পার্থসারথি সেনগুপ্ত, কলকাতা

এ যেন নতুন করে চেনা, নতুন ভাবে দেখা!

বাড়তি নির্মাণ ভেঙে ফেলার পর নয়া রূপ ।

বস্তুত, রাজ্য সরকার বয়সের ভারে জীর্ণ, বাড়তি নির্মাণের চাপে রিষ্ট প্রায় আড়াইশ বছরের হেরিটেজ ভবন ‘রাইটার্স বিল্ডিং’ সংস্কারের চ্যালেঞ্জ না নিলে বোঝার উপায় ছিল না যে ইতিহাসের কত খাজানা লুকিয়ে রয়েছে মহাকরণের অন্দরে। মূল কাঠামোর উপর একের পর এক বেমানান নির্মাণের ভিড়ে হারিয়ে যেতে বসেছিল ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের যাবতীয় অনবদ্য শ্রী ছাদ। সংস্কারের কাজ যত এগিয়েছে, ততই সন্ধান মিলেছে মহাকরণের সেই সাবেক রূপের। মঙ্গলবার সকাল থেকে মহাকরণের অলিন্দ ছুয়ে নানা গলিঘুজির নানা প্রান্তে ঘুরে মিলল হারিয়ে যাওয়া অতীত নতুন করে সুলুক সন্ধানের স্বাদ।

মানসার্ড এর উপর পুরনো ঘরের হদিস মেলে।

যেমন, মহাকরণের তিনতলার মাঝ বরাবর সন্ধান মিলল প্রমাণ মাপের এমন একটি ঘরের যেখানে এতদিন ইট – সিমেন্ট – কংক্রিটের নির্মাণের চাপে চোখের আড়ালে হারিয়ে গিয়েছিল গ্রেকো রোমান স্থাপত্যের আদলে নির্মিত বেশ কতগুলি পিলার। এক স্থপতি জানালেন সেগুলি নতুন করে ” আবিষ্কারের’ আখ্যান। অলিন্দ বরাবর ওই ঘরটিতে ও তার লাগোয়া আরো দুটি ঘরে বসতেন একাধিক মন্ত্রী। একদিন এক মন্ত্রীর ঘরে একটি চাঙ্গর ভেঙে পড়ে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ছুটে যান স্থপতিরা। ঘরের হাল খতিয়ে দেখেন তারা। তখনই এত কাল পরে বোঝা যায় ওই পিলার গুলির অস্তিত্ব।

জরাজীর্ণ স্থাপত্য সরিয়ে একই রূপে ও অবয়বে নতুনের আবাহন ।  ছাদের উপর জরাজীর্ণ কলস আকৃতির সাবেক স্থাপত্য।  মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রীর সাবেক চেম্বার ।

সরকারি সূত্রে খবর, সংস্কারের পর্যায়ে মহাকরনের যে নকশা, তাতে এই পিলারের আভিজাত্যে সমৃদ্ধ এই ঘরটিই চিহ্নিত হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর সম্ভাব্য চেম্বার হিসাবে।অন্যদিকে, ছাদের উপর ম্যানসার্ডটিতে বানানোর পরিকল্পনা রয়েছে কনফারেন্স রুম। সেখানে ছিল ল সেকশনের লাইব্রেরী। এর অন্দরের কাঠামোর উপরে মিলেছে আরো একটি ঘরের। সত্যি বলতে কি ” কলোনিয়াল” প্রভুদের বড় আদরের কলকাতা সহরের বুকে রাইটার্স বিল্ডিং বানানোর ক্ষেত্রে যে কোনও কার্পণ্য ছিল না, ছিল না কোনো যত্নের অভাব তা অলিন্দের মেঝেতে সেই আদ্যিকালে বসানো টাইলসের এক আধটি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নমুনা থেকেই মালুম হয়।

