দেশের সময়: চিনি আমাদের শরীরের জন্য বিষ। চিনির মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ক্যালোরি থাকে। বাইরের জুস, শেক, কোল্ডড্রিংক, মিষ্টি এসব একেবারেই এড়িয়ে চলুন। খুব ইচ্ছে হলে মাঝেমধ্যে এক টুকরো ডার্ক চকোলেট খেতে পারেন। যে কোনও মিষ্টি সিরাপ চটজলদি রক্তে শর্করা বাড়িয়ে দেয়। আর তাই চিনি মেশানো জলের পরিবর্তে সাধারণ জল খান বেশি করে।
ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের তথ্য বলছে, প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষরা প্রতিদিন গড়ে ২৪ চা চামচ চিনি খান। যা ৩৮৪ ক্যালোরির সমান। এই চিনি হার্টের স্বাস্থ্যের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। JAMA ইন্টারনাল মেডিসিনে ২০১৪ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দাবি করা হয়েছে, যাঁরা অতিরিক্ত চিনি খান, তাঁদের হার্টের অসুখের ঝুঁকি অনেকখানি বেড়ে যায়। ১৫ বছর ধরে চালানো ওই গবেষণায় দাবি করা হয়েছে, যাঁরা অতিরিক্ত চিনি গ্রহণের মাধ্যমে তাঁদের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ক্যালোরির ১৭-২১ শতাংশ পেয়েছেন, তাঁদের কার্ডিওভাস্কুলার রোগে মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে গিয়েছে ৩৮ শতাংশ।
চিনি কীভাবে আমাদের হার্টকে ক্ষতি করে তা সরাসরি বোঝা যায় না। এর কতগুলি পরোক্ষ কারণ আছে। বেশি পরিমাণে চিনি আমাদের লিভারকে ওভারলোড করে। লিভার তখন চিনিকে অ্যালকোহলের মতোই বিপাক করে। এবং খাদ্যের কার্বোহাইড্রেটকে চর্বিতে রূপান্তরিত করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই চর্বি জমা হতে থাকে। ফলে ফ্যাটি লিভারের সমস্যা দেখা দেয়। যা পরোক্ষে ডায়াবেটিক ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। তাছাড়া অতিরিক্ত চিনি খেলে বাড়তে পারে রক্তচাপ। ওঠানামা করে হরমোনের মাত্রা। বৃদ্ধি পায় কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা।
নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, অতিরিক্ত চিনি খাওয়ার ফলে নানা রোগে প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষের মৃত্যু হয়। হিসেব করলে দেখা যাবে, সংক্রামক রোগে পৃথিবীতে যত মানুষের মৃত্যু হয়, তার চেয়ে বেশি মানুষ মারা যান শুধুমাত্র বেশি চিনি খেয়ে শরীরে নানা রোগ ডেকে এনে।
মার্কিন সরকারের ডায়েটারি গাইড লাইন বলছে, আমরা দিনে যতটা পরিমাণ ক্যালোরি গ্রহণ করি, তার ১০-১৫ শতাংশেরও কম আসা উচিত চিনি থেকে। নাহলেই বিপদের হাতছানি। কিন্তু বিভিন্ন সমীক্ষা বলছে, খুব লোকই আছেন, যাঁরা এই গাইড লাইন ফলো করেন। বরং দেখা গিয়েছে, বহু মানুষ রয়েছেন, যাঁরা দিনে চিনি থেকে ২৫ শতাংশেরও বেশি চিনি থেকে ক্যালোরি গ্রহণ করছেন। এই সমস্ত মানুষেরাই ধীরে ধীরে বিপদের দিকে চলে যাচ্ছেন।
