দেশের সময়: গরমের জেরে এবার উত্তরবঙ্গে চা শিল্পে অন্তত ৪০ শতাংশ ঘাটতির আশঙ্কা। চা বাগানগুলি থেকে এখনও পর্যন্ত যা খবর মিলেছে তাতে বৃষ্টির অভাবে কোথাও ২০ শতাংশ, কোথাও ২৫ শতাংশ, কোথাও ৩০ শতাংশ পর্যন্ত চায়ের উৎপাদন কম হয়েছে। ফলে মাথায় হাত পড়েছে বাগান মালিকদের।
আইটিপিএ সচিব রাম অবতার বলেছেন, খুবই খারাপ অবস্থা। কীভাবে এই ক্ষতি সামাল দেব বুঝতে পারছি না। আলিপুরদুয়ার ও জলপাইগুড়ি দুই জেলাতেই গরমের জেরে চায়ের উৎপাদন মারাত্মকভাবে মার খেয়েছে মে মাসে। টি অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়ার উত্তরবঙ্গের চেয়ারম্যান চিন্ময় ধর বলেছেন, প্রচণ্ড গরমে চা গাছের পাতা নেতিয়ে পড়েছে। যে পাতা পাওয়া গিয়েছে তা চা তৈরির অযোগ্য। তাছাড়া গরমে চা বাগানে লুপার সহ বিভিন্ন পোকার উপদ্রব বেড়েছে। ফলে বাগান নষ্ট হয়ে গিয়েছে। পোকা মারতে কীটনাশক প্রয়োগ করতে হওয়ায় খরচ বেড়েছে অনেকটাই। সবমিলিয়ে লোকসানের বহর যেভাবে বেড়েছে আগামী দিনে কী হবে জানি না।
শিলিগুড়ি টি অকশন কমিটির প্রাক্তন ভাইস চেয়ারম্যান প্রবীর শীল বলেন, মে মাসে দাবদাহের কারণে চা গাছের সব পাতা পুড়ে গিয়েছে। মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উৎপাদন। বটলিফগুলির অবস্থা ভীষণ খারাপ। সবমিলিয়ে ২০৫টি বটলিফ ফ্যাক্টরি রয়েছে। পাতা না পাওয়ায় প্রায় অর্ধেক অর্থাৎ ১০০টি ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বাকিগুলিও ধুঁকছে। কারণ, যে পাতা মিলছে তা থেকে চা তৈরি করার মতো পরিস্থিতি থাকছে না। বেশিরভাগ পাতা পোকায় খাওয়া। এই সঙ্কট কাটিয়ে কীভাবে উত্তরবঙ্গের চা শিল্প ঘুরে দাঁড়াবে, সেটাই চিন্তার। এখনও পর্যন্ত যা হিসেব পাওয়া গিয়েছে, চলতি মরশুমে চায়ের উৎপাদন ৩৮ শতাংশ কমবে।
চা বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, চা চাষের জন্য অনুকূল তাপমাত্রা ২৮-৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু উত্তরবঙ্গের বেশিরভাগ জায়গার তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছুঁয়েছে মে ও জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে। ফলে ঝলসে গিয়েছে গা গাছের পাতা। রোদের দাপটে চা গাছের সবুজ পাতা হয়ে গিয়েছে কালচে লাল। একে চলতি বছর ফার্স্ট ফ্ল্যাশে ৩০ শতাংশ কম চা পাতা উৎপাদন হয়েছে।
তার উপর এপ্রিল থেকে তাপমাত্রা বাড়তে থাকায় চা বাগানে হানা দিয়েছে গ্রিন ফ্লাই, লাল মাকড়শা, লুপারের মতো পোকা। এই সব পোকা খেয়ে ফেলেছে চা গাছের কচি পাতা ও সেকেন্ড ফ্ল্যাশের কুঁড়ি। ফলে সেকেন্ড ফ্ল্যাশও মার খাবে এবার।
এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকেই চা চাষের গুরুত্বপূর্ণ সময় শুরু হয়ে যায়। কিন্তু তখন থেকেই কাঠফাটা রোদের জেরে এবার উত্তরের চা শিল্পে সর্বনাশ নেমে এসেছে। বড় চা বাগানগুলি ছাড়াও উত্তরবঙ্গে ২০ হাজারের বেশি ক্ষুদ্র চা চাষি রয়েছে। মোট উৎপাদিত চায়ের অর্ধেকের বেশি চা উৎপাদন করেন তাঁরাই। হিসেব বলছে, উত্তরবঙ্গে প্রতি বছর মোট যে পরিমাণ চা উৎপাদন হয়, তার ৬৫ শতাংশ আসে ক্ষুদ্র চা বাগান থেকে। গোটা দেশের হিসেব ধরলে এই পরিমাণ ৫২ শতাংশ।
কিন্তু এবার বৃষ্টির অভাবে সবটাই শেষ হয়ে গিয়েছে। ক্ষুদ্র চা চাষি সংগঠনের জলপাইগুড়ি জেলা সম্পাদক বিজয়গোপাল চক্রবর্তী বলেছেন, বৃষ্টির অভাবে বহু বাগানে চা গাছ মরে গিয়েছে। ঝলসে গিয়েছে পাতা। ওইসব গাছ আর বাঁচিয়ে রাখা যাবে কি না সেটাই এখন চিন্তার। পাশাপাশি মারাত্মক গরমে রেড স্পাইডার, থ্রিভেস ও গ্রিন ফ্লাই নামক পোকা তাণ্ডব চালিয়েছে চা বাগানে। কৃত্রিম সেচ ও কীটনাশক প্রয়োগ করেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায়নি। কাঁচা চা পাতার অভাবে উত্তরবঙ্গের ৯০ শতাংশ বটলিফ ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
ডিবিআইটি’র চেয়ারম্যান জীবন পাণ্ডে বলেছেন, শুধু যদি মে মাসের হিসেব ধরা যায়, তাহলে গরমের জন্য প্রতিটি বাগানে ৪০-৫০ শতাংশ উৎপাদন কম হয়েছে। কিন্তু মার্চ-এপ্রিল মাসে বৃষ্টি হয়েছিল। তখন পরিস্থিতি ভালো ছিল। দারুণ পাতাও বেরিয়েছিল। ফলে সবমিলিয়ে যদি হিসেব করা যায়, চলতি মরশুমে চায়ের উৎপাদন ৩০ শতাংশ কমল। তাঁর দাবি, বৃষ্টি আসার পরও নতুন পাতা বেরতে অন্তত দশদিন সময় লেগে যায়। ফলে চলতি জুন মাসেও পরিস্থিতির কোনও বদল ঘটবে না।
জীবনবাবু বলেন, মে মাস হল সেকেন্ড ফ্ল্যাশ চায়ের একেবারে পিক টাইম। আর ডুয়ার্সে এই সেকেন্ড ফ্ল্যাশ চা থেকেই বাগান মালিকদের সবচেয়ে বেশি মুনাফা হয়। কিন্তু এবারের গরম সব শেষ করে দিল। এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে চা বাগানে শেড ট্রি অর্থাৎ ছায়াগাছ লাগানোর উপর জোর দিতে বলছেন চা বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের বক্তব্য, চা বাগানের মধ্যে নিম, পেয়ারা, আমলকির মতো গাছ লাগানো যেতে পারে। এতে বাগানে ছায়াও হবে। আবার ওই সব গাছের ফল বিক্রি করে চা চাষি বাড়তি আয় করতে পারবেন।