সংস্কারের পর মহাকরণের সেকেন্ড ফ্লোর যেন সাজানো বাগিচা

তার উপর লেখা বিলিতি কোম্পানির নাম: মিন্টন, হলিনস অ্যান্ড কোমপানি। ব্রিটিশ মিউজিয়াম থেকে প্রাপ্য তথ্য অনুযায়ী, ১৭৯৩ কি ১৭৯৬ সাল নাগাদ টমাস মিন্টন স্টাফর্ডশায়ারে এই কারখানাটি চালু করেন। এরপর এরপর হাল ধরেন টমাস সাহেবের ছেলে হার্বার্ট মিনটন । টাইলস বানানোর কাজে সুনাম করেন হার্বার্ট। ১৮৪৫ সালে তার অংশীদার হন এম ডি হলিনস। তবে এই বাণিজ্যিক সম্পর্ক দীর্ঘ স্থায়ী হয় নি। ১৮৬৯ সালে একই নতুন কারখানা খোলেন হার্বার্ট। মিন্টন অ্যান্ড কোম্পানি ও মিন্টন হলিনস অ্যান্ড কোম্পানি দুই নামেই ব্যবসা চালাতেন তিনি।

মহাকরণের ভিআইপি লিফটের মেশিন রুমে সাবেক আমলের ঢালাই এর সময় আস্তরণ হিসাবে দেওয়া হয়েছিল ইংলিশ ম্যান কাগজের পাতা। কালের কষাঘাতেও নষ্ট হয় নি ব্রিটিশ আমলের সাংবাদিকতার সাবুদ।

সময়ের সঙ্গে রীতি মত জীর্ণ হয়ে গিয়েছিল সেই টাইলস গুলি। হালে ২০১৮ সাল নাগাদ মহাকরণ থেকে স্থপতিরা বিলিতি কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করে পাঁচ হাজার বর্গ মিটার এলাকার জন্যে ভিক্টোরিয়ান প্যাটার্নের ওই ধরনের টাইলস পাওয়া যাবে কিনা, তার খোঁজ নিয়েছিলেন। কিন্তু দরদাম বেশ চড়া হওয়ায় আর এগোনো যায় নি।

সে আমলের বিলেতের মিনটন, হলিনস অ্যান্ড কোম্পানির বানানো টাইলস বিছানো থাকত মহাকরণের অলিন্দের মেঝেতে

উল্লেখ্য, পূর্ত দপ্তরের তত্ত্বাবধানে রাজ্য সরকারের সংস্থা ম্যাকিনটশ বার্ণ লিমিটেড সংস্কারের কাজটির দ্বায়িত্বে রয়েছে। স্থপতিদের কারো কারো মতে, এই কাজের পরতে পরতে লুকিয়ে রয়েছে নানান মিষ্টি চমক। হঠাৎ- ই একদিন ভি আই পি লিফটের মেশিন রুমে ঢালাইয়ের মাঝে মিলল আধ ভাঙ্গা ইটের টুকরো। তার গায়ে তখনও লেপ্টে রয়েছে ‘ইংলিশম্যান’ সংবাদপত্রের পাতার খানিক অংশ। শনিবারের সেই কাগজ থেকে গ্রিসের প্রাক্তন রাজার খবরটা কষ্ট করে হলেও খানিক পড়া যায়!

নবরূপে মহাকরণে মুখ্য মন্ত্রীর সম্ভাব্য ঘর

ইতিহাসের ক্রমবিন্যাসে মহাকরনের সামনের মূল ব্লকটি তৈরি হয়েছিল ১৭৭৭-৮০ এর মধ্যে। মোট আয়তন ৩৭, ৮৫০ বর্গ ফিট। এর পর ১৮৭৯ থেকে ১৯০৬ এর মধ্যে ৫৮৮২৫ বর্গ ফিট এলাকা নিয়ে তৈরি হয় ব্লক এক, দুই, তিন, চার ও পাঁচ। তৃতীয় পর্যায়ে ১৯৪৫-৪৭ এর মধ্যে তৈরি হল ব্লক এ, বি, সি ও ডি ( ১৯৩১৪ বর্গ ফিট)। সংস্কারের লক্ষ্য মূল ব্লকের সাথে ব্লক এক, দুই, তিন, চার ও পাঁচ রাখা। বাকিটা বিনির্মাণ। সরকারি সূত্রে জানা গিয়েছে, আগামী এক বছরের মধ্যেই শেষ হতে পারে সংস্কারের কাজ।

ছবিগুলি তুলেছেন পার্থসারথি সেনগুপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here