কল্যাণ চক্রবর্তী ও অরিত্র ঘোষ দস্তিদার।
আজ বাঙালি ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার (০৪/১২/১৮৮৮) -এর জন্মদিন। বাঙালির ইতিহাস ভাবনার অভাব নিয়ে একসময় বঙ্কিমচন্দ্রকে দুঃখ করতে দেখেছি, ‘বাঙালির ইতিহাস নাই।’ সাহেবরা পাখি মারতে গেলেও তার ইতিহাস লিখে রাখে, কিন্তু বাঙালির ইতিহাস নেই। বাঙালির সত্যিকারের ইতিহাস যখন লিখতে শুরু করলেন ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার, তখনই তাঁকে ‘ক্লোজ’ করার প্রক্রিয়া শুরু হল। আমরা মিথ্যা ইতিহাস পড়া নিয়ে যে প্রতিবাদ করি না, করি নি, তা এক গভীর ষড়যন্ত্র। সেই ষড়যন্ত্রে রমেশচন্দ্র লিখিত ইতিহাসকে মাটিচাপা দিয়েছে ষড়যন্ত্রী ইতিহাসবেত্তারা।
পরাধীনতা থেকে ভারতবর্ষের মুক্তিলাভ যে আজাদ হিন্দ ফৌজের কারণেই ঘটেছিল, তা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রকাশ করেছিলেন রমেশচন্দ্র। “সুভাষচন্দ্রের ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ গঠনের ফলে ইংরেজ বুঝিতে পারিল যে প্রধানত যে ভারতীয় সিপাহী সৈন্যের সহায়তায় তাহারা ভারতবর্ষ জয় ও এতদিন রক্ষা করিয়া আসিতেছিল, অতঃপর তাহাদের উপর আর নির্ভর করা যায় না। সুতরাং ইংরেজ শ্রমিকদল মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করিয়াই ভারতবাসীকে স্বাধীনতা দিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিল।” ড. মজুমদারের মত এখনও ভারতবর্ষের অসংখ্য ইতিহাস-সচেতন মানুষ মনে করেন, ভারতের মুক্তিলাভের কৃতিত্ব একলা মহাত্মা গান্ধীর প্রাপ্য নয়। হৃদকম্প বাড়ানো দুটি ঘটনার পর ব্রিটিশরা দু’টি গুরুত্বপূর্ণ দৌত্যকার্যের সূত্রপাত করেছিল ভারতবর্ষের স্বাধীনতার লক্ষ্যে। প্রথম, জাপানি সৈন্য রেঙ্গুন দখলের পরে পরেই ভারতকে পূর্ণ স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দিতে ভারতে আসেন ব্রিটিশ দূত স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস। আজাদ হিন্দ ফৌজ তখন জাপানে দানা বাঁধছে। দ্বিতীয়, নেতাজীর বীরত্বে ও কর্মে দেশীয় সেনানীদের মধ্যে ইংরেজদের প্রতি অনুগত্যের শিথিলতা ঘটালো। তাই নৌ-বিদ্রোহের পরদিন ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন, স্বাধীন ভারতের সংবিধান সংক্রান্ত কাজে শীঘ্রই ভারতীয় নেতৃত্বের সঙ্গে মিলিত হতে আসবেন তিনজন সদস্যের ক্যাবিনেট মিশন। তাছাড়া ১৯৪৭ সালের অনেক আগেই গান্ধীর সক্রিয়তা বন্ধ হয়েছিল। ১৯৩৩ সালে গান্ধীর ডাকে আইন অমান্য আন্দোলন ব্যর্থ-পরিত্যক্ত হয়েছিল। ফলে ১৯৪৭ সালে এমন কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে নি, যার জন্য রাজ্যপাট ছেড়ে চলে যাওয়া যায়। প্রকৃত কারণ, নেতাজি এবং তার আজাদ হিন্দ ফৌজ ও সরকার ব্রিটেনের ঘুম ছুটিয়ে দিয়েছিল।
ক্ষমতা হস্তান্তর পর্বের ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লর্ড অ্যাটলি-র ঐতিহাসিক উদ্ধৃতির সাক্ষ্য হাজির করিয়েছিলেন ড. মজুমদার। অ্যাটলি পরে স্বীকার করেছেন, ইংরেজদের তাড়াহুড়ো করে ভারত ত্যাগের মূল কারণ হল নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এবং গান্ধীর কার্যকলাপের প্রভাব Minimal.