শুধু যে চায়ে চিনি খাওয়া বন্ধ করলাম আর শরীরে চিনি ঢোকা বন্ধ হয়ে গেল এমনটা কিন্তু মোটেও নয়। প্রসেসড খাবারে প্রচুর পরিমাণে চিনি থাকে। যেমন কর্নফ্লেক্স, পাউরুটি, বিস্কুট, মেয়োনিজ প্রভৃতি। ফলে চিনি খাওয়া বন্ধ করতে চাইলে এসব খাবারেও লাগাম টানতে হবে। নাহলে কোনও লাভ নেই। সেই সঙ্গে বন্ধ করতে হবে প্যাকেটজাত ফলের রস, বিয়ার, সস, কেচাপ, ক্যান্ডি, ঠান্ডা পানীয়ের মতো খাবারও।
অনেকে আবার চিনি খাওয়া বন্ধ করে কৃত্রিম চিনি খান। তাঁরাও নিজেদের অজান্তে বিপদ ডেকে আনছেন। কারণ, কৃত্রিম চিনিতে থাকে অ্যাসপারটেম। এটিও নানা সমস্যা তৈরি করতে পারে শরীরে। দেখা গিয়েছে, অতিরিক্ত মাত্রায় কৃত্রিম চিনি খাওয়ার ফলে মাইগ্রেন, দৃষ্টিশক্তির সমস্যা, গা বমিভাব, ঘুমের সমস্যা, পেট ব্যথা, শরীরের বিভিন্ন সন্ধিতে ব্যথা, মানসিক অবসাদের মতো উপসর্গের পাশাপাশি মস্তিস্কে ক্যান্সারের আশঙ্কাও বেড়ে যেতে পারে। বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ, খেতেই যদি হয়, তাহলে প্রাকৃতিক চিনি খান। গুড়, আখের রস, নারকেল চিনি, খেজুর, কিসমিস বা শুকনো কিংবা টাটকা ফল।
তবে মাথায় রাখতে হবে এই সমস্ত খাবারে ক্যালোরি বেশি। ফলে মোটেই মাত্রা ছাড়া খাবেন না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আখের রস থেকে চিনি বানানো হয়। কিন্তু বানানোর সময় এমন সব প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যায় যে, যাবতীয় গুণ নষ্ট হয়ে যায়। তাছাড়া এতে মেশে সালফার ডাই অক্সাইড নামে ক্ষতিকর রাসায়নিক। যা থেকে শ্বাসকষ্টের প্রকোপ বাড়তে পারে। আন্তর্জাতিক হিসেব অনুযায়ী, চিনিতে সালফার ডাই অক্সাইডের মাত্রা যা থাকার কথা, তার চেয়ে প্রায় সাতগুণ বেশি থাকে। ফলে চিনি খাওয়ার ক্ষেত্রে আজ থেকেই সতর্ক হোন।
আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের পরামর্শ, মহিলারা দিনে ১০০ ক্যালোরির বেশি (৬ চা চামচ কিংবা ২৪ গ্রাম) এবং পুরুষরা দিনে ১৫০ ক্যালোরির বেশি (প্রায় ৯ চা চামচ বা ৩৬ গ্রাম) চিনি কোনওমতেই গ্রহণ করতে পারবেন না। এটি ১২ আউন্স ক্যানের সোডার পরিমাণের কাছাকাছি।
পুষ্টিবিদদের পরামর্শ, চায়ে মিষ্টি খাওয়া একেবারেই ছাড়তে না পারলে চিনির বদলে মিশিয়ে নিন গুড়। এতে শরীরে কম ক্যালোরি ঢুকবে। আবার মিষ্টির স্বাদও অটুট থাকবে। এছাড়া গুড় আমাদের হজমশক্তি বৃদ্ধি করে। কারণ, গুড়ের মধ্যে থাকে নানা ধরনের ভিটামিন ও খনিজ। যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারি। তাছাড়া গুড়ে আয়রন থাকে। ফলে যাঁরা রক্তাল্পতার সমস্যায় ভুগছেন, তাঁদের জন্যও গুড় দেওয়া চা ভালো।
