দেশের সময়, কলকাতা : শোরগোলের মধ্যে দিয়েই বৃহস্পতিবার বাজেট অধিবেশন শুরু হয়েছিল। রাজ্য সঙ্গীত শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিজেপি জাতীয় সঙ্গীত গাইতে শুরু করে, তা থেকে যত বিতর্কের সূত্রপাত হয় এদিন। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে একসময়ে বলতেও শোনা যায়, ‘এটা বিজেপির পার্টি অফিস নয়’।
বাজেট শেষের পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দেন তিনি। তবে এটাও দাবি করেন, বাংলার সরকার দেখিয়ে দিয়েছে কীভাবে এগিয়ে যেতে হয়।
কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে খোঁচা দিয়ে মমতা বলেন, দেশ ঋণের বোঝায় ডুবে রয়েছে। আর বিজেপি একতরফাভাবে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু বাংলার সরকার মানুষের কাছে পৌঁছেছে। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও বাজেটে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার থেকে শুরু করে একাধিক প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। মমতা জানান, আর্থিক বৈষম্য থাকলেও মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তিনি চাননি।
নাম না করে বিজেপিকে নিশানা করে মমতা বলেন, ”চিন্তাশক্তি থাকতে হয়, ভাবতে হয়। শুধু আ-কথা, কুকথা, মিথ্যে বলে, কুৎসা করে, অপপ্রচার করে আর ভাগাভাগির রাজনীতি করে, উন্নয়ন হয় না।”
বিজেপির পাশাপাশি সাংবাদিক বৈঠক থেকে সিপিএমকেও আক্রমণ করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দাবি করেন, ”আজ পর্যন্ত এমন হয়নি যে কোনও সরকারি কর্মচারী ১ তারিখে মাইনে পায়নি। আমাদের সরকার আসার পর থেকে এমন হয়নি যে শিক্ষক-শিক্ষিকা মাইনে পায়নি। বাম আমলে ১৫ দিন, ২০ দিন পেরিয়ে গেলেও টাকা পেত না।”
লোকসভা নির্বাচনের আগে বৃহস্পতিবার রাজ্য বিধানসভায় আগামী অর্থবর্ষের বাজেট পেশ করা হয়েছে। অধিবেশনের পর সেই বাজেটের সমালোচনা করলেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। বাজেটে কী আছে আর কী নেই, কারা বঞ্চিত হলেন, খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করে বুঝিয়েছেন তিনি। শুভেন্দুর দাবি, এই বাজেট ‘দিশাহীন’। কেন ‘দিশাহীন’, তা-ও জানিয়েছেন তিনি।
শুভেন্দু বলেন, ‘‘এই বাজেট ভোটের প্রচার ছাড়া আর কিছু নয়। এতে বেকারদের কর্মসংস্থান, বিভিন্ন শূন্যপদে নিয়োগ, শিল্প বাণিজ্যের পরিবেশ নিয়ে রাজ্যের অগ্রগতির কোনও দিশা নেই।’’ তাঁর মতে, ‘‘রাজ্য সরকার বাজেটের মাধ্যমে কিছু কিছু জায়গায় অর্থ বিলিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। তাতে আমাদের কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু অসমে মহিলারা আড়াই হাজার টাকা করে পান। মধ্যপ্রদেশেও অনেক বেশি টাকা মহিলাদের দেওয়া হয়। এখানে মহিলাদের ৫০০ টাকা বাড়িয়ে ১০০০ করা হচ্ছে মাত্র।’’
