দিকে।এদিকে সরকারি জলপ্রকল্প আছে।মাঝে একটা লেক তার ওপারে বৈজনাথ মন্দির।লাঞ্চের পর আমরা লেকের পাশের বাঁধানো রাস্তা ধরে হেঁটে ওপারে পৌঁছে গেলাম।লেকের জলে অসংখ্য মাছ খেলা করছে।মাছ ধরা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।বোধহয় সেকারণে লেকে গভীর জলের মাছদের দেখা পাওয়া যায় না।তারা দেখলাম খোশমেজাজে,নিশ্চিন্তে অল্প জলেই ঘোরাফেরা করছে।পর্যটকদের দেওয়া বিস্কুট ঘাটের কাছে এসে নির্ভয়ে নিয়ে নিচ্ছে।কয়েক ধাপ সিঁড়ি উঠলে মন্দির।এই মন্দিরেও প্রাচীন স্থাপত্যশৈলি নজরে পড়ে।মূল মন্দিরের চারপাশে আরও কয়েকটা ছোটো ছোটো মন্দির।যদিও মূল মন্দির ছাড়া কোনোটাতে বিগ্রহ নেই।মূল মন্দিরে রয়েছে দেবী পার্বতীর মূর্তি।কাত্যুরি রাজাদের আমলে নবম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী জুড়ে এই মন্দিরগুলো নির্মিত হয়।মন্দির চত্ত্বরেই বৈকালিক আড্ডা শুরু হয়।বিকেল নিভে আসতে থাকে।আর দেরি করা ঠিক নয়।সকলেই বাসে উঠে পড়ি।যাত্রা শুরু হয়।এবার গন্তব্য কৌশানি।আজ এবং কাল ওখানে দুই রাত্রি থাকা হবে।
(ক্রমশ)
ছবিঃ সূপর্ণা রায়চৌধুরী।