অনেক সুগারের রোগী চা কিংবা কফিতে চিনির বিকল্প হিসেবে নন সুগার সুইটনার যোগ করে খান। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি এমনটা করে থাকেন, তাহলে আজই ছাড়ুন। কারণ, এই নন সুগার সুইটনারে এমন কিছু ক্ষতিকর রাসায়নিক রয়েছে, যা নষ্ট করে দিতে পারে আপনার ডিএনএ। এমনকী ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে কয়েকগুণ। এমনই আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে আমেরিকার নর্থ ক্যারোলিনা স্টেট ইউনিভার্সিটির একটি গবেষণায়।
জার্নাল অব টক্সিকোলজি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল হেলথে প্রকাশিত হয়েছে নর্থ ক্যারোলিনা স্টেট ইউনিভার্সিটির ওই গবেষণা রিপোর্ট। অধ্যাপক সুসান শিফম্যানের নেতৃত্বে চলা ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, চিনির বিকল্প হিসেবে বেকড খাবার, ঠান্ডা পানীয়, চুইংগাম, হিমায়িত দুগ্ধজাত ডেজার্ট সহ বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যে ব্যবহৃত হয় কৃত্রিম সুইটনার। লক্ষ লক্ষ মানুষ এসব খাবার খান। ডায়াবেটিক রোগীরাও চিনির পরিবর্তে এই সুইটনার ব্যবহার করে থাকেন খাবারে। তাঁরা মোটেই এর বিপদ সম্পর্কে অবহিত নন।
গবেষকদের দাবি, কৃত্রিম সুইটনার চিনির চেয়ে অন্তত ৬০০ গুণ বেশি মিষ্টি, জিরো ক্যালোরি সমৃদ্ধ এই সুইটনার লাগাতার খেলে শরীরে বাসা বাঁধতে পারে ক্যান্সার। এই সুইটনারে থাকে সুক্রালোজ। যা মানবদেহে সুক্রালোজ-৬-অ্যাসেটেট নামক যৌগে ভেঙে যায়। এটি আমাদের অন্ত্রের আস্তরণের ক্ষতি করে। শিফম্যানের দাবি, সুক্রালোজ-৬-অ্যাসিটেট যৌগটি প্রদাহ, অক্সিডেটিভ স্ট্রেস ও ক্যান্সারের সঙ্গে যুক্ত জিনগুলিকে সক্রিয় করে তোলা। আমাদের গবেষণায় মানবদেহের টিস্যু ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে গবেষণাটি সরাসরি মানবদেহের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
কৃত্রিম চিনি বা আর্টিফিশিয়াল সুইটনার, যা নিয়ে গোটা পৃথিবীতে লক্ষ কোটির ব্যবসা চলছে, তা যে কীভাবে আমাদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে, সেটা বোঝার জন্য আরও একটি গবেষণা রিপোর্ট দেখা যাক। ২০০৯ সালে ফ্রেঞ্চ ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর হেল্থ অ্যান্ড মেডিক্যাল রিসার্চের একদল গবেষক আর্টিফিশিয়াল সুইটনার নিয়ে তথ্য সংগ্রহ শুরু করেন। সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ছিল প্রায় এক লক্ষ ৩ হাজার ৩৮৮ জন। তাঁদের গড় বয়স ছিল ৪২ বছর। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৮০ শতাংশ ছিলেন মহিলা। তাঁদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের জন্য ইন্টারনেটেরও সাহায্য নেওয়া হয়েছিল।
