West Bengal by-Election 2024 ছয় আসনেই ধরাশায়ী বিজেপি ,ছয়ে ছক্কা তৃণমূল

0
107

 দেশের সময় : ফের বাংলায় সবুজ ঝড়। রাজ্যের ছ’টি বিধানসভা আসনের উপ নির্বাচনেই বিপুল ভোটে জয়ী তৃণমূল। এর মধ্যে বিজেপিকে ধরাশায়ী করে একলাখি জয় ছিনিয়ে নিয়েছে রাজ্যের শাসক দল। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ, উত্তরবঙ্গের মাদারিহাট, যে জায়গাকে বিজেপির ‘গড়’ বলা হয়, সেখানেও পর্যুদস্ত গেরুয়া শিবির। মোদি-অমিত শাহের দলের উপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন চা বলয়ের মানুষ।

দীর্ঘদিন ধরে জিতে আসা মাদারিহাট আসনেও প্রায় ৩০ হাজার ভোটে হারতে হল বিজেপিকে। অন্যদিকে, উত্তরবঙ্গের আরও একটি আসন, কোচবিহারের সিতাই, সেখানে বিজেপিকে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ এই কোচবিহারেরই সাংসদ ছিলেন, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা অমিত শাহের ডেপুটি নিশীথ প্রামাণিক।

সিতাই বিধানসভা আসনে স্বামী তথা কোচবিহারের বর্তমান সাংসদ জগদীশচন্দ্র বসুনিয়ার ছেড়ে আসা আসনে উপ নির্বাচনে লক্ষাধিক ভোটে জয়ী হলেন তৃণমূল প্রার্থী সঙ্গীতা রায়।

পাশাপাশি নৈহাটি থেকে হাড়োয়া, মেদিনীপুর থেকে বাঁকুড়ার তালডাংরা সর্বত্রই তৃণমূলের জয়জয়কার। রাজ্যের শাসক দলের এই বিপুল জয় আরও একবার প্রমাণ করল, আরজিকর আন্দোলন ভোট বাক্সে কোনও প্রভাবই ফেলেনি। বরং বলা যেতে পারে, ভোট হয়েছে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারেই। গ্রামবাংলার মানুষ আস্থা রেখেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়ন আর অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংগঠনেই।

গো-হারা হারের পর অবশ্য বিজেপি নেতৃত্ব মুখ লুকোতে ব্যস্ত। সঙ্গে অজুহাত খাঁড়া করতে মরিয়া তারা। বিজেপির রাজ্য সভাপতি তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুকান্ত মজুমদারের সাফাই এটা উপ নির্বাচন। উপ নির্বাচনে এমনই ফল হয়। ২০২৬ সালে রাজ্যে বিজেপিই ক্ষমতায় আসবে। তবে বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের বিস্ফোরক মন্তব্য, কে, কী জানত জানি না। আমি তো জানতাম, ছ’টি আসনেই বিজেপি হারবে। প্রচারে গিয়েই টের পেয়েছিলাম।

উপ নির্বাচনে বিপুল জয়ের পর এক্স হ্যান্ডেলে পোস্ট করে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, আমার অন্তরের অন্তস্তল থেকে মা-মাটি-মানুষকে জানাই প্রণাম, জোহার ও সালাম। আপনাদের এই আশীর্বাদ আমাদের আগামীর চলার পথে আরো সক্রিয়ভাবে মানুষের কাজ করার উৎসাহ দেবে।মানুষই আমাদের ভরসা। আমরা সবাই সাধারণ মানুষ, এটাই আমাদের পরিচয়। আমরা জমিদার নই, মানুষের পাহারাদার। আপনাদের আশিস আজীবন হৃদয় স্পর্শ করে থাকবে। জয় বাংলা।

অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও এক্স হ্যান্ডেলে পোস্ট করে লেখেন, মাদারিহাটের মানুষ প্রথমবার আমাদের সেবা করার সুযোগ দিয়েছেন, তাঁদের অসংখ্য ধন্যবাদ।  

