নাট্যকর্মী দীপন রায়ের উদ্যোগে নিউ জার্সিতে সমকালীন নানা সামাজিক বার্তা নিয়ে এপিক অ্যাক্টরস ওয়ার্কশপ চলছে ৪০ বছর ধরে …
সঙ্গীতা চৌধুরী : একরাশ স্বপ্ন নিয়ে প্রায় চল্লিশ বছর আগে আমেরিকা পাড়ি দিয়েছিলেন নাট্যকর্মী দীপন রায়। তখন লক্ষ ছিল উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সেই বিদেশের মাটিটাই কী করে আপন হয়ে উঠেছিল সেটা নিজেও ভাবতে পারেন নি এই ফার্মাসির অধ্যাপক ! আর তাই তো সেখানেই গড়ে তুলেছিলেন একটি নাটকের দল। নাটকের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন সেই ছোট্ট বেলা স্কুলে থাকাকালীনই। পরবর্তী সময়ে যখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মাসি নিয়ে পড়াশোনা করেন তখন নাট্যকার দেবেশ চক্রবর্তীর কাছে হাতে খড়ি সম্পন্ন হয়। তাই দেশ ছাড়ার সময় একদিকে যেমন ছিল খুশি আর অন্যদিকে নাটকের জন্য একটা চাপা কষ্ট মনে মনে পুষে রেখেছিলেন। দেখুন একান্ত সাক্ষাৎকার –
পিএইচডি-র ডিগ্রি অর্জনের পর আমেরিকায় কর্মজীবন শুরু হয়। সে সময় কয়েকজন মিলে ‘এপিক অ্যাক্টরস ওয়ার্কশপ’ নামে একটা নাটকের গ্রুপ তৈরি করেন। কলকাতায় এই একই নাম নাট্যকার দেবেশ চক্রবর্তীর গ্রুপের। শিষ্যদের গ্রুপের নাম নিয়ে কোন আপত্তি করেন তিনি, বরং খুশি হন। দেবেশ চক্রবর্তীর গ্রুপেরই ধ্রুব দত্তও তখন নিউইয়র্কে। দুজনে মিলেই অনেক ভালোবাসা দিয়ে সেই দল গড়ে তুলেছিলেন। একের পর এক বাংলা নাটক প্রযোজনা করেন।
শুধু পুজোতেই নয়, বিভিন্ন বিশেষ বিশেষ পার্বনে সেখানে মঞ্চস্থ হতে লাগলো সেই সব নাটক। এরপর নাটকের কর্মশালাও শুরু হয়। তাতে অংশ নেন নাটকের বড় বড় দিকপালরা। দেবেশ চক্রবর্তী, মেঘনাদ ভট্টাচার্য, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, অশোক মুখোপাধ্যায়, অরুণ মুখোপাধ্যায়, অমল পালেকার প্রমুখ ব্যক্তিত্ব। কর্মশালায় অংশগ্রহণের পাশাপাশি তাঁদের তত্ত্বাবধানে বিখ্যাত সব নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল। যেমন- গোত্রহীন, বলিদান, চিরকুমার সভা ইত্যাদি। আজ আর সেটা শুধু বাংলা ভাষাতেই আবদ্ধ নেই। ভারতসহ গোটা বিশ্বের নানা ভাষাভাষীর শিল্পীরা মিলে একটা মহা- মিলন ক্ষেত্র গড়ে তুলেছেন এই নাট্যদলকে। নিউইয়র্কে গোড়াপত্তন হলেও পরবর্তী সময়ে ৯/১১ – এ হানার পর দল সমেত সবাই নিউ জার্সিতে চলে আসেন। এরপর থেকে সেখানেই গ্রুপের পরিধি বৃদ্ধি পায়। আজ নিউ জার্সির সীমানা ছাড়িয়ে তাদের জয় ধ্বজা সারা বিশ্বে প্রসারিত।
২০০৬ সাল থেকে ‘ এপিক অ্যাক্টরস ওয়ার্কশপ’ শুরু করেছে সাউথ এশিয়ান থিয়েটার ফেস্টিভ্যাল। এখন বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এই গ্রুপ নাটকের আমন্ত্রণ পায়। নতুন বছরের শুরুতেই কলকাতা আন্তর্জাতিক বাংলা নাট্যোৎসব ২০২৫ – এ অ্যাকাডেমিতে প্রদর্শিত হবে তাদের ‘নিরস্ত্র’ নাটক। এর আগেও বহুবার বাংলায় নাটক নিয়ে ফিরে এসেছেন। স্থান বদল হলেও, শিকড়ের টান থেকে ছিন্ন হন নি আদ্যন্ত এই নাট্যপ্রেমী। ইতিমধ্যেই দেশ- বিদেশে পুরস্কৃত হয়ে কাজের স্বীকৃত পেয়েছেন তিনি। তবে শুধু যে নাটকের মধ্যেই আবদ্ধ আছেন তা নয় ৬৮ বছরেরও ‘টরো’- বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ অফ ফার্মাসিতে পড়ান। প্লেসমেন্ট সামলানোর দায়িত্বও তাঁর কাঁধে। তিনি ফার্মাসিউটিক্যালস সংস্থার কাজ করা কালীন প্রচুর গবেষণা করেছেন। ওষুধ নিয়ে গবেষণার জন্য তিনটে পেটেন্ট পান। আবার অধ্যাপনার বাইরে তিনি শুধু নাট্যকর্মীই নন, একজন সমাজকর্মী হিসেবেও নিজের পরিচয় দেন। তাই সমাজের অনেক দায়- দায়িত্ব সামলানোর কাজ করেন নিজের হাতে। সেই কাজের উদাহরণ অজস্র। ২০১০ সালে হাইতির ভূমিকম্পের পর যেমন সেখানে মেডিক্যাল ক্যাম্প করতে ছুটে যান। তেমনি খুব সম্প্রতি ইউক্রেন- রাশিয়ার যুদ্ধের সময় পোল্যান্ডে পৌঁছে শরণার্থীদের চিকিৎসা পরিষেবা দিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ান। আবার কোভিডের সময় ২০০০ মানুষকে একা হাতে ভ্যাকসিন দেন।
তবে দীপন রায় জানান, ‘ ভবিষ্যতে এপিক অ্যাক্টরস ওয়ার্কশপ মানুষের মধ্যে শুধু বিনোদন প্রদানই করবে না,পাশাপাশি সমকালীন নানা সামাজিক বার্তা নিয়ে হাজির হবে। যাতে সমাজের মধ্যে সে ব্যাপারে সচেতনতা গড়ে তোলা যায়। এধরনের একটি প্রযোজনার সঙ্গে ইতিমধ্যেই তাঁরা যুক্ত হয়েছেন।’