ঐতিহাসিক মজুমদারের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দেখতে পাই। তিনি লিখেছিলেন, “ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার বহু সুসন্তান সমগ্র ভারতে এবং কয়েকজন সমগ্র বিশ্বে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়া বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করিয়া গিয়াছেন। বিংশ শতাব্দীতে যাঁহারা জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে বিশ্বজগতে তো দূরের কথা সমগ্র ভারতে প্রসিদ্ধি বা মর্যাদা লাভ করিয়াছে এরূপ বাঙালি নাই বলিলেই চলে। ইহার এক ব্যতিক্রম শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।” আমরা দেখতে পাই, নোয়াখালিতে হিন্দু গণহত্যার পর অখণ্ড ভারতের প্রবক্তা শ্যামাপ্রসাদ বলতে বাধ্য হলেন, ভারত ভাগ হোক বা না হোক, বাংলাকে খণ্ডিত করতেই হবে, তা না হলে বাঙালি-হিন্দু-সমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে। এই ভাবনায় সাথী হয়েছিলেন বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের একাংশ। ১৯৪৭ সালের ২২ শে এপ্রিল নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত জনসভায় শ্যামাপ্রসাদকে সমর্থন করে বক্তব্য রাখলেন ঐতিহাসিক ড. সুরেন্দ্রনাথ সেন। সেই বছর একটি তারবার্তা সরকারের কাছে পাঠালেন শিক্ষাবিদদের একটি দল, তাতে সামিল হলেন ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার, বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা, ড. শিশির মিত্র, ভাষাচার্য ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়। তারা লিখলেন, বাংলাদেশে একটানা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছে এবং শিক্ষা, ব্যবসা ও শিল্প ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। নানান সভায় ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার বঙ্গভঙ্গের সমর্থনে কথা বলেছিলেন। ফলে ইতিহাস সচেতন ব্যক্তি হিসাবে তাঁর মূল্যবান মতামত সেইসময় বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়েছিল, বাংলা ভাগ করেই হিন্দু বাঙালিকে বাঁচাতে হবে এবং বাঁচাতেই হবে। আজকে পশ্চিমবঙ্গের নিরাপদ মাটিতে দাঁড়িয়ে সংখ্যালঘু তোষণের নায়কেরা এবং ছদ্ম নিরপেক্ষতার ধ্বজাধারীরা যেভাবে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, তা কিন্তু ড. শ্যামপ্রসাদ মুখার্জী, ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখের তৈরি করে দেওয়া বঙ্গভূমিতে।
ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখিত বাংলার ইতিহাস বাঙালির অবশ্যপাঠ্য হওয়া উচিত। দিকে দিকে তাঁর মতো সত্যনিষ্ঠ ইতিহাসবিদের নির্মাণ যত ঘটবে, ততই বাঙালিকে নতুন দিশা দেখাতে সক্ষম হবে ইতিহাস-ভাবনা। কারণ ইতিহাসের সত্য-শিক্ষা থেকে এগিয়ে যাওয়ার মতো সদর্থক দৃষ্টিভঙ্গি আর কিছুই হতে পারে না। ঔপনিবেশিকতাবাদের বিপ্রতীপে Decolonization এর জন্য প্রয়োজন হলো সঠিক ইতিহাস চর্চা। বামেদের “Cancel culture” এর শত বিরোধিতা সত্ত্বেও আজ তার লেখা বই – “The History of Bangal” দেশপ্রেমিকদের অতি জনপ্রিয়। তাই এই ইতিহাসের এক মূল গবেষক ও কাণ্ডারি হয়ে ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার আমাদের পরম পূজ্য হয়েছেন।