সুকান্ত মজুমদার যাই বলুন না কেন, বিজেপির ভোট মেশিনারি বলতে যে কিছুই নেই, শুধুমাত্র তারা হাওয়ায় ভর করে ভোটে লড়াই করে, আরও একবার তা প্রমাণ হয়ে গেল বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।

আরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, বামেদের রক্তক্ষরণ এখনও অব্যাহত। আরজিকর নিয়ে টানা আন্দোলন ভোটবাক্সে এতটুকু অক্সিজেন জোগাতে পারেনি তাদের। কোথাও কোথাও বামেদের অবস্থা এমন হয়েছে যে, নির্দল প্রার্থী যে ভোট পেয়েছেন, তার অর্ধেক ভোট পেতে কালঘাম ছুটেছে তাদের। একই অবস্থা কংগ্রেসেরও। উপ নির্বাচনের আগের দিন উত্তরবঙ্গ সফরে যাওয়ার আগে মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার ছ’টি বিধানসভা আসনেই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে তৃণমূল প্রার্থীদের জেতানোর আবেদন রেখেছিলেন। তাঁর সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে মানুষ যে উজাড় করে তৃণমূলকে ভোট দিয়েছে, ইভিএম খুলতেই তা স্পষ্ট হয়ে গেল।

কিছুদিন আগেও আরজিকর ইস্যুতে বিদ্রোহের আগুন জ্বলেছে রাজ্যে। আরজিকর ইস্যুকে সামনে রেখে চেয়ার দখলে মরিয়া হয়ে ওঠে বিরোধীরা। গেল গেল রব তুলে তারা দাবি করেছিল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিদায় স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু উপ নির্বাচনের ফল বুঝিয়ে দিল, বংলার জনতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেই রয়েছেন।

উপ নির্বাচনে বিপুল জয়ের পর তৃণমূল নেতৃত্বের দাবি, আরজিকর আন্দোলন যে বিরোধীদের ফোলানো বেলুন ছিল, তা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আরজিকর আন্দোলন ছিল পুরোপুরি শহরকেন্দ্রিক।

গ্রামে তার কোনও প্রভাবই পড়েনি। বরং গ্রামের মানুষ ভরসা রেখেছেন কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, তপশিলি বন্ধু, জয় জোহার, বিনামূল্যে রেশন, স্বাস্থ্যসাথীর মতো প্রকল্পের সুবিধার উপর। বাম আমলে যে রাস্তা কাঁচা ছিল, তা এখন ঝকঝকে পিচের।

আগে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ফসল নষ্ট হলে মাথায় হাত পড়ত কৃষকের। এখন বিমার সুবিধা করে দিয়েছে রাজ্য সরকার। বিমার প্রিমিয়ামের টাকাও চাষিকে দিতে হয় না। তা দেয় রাজ্যই। ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল নষ্ট হলে ক্ষতিপূরণ মেলে বিমা সংস্থার তরফে। মেয়ের বিয়ের সময় গরিব পিতা পান রূপশ্রীর টাকা। মেয়ের পড়াশোনার খরচ চালাতে মেলে কন্যাশ্রী।

সংখ্যালঘুরা পান ঐক্যশ্রী। আদিবাসী বয়ষ্ক মানুষদের জন্য রয়েছে জয় জোহার পেনশন। তপসিলি জাতির মানুষদের জন্য রয়েছে তপসিলি বন্ধু পেনশন। বাড়ির মহিলার হাতে এসেছে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকা। ইভিএমে বোতাম টেপার আগে এসব কথা মাথায় রেখেছিলেন মানুষ। আর তাতেই উধাও হয়ে যায় আরজিকর ইস্যুতে বিরোধীদের তোলা স্লোগান। আরজিকর আন্দোলনের ঝাঁঝ শুধুমাত্র আবদ্ধ থেকে যায় কলকাতা শহরের মধ্যেই।বাংলার মাঠেঘাটের মানুষ ভরসা রাখেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প ও বাংলার উন্নয়নের উপরই।  

