দেশের সময় : উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গ। ভোটের নির্ঘণ্ট ঘোষণার পর থেকে মনোনয়ন পর্ব, প্রচার পর্ব ধরে লাগাতার হিংসার ছবি দেখা গেছে। তা সে উত্তরবঙ্গের কোচবিহার জেলার দিনহাটা হোক বা দক্ষিণবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড়–রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে বেলাগাম অশান্তি হয়েছে। এইসব অশান্তি ঘিরে কমিশনের ভূমিকা নিয়েও নানা প্রশ্ন তুলেছে বিভিন্ন মহল। এই আবহে আজ শনিবার কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপস্থিতিতে রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটগ্রহণ শুরু হল। ভোটের আগের রাত থেকেই যেমন দফায় দফায় হিংসার খবর এসেছে, তেমনই সকাল থেকেও বিক্ষিপ্ত অশান্তির খবর পাওয়া গেল নানা জেলা থেকে।
*পঞ্চায়েত ভোটের শুরুতেই ঝরল রক্ত
ভোট শুরুর আগেই মুর্শিদাবাদে জোড়া খুনেপ অভিযোগ। উত্তর ২৪ পরগনার কদম্বগাছিতে নির্দল প্রার্থীর সমর্থক খুন।
গুলি চলল ব্যারাকপুরে। নির্দল প্রার্থী অরিজিৎ দাসকে লক্ষ্য করে গুলি চলেছে। একেবারে প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে ঘুরতে দেখা যায় এক যুবককে। কোনও ক্রমে পালিয়ে বাঁচেন অরিজিৎ দাস। ভোটের দিন কার্যত নজিরবিহীন ছবি দেখা গেল। এই ঘটনায় রীতিমতো আতঙ্ক ছড়িয়েছে এলাকায়। ব্যাপক উত্তেজনা ঘটনাস্থলে।পালিয়ে বাঁচলেন প্রার্থী ৷
ফোন আসছে ভোটারদের, দেখা নেই কমিশনারের
ভোট শুরু হওয়ার পর প্রায় আড়াই ঘণ্টা অতিক্রান্ত। কমিশনে দেখাই গেল না কমিশনার রাজীব সিনহাকে। এদিকে, রাত থেকেই একের পর এক ফোন যাচ্ছে কমিশনের অফিসে।
সকাল সাতটা থেকে শুরু হয়েছে পঞ্চায়েত ভোট। কিন্তু ন’টা বেজে গেলেও রাজ্য নির্বাচন কমিশনের দফতরে দেখা নেই কমিশনার রাজীব সিংহের। তিনি কোথায়, কখন পৌঁছবেন, সে বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলছেন না কমিশনের অন্য কর্তারাও।
কমিশনের কন্ট্রোল রুমে এক ডজন ল্যান্ড ফোন রয়েছে। অনবরত সেগুলি বেজে চলেছে। কিন্তু কমিশনার নেই। তাঁকে মোবাইলে ফোন করেও পাওয়া যায়নি। অথচ সকাল থেকেই কমিশনে অভিযোগের পাহাড় জমছে। শনিবার সাত সকালে দফতরে পৌঁছে গিয়েছেন সচিব নীলাঞ্জন শাণ্ডিল্য। বাকি কর্তারাও ফোন, অভিযোগ সামলাতে দিশাহারা।
কমিশনের কন্ট্রোল রুম থেকে অনেক ক্ষেত্রেই ভুয়ো আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ। কাউকে বলা হচ্ছে ঠিক সময়ে কেন্দ্রীয় বাহিনী পৌঁছে যাবে। কাউকে বলা হচ্ছে থানায় যান। যে পরিমাণ কেন্দ্রীয় বাহিনী আসার কথা তা যে ভোটের সকালে পৌঁছবে না শুক্রবারেই তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। শনিবার সকাল থেকে সব জেলাতেই দেখা গিয়েছে, বহু ভোটকেন্দ্রে কেন্দ্রীয় বাহিনী নেই। কিছু কিছু জায়গায় সিভিক ভলান্টিয়ারদেরও ভোটের নিরাপত্তার কাজে দেখা গিয়েছে বলে অভিযোগ।
ভোট শুরু হওয়ার পর থেকে বল্গাহীন হিংসার ছবি দেখা যাচ্ছে জেলায় জেলায়। মুর্শিদাবাদ, কোচবিহার, মালদহ মিলিয়ে একাধিক খুনের ঘটনাও ঘটে গিয়েছে। কমিশনের কর্তাদের প্রশ্ন করা হয়, কোন জেলা থেকে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ আসছে? জবাবে তাঁরা জানান, সব জেলা থেকেই অভিযোগ আসছে। আলাদা করে বলা যাবে না। পরিস্থিতি সামাল দিতে কমিশনের কর্তারা কার্যত হিমশিম খাচ্ছেন। ভোট শুরুর প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর যুগ্ম কমিশনার সঞ্জয় বনসল দফতরে পৌঁছেছেন কিন্তু কমিশনার রাজীব কখন পৌঁছবেন, দিনভর কী চলে, সেটাই এখন দেখার।
