দেশের সময়, বনগাঁ: আসন একটাই। দলও একই। অথচ প্রার্থী দু’জন। নেতা বনাম নেতা-পুত্র। আর এনিয়ে বনগাঁয় তৃণমূলের কোন্দল চলছিল তুঙ্গে। একজনের পরিচয় যদি হয় পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ। অন্যজন পড়াশোনা, অধ্যাপনা ছেড়ে রাজনীতিতে অভিষেক। পঞ্চায়েত ভোটের আবহে এখন উত্তর ২৪ পরগনায় জেলা পরিষদের ৪ নম্বর আসনেই নজর ছিল সবার।
কারণ, এই আসন থেকেই তৃণমূল প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন দলের বনগাঁ সাংগঠনিক জেলা চেয়ারম্যান শ্যামল রায়। অন্যদিকে, এই আসনেই তৃণমূল প্রার্থী দলের বনগাঁ সাংগঠনিক জেলা সভাপতি তথা বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাসের ছেলে শুভজিৎ দাস। ফলে শেষপর্যন্ত কে তৃণমূলের প্রতীক পাবেন, তা নিয়ে শুরু হয় জোর লড়াই ৷
অবশেষে সোমবার বনগাঁ মহকুমাশাসকের অফিসে গিয়ে নিজের মনোনয়ন প্রত্যাহার করেন শ্যামল রায়৷ যদিও প্রকাশ্যে দলের বিরুদ্ধে কোনওরকম মন্তব্য করতে চান নি শ্যামল বাবু।
অন্য দিকে, সাংবাদিক বৈঠক করে ‘বিক্ষুব্ধ’ তৃণমূল নেতাকর্মীদের বার্তা দিয়েছেন বিশ্বজিৎ দাস। আর এই বিষটিকে নিয়ে তৃণমূলের গোষ্ঠীকোন্দলের উদাহরণ বলে কটাক্ষ করতে ছাড়েনি বিজেপি।
কিছু দিন আগে বনগাঁর ৪ নম্বর জেলা পরিষদের আসনে মনোনয়নপত্র জমা দেন তৃণমূলের শ্যামল রায় ও শুভজিৎ দাস ৷ জেলা পরিষদের প্রার্থী হওয়া নিয়ে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব তখনই প্রকাশ্যে চলে আসে। আসরে নামেন শীর্ষনেতৃত্ব। শেষে এক জনকে মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে হয়। এবং তিনি প্রবীণ তৃণমূল নেতা শ্যামল রায় ৷
মনোনয়ন প্রত্যাহারের পর শ্যামল রায় বলেন, ‘দল যাকে মনোনীত করেছে সে-ই প্রার্থী। ভুল বোঝাবুঝির জেরে মনোনয়ন জমা দিয়েছিলাম। পরে তুলে নিয়েছি। শুভজিৎ প্রার্থী হচ্ছে, ওর হয়ে প্রচারেও নামব।’
অন্য দিকে, শ্যামল মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করায় তাঁকে ‘মানসিক রোগী’ বলে কটাক্ষ করতে ছাড়েনি বনগাঁ উত্তরের বিজেপি বিধায়ক অশোক কীর্তনীয়া। তিনি বলেন, ‘বিরোধীদের হুঁশিয়ারি দেওয়ার আগে শ্যামলবাবুর উচিত ছয়ঘরিয়ায় পাগলা গারদে গিয়ে নিজের চিকিৎসা করানো।’ যদিও শ্যামল বলেন, ‘বিরোধীদের কোনও কটাক্ষই কাজে আসবে না।’
শ্যামল মনোনয়ন প্রত্যাহার করায় ‘খুশি’ বিশ্বজিৎ। তিনি বলেন, শ্যামল তাঁদের অভিভাবকের মতো। পাশাপাশি দলের বিক্ষুব্ধদের উদ্দেশে হুঁশিয়ারি দেন বনগাঁ তৃণমূলের জেলা সভাপতি। সোমবার সাংবাদিক বৈঠক করে বিশ্বজিতের বার্তা, টিকিট না পেয়ে যে তৃণমূল নেতারা নির্দল হিসেবে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন, তাঁরা যেন তা প্রত্যাহার করে নেন। তিনি বলেন, ‘নির্দল প্রার্থীরা মনোনয়ন প্রত্যাহার করে দলের হয়ে কাজ করুক। দল তাদের যোগ্য সম্মান ফিরিয়ে দেবে। আর তাঁরা যদি তা প্রত্যাহার না করেন, সারা জীবনের জন্য দলের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে।’
মনোনয়ন জমা দিয়েই তৃণমূল প্রার্থী হিসেবে প্রচার শুরু করে দিয়েছেন শুভজিৎ। বিরোধীদের তোপ উড়িয়ে সদ্য রাজনীতিতে পা রাখা ভুগোলে স্নাতকোত্তর শুভজিৎ বললেন, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় চেয়েছেন, তাই ত্রিস্তর ভোটের ময়দানে নেমেছি। প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন জমা দিয়েছি ৷
কিন্তু যে দলের হয়ে মনোনয়ন জমা করলেন, সেই দলের অনেকেই তো দুর্নীতির অভিযোগে জেল খাটছে, পড়াশোনা ও অধ্যাপনা ছেড়ে এমন একটি দলের হয়ে প্রার্থী হলে ভাবমূর্তিতে কোথাও প্রভাব পড়বে না?