২০২৬ সালে বিধানসভা নির্বাচন। তার আগে ছয় কেন্দ্রে এই উপ নির্বাচন যেন ছিল সেমি ফাইনাল। তাতে গোহারা হেরে বিরোধীরা কার্যত চুপসে গিয়েছে। সঙ্গে অ্যাসিড টেস্টে সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়ে আরও বড় মাঠে খেলার জন্য এবার প্রস্তুতি শুরু করার অপেক্ষায় জোড়াফুল শিবির।

মাদারিহাট থেকে সিতাই, তালাডাংরা থেকে নৈহাটি, তৃণমূলের জয়ের ব্যবধান কোথাও ৫০ হাজার, কোথাও আবার এক লক্ষ, জয়ের এই মার্জিনেই এখন চওড়া হাসি ঘাসফুল শিবিরে।

নৈহাটিতে বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছেন তৃণমূল প্রার্থী সনৎ দে। ৪৯ হাজার ১৯৩ ভোটে জয়ী হয়েছেন তিনি। তাঁর প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা ৭৮ হাজার ৬১২। তাঁর নিকটতম প্রার্থী রূপক মিত্র পেয়েছেন মাত্র ২৯ হাজার ৪১৯ ভোট। জয়ের পর সনৎ দে বলেছেন, এই জয় মা-মাটি-মানুষের জয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জয়।

সেই সঙ্গে তাঁর দাবি, পার্থ ভৌমিক না থাকলে এই জয় সম্ভব হত না। তিনি বলেন, ৩৬৫ দিন নৈহাটির মানুষের সঙ্গে থাকি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়ন পৌঁছে দিই মানুষের দুয়ারে। বিরোধী প্রার্থী নৈহাটির মানুষকে অপমান করেছিলেন। বলেছিলেন, নৈহাটির মানুষের মেরুদণ্ড বাঁকা। এই মন্তব্যের জবাব দিয়েছেন নৈহাটির মানুষ। পার্থর ছেড়ে আসা আসনেই জিতলেন সনৎ। নৈহাটিতে জয় নিয়ে তৃণমূলের বর্তমান সাংসদ তথা প্রাক্তন মন্ত্রী পার্থ ভৌমিক বলেন, নৈহাটির মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়নে আস্থা রেখেছেন। তাঁর দাবি, বিজেপি অর্জুন সিংকে যত ব্যারাকপুরে ঘোরাবে, ততই ওদের ভোট কমবে। কারণ, অর্জুন সিংকে দেখলেই মানুষের সন্ত্রাসের কথা মনে পড়ে যায়। পার্থ বলেন, দলের কর্মীদের বলেছিলাম, দিদিকে কথা দিয়েছি, ন্যূনতম ৪০ হাজার ভোটে উপ নির্বাচনে জিতবে তৃণমূল। সেটা হয়েছে। আমি খুশি। অন্যদিকে পরাজিত হয়ে বিজেপি প্রার্থী রূপক মিত্র বলেন, মানুষের রায় আমি মাথা পেতে নিচ্ছি। যিনি জয়ী হয়েছেন, তিনি নৈহাটির মানুষের জন্য কাজ করবেন, এটাই আশা করব।

অন্যদিকে, কোচবিহারের সিতাই বিধানসভা আসনে জয় নিয়ে কোনও সংশয় ছিল না তৃণমূলের। কত ভোটে তারা জয়ী হবেন, তা নিয়ে চর্চা চলছিল জোড়াফুল শিবিরে। গণনা শেষে দেখা গেল, সিতাইয়ে তৃণমূল প্রার্থী সঙ্গীতা রায় ১ লক্ষ ৩০ হাজার ৪৬৩ ভোটে জয়ী হয়েছেন। এই আসনে ২০২১ সালে সঙ্গীতাদেবীর স্বামী জগদীশচন্দ্র বসুনিয়া দশ হাজারের মতো ভোটে জয়ী হয়েছিলেন। এবার লোকসভায় জিতে জগদীশবাবু সাংসদ হয়েছেন। ফলে ওই আসনে উপ নির্বাচন হয়। রাজ্যের শাসক দল প্রার্থী করে জগদীশচন্দ্র বসুনিয়ার স্ত্রী সঙ্গীতা রায়কে।