কোচবিহার দক্ষিণ বিধানসভা ফলিমারি গ্রাম পঞ্চায়েতে ভোটেরহাট ৪/৩৮ নম্বর বুথে বোমাবাজির অভিযোগ। মাধব বিশ্বাস নামে বিজেপির এক এজেন্টকে খুনের অভিযোগ উঠেছে। জখম হয়েছেন বেশ কয়েকজন। প্রার্থী বোমের আঘাতে জখম হয়েছেন। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে।
মালদহের মানিকচকের গোপালপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় তৃণমূলের এক কর্মীকে খুনের অভিযোগ উঠেছে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। সংঘর্ষের ঘটনায় জখম আট জন।
মুর্শিদাবাদে দুই তৃণমূল কর্মীকে খুনের অভিযোগ উঠেছে। সে জেলার বিভিন্ন এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন তৃণমূল, কংগ্রেস এবং সিপিএমের কর্মীরা। দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড়েও উত্তেজনা ছড়িয়েছে। চকমরিচায় দুই আইএসএফ কর্মী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন বলে অভিযোগ তৃণমূলের বিরুদ্ধে। অভিযোগ অস্বীকার করেছে শাসকদল। কোচবিহারের সিতাইয়ে বুথে আগুন লাগানোর অভিযোগ উঠেছে। পোড়ানো হয় ব্যালট পেপার।
ভোটের শুরুতেই উত্তপ্ত মুর্শিদাবাদ। বেলডাঙা দু’নম্বর ব্লকের রেজিনগর থানার নাজিরপুরে ইয়াসিন শেখ নামে তৃণমূলের এক কর্মীকে খুনের অভিযোগ উঠেছে বাম-কংগ্রেস জোটের বিরুদ্ধে। যদিও অভিযোগ অস্বীকার করেছে তারা। রানিনগরে সিপিএম-তৃণমূল সংঘর্ষে কমপক্ষে ২৪ জন জখম হয়েছেন বলে দাবি। রানিনগরের হূর্সি অঞ্চলে সিপিএম সমর্থক গুলিবিদ্ধ হয়েছেন বলে অভিযোগ। ডোমকলে এক কংগ্রেস কর্মী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন বলে দাবি। খড়গ্রামে তৃণমূল কর্মী শাহাবুদ্দিন শেখকে খুনের অভিযোগ। ডোমকলের কুশিবাড়িয়ায় দুই তৃণমূল কর্মী এবং এক কংগ্রেস কর্মী গুলিবিদ্ধ বলে দাবি। শমসেরগঞ্জে তৃণমূল কর্মী আফতাব শেখ গুলিবিদ্ধ বলে অভিযোগ।
তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেছেন, “মুর্শিদাবাদে এখনও পর্যন্ত আমাদের তিন জন কর্মী নিহত হয়েছেন। সিপিএম, কংগ্রেস, বিজেপি এবং যেখানে যেখানে সম্ভব আইএসএফ সম্মিলিতভাবে তৃণমূলের উপর হামলা চালাচ্ছে।”
ভাঙড়ের চকমরিচকে ১৬৪ নং বুথে আইএসএফ -তৃণমূল সংঘর্ষ। দু’জন আইএসএফ কর্মী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন বলে দাবি। এলাকায় বোমাবাজির অভিযোগ উঠেছে। ঘটনাস্থলে পুলিশের বিশাল বাহিনী।
ভোটের সকালেও উত্তপ্ত ভাঙড়। তৃণমূল-আইএসএফ কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে উত্তেজনা ছড়িয়েছে। ভোট শুরুর আগেই দিনহাটায় গুলিবিদ্ধ কংগ্রেস ও নির্দল কর্মী। সিপিএম প্রার্থীর উপর হামলা হয়েছে। তৃণমূলের বুথ চেয়ারম্যানকে খুনের অভিযোগ উঠেছে কোচবিহারের তুফানগঞ্জে। মুর্শিদাবাদের সামশেরগঞ্জে রাতভর বোমাবাজি, তৃণমূল কর্মীর বাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগ উঠেছে। ডোমকলে সকাল থেকে গুলি চলছে। অভিযোগ, বুথে যাওয়ার সময় তৃণমূল কর্মীদের লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়েছে। ঘটনায় দুই তৃণমূল কর্মী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।
শুক্রবার রাত থেকেই উত্তপ্ত কোচবিহারের দিনহাটা। এদিন সকালেও ছবিটা বদলায়নি। সূত্রের খবর, দিনহাটার পুঁটিমারি ১ গ্রাম পঞ্চায়েতে নির্দল প্রার্থী ভোলা বর্মনকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়েছে। অভিযোগ তৃণমূলের বিরুদ্ধে।