২৪ ঘণ্টার মধ্যে একজন ব্যক্তি খাবারের মাধ্যমে কিংবা সরাসরি চিনির বিকল্প হিসেবে কতটা পরিমাণ সুইটনার ব্যবহার করছেন, সেটাই দেখা হয় সমীক্ষায়। খাবারের মাধ্যমে শরীরে সুইটনার প্রবেশের উৎস হিসেবে নজরে রাখা হয় বেভারেজ, টেবল টপ সুইটনার, ডেয়ারি পোডাক্টে ব্যবহৃত সুইটনারের সঙ্গে অ্যাসপার্টেম, এসিসোফেম পটাশিয়াম কিংবা সুক্রালোজের মতো কিছু ব্যবহার করা হচ্ছে কি না সেদিকে। দেখা যায়, সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৩৭ শতাংশ ব্যক্তি দিনে গড়ে ৪২.৪৬ মিলিগ্রাম আর্টিফিশিয়াল সুইটনার খাচ্ছেন। বলে রাখা ভালো, এই পরিমাণ সুইটনার থাকে ১০০ মিলি ডায়েট সোডায় কিংবা এক প্যাকেট টেবিল টপ সুইটনারে। সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে কারা সবচেয়ে কম এবং বেশি মাত্রায় আর্টিফিশিয়াল সুইটনার খাচ্ছেন, নজর রাখা হয় সেদিকেও।
দেখা যায়, কিছু মানুষ সবচেয়ে কম দিনে ৭.৪৬ মিলিগ্রাম আর্টিফিশিয়াল সুইটনার গ্রহণ করছেন। আবার কিছু মানুষ দিনে সর্বোচ্চ ৭৭.৬২ মিলিগ্রাম সুইটনার সেবন করছেন। সুইটনার সেবন করেন না, এমন ব্যক্তিদের তুলনায় যাঁরা উচ্চ মাত্রায় সুইটনার ব্যবহার করেন, তাঁরা বয়সে ছিলেন তরুণ, তাঁদের বডি মাস ইনডেক্সও ছিল বেশি। তবে তাঁদের ধূমপানের অভ্যাস ছিল। তুলনায় তাঁরা কম কায়িক পরিশ্রম করতেন। কিন্তু তাঁরা আবার ওজন কমানোর ডায়েট অনুসরণ করতেন। এমনকী সারাদিনে খাবারের মাধ্যমে এনার্জি গ্রহণের মাত্রাও ছিল কম। মদ্যপান বিশেষ করতেন না। স্যাচুরেটেড এবং পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট, ফাইবার, কার্বোহাইড্রেট, ফল এবং শাকসব্জি খাওয়ার মাত্রাও ছিল কম। তবে সোডিয়াম, রেডমিট, প্রসেসড মিট, দুগ্ধজাত খাবার, চিনিহীন বেভারেজ গ্রহণের মাত্রা ছিল বেশি।
ন’বছর ধরে সমীক্ষা চালানোর পর অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে এক হাজার ৫০২ জনের কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজ সম্পর্কিত ঘটনা লক্ষ করা যায়। এ ধরনের উপসর্গের মধ্যে ছিল হার্ট অ্যাটাক, অ্যানজাইনা, অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি, ট্রানজিয়েন্ট ইস্কিমিক অ্যাটাক এবং স্ট্রোক। গবেষকরা দেখেন, কৃত্রিম চিনি খান না, এমন ব্যক্তিদের তুলনায় সুইটনার সেবন করেন, এমন ব্যক্তিদের কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজ হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধির সঙ্গে আর্টিফিশিয়াল সুইটনারের সংযোগ রয়েছে। গবেষণা রিপোর্ট বলছে, উচ্চ মাত্রায় আর্টিফিশিয়াল সুইটনার সেবন করেন এমন ২ লক্ষ মানুষের মধ্যে প্রতি বছর ৩৪৬ জন কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজে আক্রান্ত হতে পারেন। এবং সুইটনার সেবন করেন না, এমন প্রতি এক লক্ষ মানুষের মধ্যে বছরে কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজে আক্রান্ত হতে পারেন ৩১৪ জন।
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, বাজারে সুগার ফ্রি নামে অনেক খাবার বিক্রি হয়। এসব খাবারে চিনি থাকে না ঠিকই। কিন্তু মিষ্টির স্বাদ ধরে রাখতে এতে থাকে স্যাকারিন, অ্যাসপার্টেম, নিওটেম। এগুলি থেকেও ক্যান্সারের আশঙ্কা থেকে যায়।