লক্ষাধিক ভোটে জিতলেও দেশে রেকর্ড গড়তে না পারায় আক্ষেপ রয়ে গেল তৃণমূলের জেলা নেতৃত্বের। দিনহাটার বিধায়ক তথা উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী উদয়ন গুহ বলেন, আমরা চেয়েছিলেন জয়ের মার্জিনে গোটা দেশে রেকর্ড গড়া। কিন্তু একটু কম ভোট পোল হয়েছে, সেকারণে ওই রেকর্ড গড়া সম্ভব হল না। সিতাইয়ে বিজেপি প্রার্থী দীপক রায়ের থেকে পাঁচগুণ বেশি ভোট পেয়েছেন তৃণমূল প্রার্থী। মাদারিহাট আসনটিও হাতছাড়া হয়েছে বিজেপির।

উত্তরবঙ্গে মাদারিহাট বিজেপির শক্ত ঘাঁটি ছিল। কিন্তু সেখানেও হালে হানি পেল না গেরুয়া শিবির। মাদারিহাটে ২৮ হাজার ১৬৮ ভোটে জয়ী হয়েছেন তৃণমূল প্রার্থী জয়প্রকাশ টোপ্পো। হাড়োয়া, মেদিনীপুর, তালডাংরাতেও তৃণমূলের জয়জয়কার।

হাড়োয়ায় লক্ষাধিক ভোটে জিতেছেন প্রয়াত তৃণমূল সাংসদ হাজি নুরুল ইসলামের ছেলে রবিউল ইসলাম। তাঁর জয়ের ব্যবধান ১ লক্ষ ৩১ হাজার ৩৮৮ ভোট। বললেন, আমরা সম্প্রীতি, ঐক্যে বিশ্বাস করি। উন্নয়নে বিশ্বাস করি। হাড়োয়ার মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়নে ভরসা রেখেছেন। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশ, মানুষের সঙ্গে থেকে কাজ করতে হবে। সেটাই করার চেষ্টা করেছি বলেই মানুষ আমাদের উপর আস্থা রেখেছেন।

মার্জিন নিয়ে তাঁর মন্তব্য, হাড়োয়ার মানুষ কথা দিয়েছিলেন, তাঁরা তৃণমূলকে বড় জয় উপহার দেবেন। তালডাংরায় জয়ী হয়েছেন তৃণমূলের ফাল্গুনী সিংহ। তৃণমূল সাংসদ অরূপ চক্রবর্তীর ছেড়ে আসা আসনে জয়ী হলেন তিনি। তাঁর জয়ের ব্যবধান ৩৩ হাজার ৪৫৬ ভোট। এদিন তৃণমূল এগিয়ে যেতেই বাঁকুড়ার প্রাক্তন বিজেপি সাংসদ সুভাষ সরকারের গাড়ি ঘিরে সিমলাপালে উল্লাস করতে থাকেন তৃণমূল কর্মীরা। জয় বাংলা স্লোগান দেন। যা নিয়ে সুভাষ সরকারের মন্তব্য, ২০২৬ সালের ভোট আসতে দিন।তারপর দেখবেন, ফলাফল কী হয়। যারা জয় বাংলা স্লোগান দিচ্ছেন, তাদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত। মেদিনীপুরে তৃণমূল প্রার্থী সুজয় হাজরা জয়ী হয়েছেন ৩৩ হাজার ৯৯৬ ভোটে।  

Previous articleByElection Results 2024 বাংলায় উপনির্বাচনে তৃণমূলের ছক্কা ! মহারাষ্ট্র এগিয়ে বিজেপি, ঝাড়খণ্ডে  ‘ইন্ডিয়া’ , ওয়ানাডে  দু’লাখ পেরোলেন প্রিয়ঙ্কা
Next articleDesher Samay ePaper দেশের সময় ই পেপার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here