কোচবিহারের সিতাই বিধানসভার এক নম্বর ব্লকের ৬/১৩০ বড়ভিট গভর্নমেন্ট প্রাইমারি স্কুলে রাতভর তাণ্ডব চালানোর অভিযোগ উঠল তৃণমূলের বিরুদ্ধে। বুথের মধ্যে আগুন লাগানোর অভিযোগ উঠল। অভিযোগ, ভাঙচুর করা হয় ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে। ব্যালট পেপার ছিঁড়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় তাতে।
মুর্শিদাবাদে দফায় দফায় অশান্তি চলছে। খড়গ্রাম থেকে শুরু করে নবগ্রাম, রেজিনগর, বেলডাঙা একের পর এক নাম উঠে এসেছে গত কয়েকদিনে। এখনও পর্যন্ত এ জেলায় ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে সূত্রের খবর। রেজিনগরে বিস্ফোরণে প্রাণ গেছে আরও এক তৃণমূল কর্মীর। বোমা ফেটে ওই ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে বলে খবর।
ভোটের দিন রাজভবনে নয়, রাস্তায় থাকবেন রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান সিভি আনন্দ বোস। রাজভবন থেকে গতকালই বলা হয়েছিল, ভোটের সকালেই গ্রাউন্ড জিরোয় পৌঁছে যাবেন রাজ্যপাল। একাধিক জেলায় ঘুরে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখবেন তিনি। আজ শনিবার ভোটগ্রহণ শুরু হওয়ার পরই রাজভবন থেকে বেরিয়ে যান রাজ্যপাল। সকাল সকাল ব্যারাকপুরে পৌঁছতেই রাজ্যপালের কনভয় ঘিরে ধরে গ্রামবাসীরা। গাড়ির দরজা খুলে সমস্ত অভিযোগ শোনেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস।
উত্তর ২৪ পরগনা জেলার ব্যারাকপুর ২ নম্বর ব্লকের বাসুদেবপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়েতে রাজ্যপালের কনভয় দেখে ছুটে আসেন গ্রামবাসীরা। রাজ্যপালকে তাঁরা বলেন, “ভোটের নামে প্রহসন হচ্ছে আপনি আসুন স্বচক্ষে দেখুন।”
শুক্রবার রাতে রাজভবনের তরফে জেলাশাসকদের চিঠি পাঠিয়ে জানানো হয়েছিল রাজ্যপাল ভোট পরিদর্শনে যাবেন। রাজভবনের তরফে ওই চিঠিতে জানানো হয়েছিল, ভোটের দিন সকাল সওয়া ৬টা নাগাদ রাজভবন থেকে সড়কপথে উত্তর ২৪ পরগনার ব্যারাকপুরের বাসুদেবপুর একটি বুথের উদ্দেশে রওনা দেবেন রাজ্যপাল। সকাল ৬টা ৫৫ মিনিট নাগাদ সেখানে পৌঁছে বুথ পরিদর্শন করবেন। এরপর বাসুদেবপুর থেকে তিনি নদিয়ার উদ্দেশে রওনা দেবেন। সকাল সাড়ে ৭টা নাগাদ নদিয়ার বেশ কয়েকটি বুথ ঘুরে দেখবেন রাজ্যপাল। বেলা ১২ টায় তিনি থাকবেন রাজভবনের পিসরুমে। এরপর যাবেন দক্ষিণ ২৪ পরগনায়।
ভোটের নিরাপত্তার প্রশ্নে বৃহস্পতিবারই রাজ্য নির্বাচন কমিশনারকে নজিরবিহীনভাবে সমালোচনা করেছিলেন তিনি। রাজ্যপালের (Governor CV Ananda Bose) এমন আক্রমণে অতি সক্রিয়তা দেখেছিল শাসক দল তৃণমূল। রাজ্যপাল ‘বিজেপির ক্যাডারের মতো আচরণ’ করছেন বলে সরাসরি অভিযোগ করেছিলেন তৃণমূলের প্রথমসারির নেতারা। শুক্রবার মুর্শিদাবাদের হিংসা কবলিত এলাকা পরিদর্শনের পর রাজ্যপাল বলেন, ‘আমি পাবলিসিটি পাওয়ার জন্য জায়গায় জায়গায় যাচ্ছি না। গণতন্ত্রের স্বার্থে আমি কাজ করব, সেটাকে কেউ প্রচার বললে বলবেন।’
পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়ন পর্বে রাজ্যে অশান্তি শুরু হওয়ার পর থেকে সক্রিয় থেকেছেন রাজ্যপাল। উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গ, যেখানে অশান্তির খবর এসেছে তিনি ছুটে গিয়েছে। দেখা করেছেন নিগৃহীতের পরিবারের সঙ্গে। ক্যানিং থেকে কোচবিহার সর্বত্র তাঁর গতিবিধি বজায় ছিল। অশান্তির খবর তাঁকে সরাসরি জানানোর জন্য রাজভবনে কন্ট্রোলরুমও খুলেছেন। যার নাম দিয়েছিলেন ‘পিসরুম’। তাছাড়া শান্তি ও সম্প্রীতি রক্ষার কমিটিও খোলা হয়েছে রাজভবনে। ওই কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি শুভ্র কমল মুখোপাধ্যায়কে।