শুভজিতের সাফ জবাব, আমার মনে হয়, খারাপকে ভাল করতে পারাটাই আসল কাজ। সবাই মিলে যদি সঠিকভাবে কাজ করা যায়, তা হলে সমাজটা সুন্দর হতে পারে। এটা খুবই দরকার আছে। কতটা করতে পারব জানি না। তবে নিজে তো চেষ্টা করবই। আমার বিশ্বাস আছে, আমাকে দেখে অন্তত একজনও যদি নিজের কাজটা সুন্দর করে করার চেষ্টা করেন, তাহলেই আমার সাফল্য। শুভজিতের কথায়, কিছু খারাপ তো হয়েছে, এটা না বলার কিছু নেই। কিন্তু সেই খারাপের জন্য মুখ ঘুরিয়ে চলে গেলে হবে না। খারাপকে ভাল করতে হবে। তৃণমূল গ্রাম-শহরের যেভাবে উন্নয়ন করেছে, মানুষের জন্য রাস্তা, আলো, জলের ব্যবস্থা করেছে, বিরোধীরাও তা অস্বীকার করতে পারবেন না।
কখনও তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা হয়েছে? শুভজিৎ বললেন, অনেকবার কথা হয়েছে দিদির সঙ্গে। আমি যখন দিল্লি থাকতাম, দিদির সঙ্গে দেখা হয়েছে, অনেক কথা হয়েছে। কিছুদিন আগেও বিধানসভায় দিদির সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ওনার পা ছুঁয়ে প্রণাম করলাম। আশীর্বাদ নিলাম। আর অভিষেকদা’র সঙ্গেও কথা হয়েছে একাধিকবার। বলতে পারেন, অভিষেকদা’কে দেখেই আমার সক্রিয় রাজনীতিতে আসা। এমননিতে আমি পিছনে থেকে কাজ করতে ভালবাসি। কিন্তু অভিষেকদা আমাকে বলেছেন, তোর সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে আসা প্রয়োজন। পঞ্চায়েতে প্রার্থী হবি। তারপরই সিদ্ধান্ত নিই, মানুষের জন্য কাজ করতে হলে এটার প্রয়োজন আছে।
বিশ্বজিৎ-পুত্র শুভজিৎ দ্বাদশ শ্রেণি পাশের পরই চলে যান কলকাতায়। সেখানে ভর্তি হন আশুতোষ কলেজে। স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি করেন। ২০১৩ সাল নাগাদ অতিথি অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন বনগাঁ কলেজে। এক বছর পড়িয়েছেন। কিন্তু কোনও সান্মানিক নেননি। তাঁর প্রাপ্য অর্থের সবটাই দান করেছেন কলেজের ফান্ডে। যেসব গরিব ছেলেমেয়েরা পয়সার অভাবে পরীক্ষার ফর্ম ফিলআপ করতে পারেন না, তাঁদের সাহায্য করার জন্য ওই অর্থ কাজে লাগানোর ইচ্ছাপ্রকাশ করেন শুভজিৎ। কলেজে অধ্যাপনা ছেড়ে ইউপিএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে তিনি চলে যান দিল্লি। সেখানেই কোচিংয়ে পড়তে পড়তে কেন্দ্রীয় সরকারের একটি চাকরি পান। কিন্তু তাঁর জীবনের স্বপ্ন আইএএস হওয়া। ফলে ওই চাকরি করেননি। ইউপিএসসিতে একবার মাত্র দু’নম্বরের জন্য সাফল্যের চাবিকাঠি হাতছাড়া হয়েছে। কিন্তু হাল ছাড়তে নারাজ বিধায়ক-পুত্র। বললেন, ছোটবেলা থেকেই দেখছি, বাবা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। বাবার কাছে বহু মানুষ তাঁদের নানা অভাব অভিযোগ নিয়ে আসেন। বাবা সেসবের সাধ্যমতো সমাধানের চেষ্টা করেন। এসব দেখে দেখে রাজনীতির প্রতি বরাবরই একটা আকর্ষণ ছিল। কিন্তু নিজের পড়াশোনা, স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে এগোতে গিয়ে রাজনীতিতে সেভাবে যোগ দেওয়া হয়ে ওঠেনি। কিন্তু এখন অভিষেকদা বলার পর মনে হয়েছে, এবার রাজনীতিটা করা দরকার। ভোটে দাঁড়ানো উচিত। অন্তত মানুষের জন্য কিছু করতে গেলে এটা দরকার।
আপনি যে আসন থেকে মনোনয়ন জমা করলেন, সেই আসনেই তৃণমূলের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন দলের বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার চেয়ারম্যান শ্যামল রায়। তিনি একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ। আগেও জেলা পরিষদে দাঁড়িয়েছেন। জিতেওছেন। দু’জনের এভাবে একই আসনে প্রার্থী হওয়া একটা খারাপ বার্তা গেল না? শুভজিতের উত্তর, একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। ওটা কোনও ব্যাপার নয়। শ্যামলকাকু মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেবেন আগেই দেশের সময়-কে বলেছিলাম এবং হলোও তাই৷ কারণ উনি ভাল মনের মানুষ ৷ তাছাড়া শ্যামল কাকু নিজেই জানিয়েছেন দলের হয়ে প্রচার করবেন জোর কদমে ৷ এটাই তৃণমূল এখানে দলই শেষ কথা ৷