বড়মা বীণাপাণি ঠাকুরের তালা বন্ধ ঘরের বাইরে প্রণাম করে রাজ্যসভায় শপথ নিতে গেলেন মমতাবালা ঠাকুর। চোখে জল। জানালেন, সুযোগ পেলে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে শান্তনুর বিরুদ্ধে নালিশ জানাবেন তিনি।
রাজ্যসভায় শপথ নেওয়ার জন্য ঠাকুরবাড়ি থেকে রওনা হওয়ার সময় আবেগতাড়িত মমতা ঠাকুর কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “মতুয়া সমাজের প্রথম নারী হিসেবে রাজ্যসভায় শপথ নিতে যাওয়ার সময় নিজের ঘর থেকে যেতে পারলাম না । বড়মার তালা বন্ধ ঘরের বাইরে প্রণাম করে যেতে হচ্ছে। ভিক্ষা চেয়ে পুলিশের সহযোগিতায় ঘরে ঢুকে নিজের জিনিসপত্র নিতে হয়েছে। এ কোন সমাজে বাস করি!”
মমতা ঠাকুর জানিয়েছেন, তাঁর জীবনের সবথেকে বেদনাদায়ক দিন। বললেন, “যে ঘরটায় আমি এতদিন থেকে এসেছি, সেই তালা বন্ধ ঘরের বাইরে প্রণাম করতে হল আমাকে। সম্ভব হলে প্রধানমন্ত্রী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে শান্তনুর বিরুদ্ধে নালিশ জানাব।”
এ কথা কানে যেতেই তীব্র ভাষায় আক্রমণ শানালেন শান্তনু। তিনি বলেন, “মমতা ঠাকুরের নিজের কর্মের ফল। কেঁদে কোনও লাভ নেই। ওঁর কর্মকাণ্ড আগামীতে সামনে আসবে । প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও জানেন উনি কেমন নাটক করতে পারেন। “
মতুয়া মহাসঙ্ঘের নিয়ন্ত্রণ মমতাবালা ঠাকুর নাকি শান্তনু ঠাকুর, কার হাতে থাকবে তা নিয়ে পরিবারের অন্দরে বিবাদ দীর্ঘদিনের। শান্তনুর বিরুদ্ধে তহবিল তছরুপের অভিযোগ ওঠার পর বিষয়টি নিয়ে আরও চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। বড়মার ঘর দখল নিয়ে রবিবার বিকেল থেকে নতুন করে তেতে ওঠে ঠাকুরনগরের ঠাকুরবাড়ি। পরিস্থিতি এতটাই অপ্রীতিকর হয়ে ওঠে, মন্দির প্রাঙ্গনে রীতিমতো ক্ষোভ উগরে দেন ভক্তরাও।
শনিবার শুরু হয়েছে মতুয়াদের ধর্ম মহামেলা। এই বারুণীর মেলার জন্য বছরভর অপেক্ষায় থাকেন মতুয়াভক্তরা। এবার মমতাবালা আর শান্তনু ঠাকুরের দ্বন্দ্বে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছেন মেলা উপলক্ষ্য়ে ঠাকুরনগরের ঠাকুরবাড়িতে আসা মানুষজন। সোমবার মন্দির প্রাঙ্গনে রীতিমতো ক্ষোভ উগরে দিলেন তাঁরা। তাঁদের বক্তব্য, “এটা তীর্থস্থান। কেন প্রত্যেকবার দুই পরিবারের দ্বন্দ্ব দেখতে হবে তাঁদের!”
রবিবার সন্ধ্যায় বীণাপাণি দেবীর মন্দির চত্বরে তুমুল উত্তেজনা ছড়ায়। মমতাবালা ঠাকুরের অভিযোগ, বড় মা বীণাপাণি দেবীর মন্দির জোর করে শান্তনু ঠাকুরের নিরাপত্তায় থাকা কেন্দ্রীয় বাহিনী দখল করে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, বেশ কয়েকজন ভক্তকে মারধরও করা হয়েছে। তারপরই তৃণমূলের তরফ থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় এই ভিডিও পোস্ট করা হয় । যদিও এই ভিডিওর সত্যতা যাচাই করেনি দেশের সময়।
মমতাবালা এবং শান্তনু ঠাকুরের দ্বন্দ্ব নতুন কিছু নয়। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) এবং জাতীয় নাগরিক পঞ্জিকে (এনআরসি) ঘিরে লোকসভা নির্বাচনের আগে তা অন্য মাত্রা পেয়েছে। সম্প্রতি আবার শান্তনুর বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ এনেছেন মমতাবালা। সেই ইস্যু কলকাতা হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে। পাল্টা মমতাবালার বিরুদ্ধেও অভিযোগ করেছেন শান্তনু। আসলে মহাসঙ্ঘের নিয়ন্ত্রণ মমতাবালা ঠাকুর নাকি শান্তনু ঠাকুর, কার হাতে থাকবে তা নিয়ে পরিবারের অন্দরে বিবাদ দীর্ঘদিনের। তহবিল তছরুপের অভিযোগ ওঠার পর বিষয়টি নিয়ে আরও চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়।
শাসক শিবিরের দাবি, শান্তনু ঠাকুর এবং তাঁর দলবল মমতাবালা ঠাকুরের বাড়িতে হামলা করেছে। মমতাবালা এবং তাঁর মেয়েকে সারারাত বাড়ির বাইরে থাকতে বাধ্য করেছে। তাঁর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে সে প্রসঙ্গে প্রতিক্রিয়ায় শান্তনু বলেন, ”আমাকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী এমন একজনকে সাংসদ বানিয়েছেন যিনি ঠাকুরবাড়ির গরিমা, ইতিহাস, সৌজন্য কিছু জানেন না। আমি কোনও ডাকাতি করতে বা চুরি করতে ঢুকিনি। অনেকবার তালা খুলতে বলা হয়েছিল। কিন্তু কেউ শোনেননি। তাই তালা ভাঙতে বাধ্য হয়েছি।”
রবিবারের এই ঘটনায় ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন ভক্তরা। শিলিগুড়ি থেকে আসা সুচন্দ্রা বিশ্বাস বলেন, “হাজার হাজার টাকা খরচ করে আমরা এখানে আসি। সংসারে এত অভাব, তবুও পয়সা বাঁচাই ঠাকুরবাড়িতে আসার জন্য। সেতো একটু শান্তি পাওয়ার জন্যই। এরা এখানে এমন অশান্তির পরিবেশ তৈরি করে রাখলে কেন আসব আমরা। এদের পরিবারের বিবাদে আমরা অশান্তি ভোগ কেন করব”! আরেক ভক্ত সুলতা বিশ্বাস বলেন, “আমরা চাই ঠাকুরবাড়ির এই অশান্তি আজকেই মিটে যাক। কে তৃণমূল, কে বিজেপি, ওসব আমরা জানি না। আমরা আসি ভালবেসে, একটু শান্তির খোঁজে। ঈশ্বরকে অনুভব করতে এসে কেন এসব অশান্তি সহ্য করব। এখনই এরা এসব বন্ধ করুক।” রবিবার ঠাকুরবাড়িতে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল তার পুনরাবৃত্তি যাতে আর না হয়, সেই দাবিও জানিয়েছেন তাঁরা।