উল্লেখ্য, বাজেটে রাজ্য সরকারের ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ প্রকল্পের বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয়েছে। মাসে ৫০০ টাকার পরিবর্তে ১০০০ টাকা করে পাবেন মহিলারা। সেই ঘোষণাকেই কটাক্ষ করেছেন শুভেন্দু।
‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’-এ তফসিলি জাতি উপজাতির মহিলাদের ১০০০ টাকা করে দেওয়া হত। বাজেটে তাঁদের ১২০০ টাকা করে দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে। শুভেন্দু বলেন, ‘‘এটা ওঁদের অপমান। সাধারণ ক্যাটাগরির মহিলাদের তুলনায় ওঁদের দ্বিগুণ টাকা পাওয়ার কথা। ২০০ টাকা বাড়িয়ে ওঁদের অপমান করা হয়েছে।’’
সিভিক ভলান্টিয়ারদের ভাতা বৃদ্ধির কথাও ঘোষণা করা হয়েছে বাজেটে। সে প্রসঙ্গে শুভেন্দু বলেন, ‘‘মাত্র ন’হাজার টাকার বিনিময়ে সিভিকদের দিয়ে পুলিশের সমান কাজ করানো হয়। আজ এক হাজার টাকা বাড়িয়ে ভোট কিনতে চাইছে। ২০১২ সাল থেকে এক টাকাও বৃদ্ধি করা হয়নি। বিজেপি সমকাজে সমবেতন ভাবধারায় বিশ্বাসী। আমরা মনে করি, সিভিক ভলান্টিয়ারেরা ন্যূনতম ২০ হাজার টাকা বেতন পেতে পারেন।’’
বাজেটে কী কী নেই, তা বলতে গিয়ে শুভেন্দু বলেন, ‘‘শূন্যপদে নিয়োগের কোনও সুস্পষ্ট পরিকল্পনা নেই এই বাজেটে। এখানে পাহাড়, জঙ্গলমহল, সুন্দরবন উপেক্ষিত। কৃষকদের জন্যেও তেমন কোনও ঘোষণা করা হয়নি বাজেটে। আশাকর্মী, পঞ্চায়েতে কর আদায়কারী, যাঁরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে আংশিক সময়ের জন্য কাজ করেন, তাঁদের জন্য বাজেটে কোনও বৃদ্ধির ঘোষণা নেই। শিল্পের কোনও দিশাও বাজেটে দেখাতে পারেনি সরকার।’’
চা শ্রমিকেরা এই বাজেটে বঞ্চনার শিকার হয়েছেন বলে দাবি করেন বিরোধী দলনেতা। বলেন, ‘‘এই বাজেটে অসত্য ভাষণ রয়েছে। ভোটের আগে মিথ্যাচার করা হয়েছে। একমাত্র মহার্ঘভাতা বৃদ্ধিকে সামনে রেখে ভোট কিনতে চাইছে সরকার। রাজ্য যা ঘোষণা করছে, তার পরেও কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যের ডিএ-র ফারাক থাকবে অন্তত ৪০ শতাংশ। তা-ও বর্ধিত ডিএ উনি দেবেন ভোটের পরে।’’
শুভেন্দু আরও বলেন, ‘‘পেট্রল, ডিজেলে কোনও ছাড়ের উল্লেখ নেই বাজেটে। এলপিজি সিলিন্ডারে রাজ্য ৩০০ টাকা করে কর নেয়। রাজস্থান ৪০০ টাকা ছাড় দিয়েছে। আমরা মনে করেছিলাম, রাজস্থানের মতো না হলেও কিছুটা ছাড় সিলিন্ডারে দেবে রাজ্য সরকার। কিছুই দেওয়া হয়নি।’’
সংখ্যালঘুদের জন্যও বাজেটে বরাদ্দ নেই বলে কটাক্ষ করেন বিরোধী দলনেতা। বলেন, ‘‘যে সংখ্যালঘুরা ভোট দিয়ে ওঁকে মুখ্যমন্ত্রী পদে বসিয়েছেন, বাজেটে তাঁদের উন্নয়নের জন্য কোনও ঘোষণা নেই। তাঁদের বুড়ো আঙুল দেখানো হয়েছে। এমনকি, আদিবাসী, লেপচা, ভুটিয়ারাও এই বাজেটে উপেক্ষিত। হাসপাতাল, শিক্ষার খাতেও বাজেটে কোনও বরাদ্দ করা হয়নি।’’ বাজেটে আয়, ব্যয়ের সামঞ্জস্য নেই বলে দাবি করেছেন তিনি। বিধানসভায় এই বাজেটের অন্তঃসারশূন্যতা তুলে ধরার চেষ্টা করবেন বলেও জানান শুভেন্দু।