দেশের সময়, কলকাতা: গতকাল থেকেই খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন নিয়োগ দুর্নীতিতে ধৃত সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র ওরফে ‘কালীঘাটের কাকু’। অনশন শুরু করেছেন তিনি।

বুধবার ব্যাঙ্কশাল আদালতে তাঁকে পেশ করার পর এমনটাই দাবি করল এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। এর পাশাপাশি, নিজেদের আশঙ্কার কথাও আদালতকে জানায় ইডি। ইডির আইনজীবী বিচারককে জানান, উনি কিছু না খেলে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। ইডির আধিকারিকেরা মনে করছেন, সে ক্ষেত্রে জিজ্ঞাসাবাদ এড়িয়ে যাওয়ার একটা সুযোগ থাকবে তাঁর কাছে। এর ফলে তদন্তও ব্যাহত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তাঁরা।

সুজয়ের আইনজীবীর অভিযোগ, তাঁর স্ত্রীকে গ্রেফতারির কথা জানানো হয়নি। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের আইনজীবীও অবশ্য স্বীকার করে নিয়েছেন যে সুজয়বাবু কিছু খাচ্ছেন না। ইডির আইনজীবীর বক্তব্য, ইডির প্রশ্ন এড়ানোর জন্যই এই কৌশল নিচ্ছেন কালীঘাটের কাকু। যাতে সুজয়বাবুকে ইডির প্রশ্নের মুখোমুখি না হতে হয়, সেই কারণেই তিনি খাচ্ছেন না। ইডি আইনজীবীর বক্তব্য, উনি চাইছেন, যাতে উনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।

তবে অভিযুক্ত সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র এদিন ইডির দাবির বিরোধিতা করে জানান, ‘আমি হাঙ্গার স্ট্রাইক (অনশন) করব। আমি খেতে চাইছি না বলেই ইডি দাবি করছে। তারা আরও দাবি করছে, ইডিকে ফেস না করার জন্য আমি এটা করছি।’ সেই কথা শুনে বিচারক বলেন, ‘উনি যথেষ্ট বুদ্ধি রাখেন। উনি যে খাচ্ছেন না, সেটা বুঝে শুনেই করছেন। তবে ওনার মনে রাখা উচিত, ওনার পরিবারে কেউ ওনার ফেরার জন্য অপেক্ষা করছেন।’

প্রসঙ্গত, নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় অভিযুক্ত সুজয়কৃষ্ণ ভদ্রকে ১৪ দিনের ইডি হেফাজতের জন্য এদিন আদালতে আবেদন জানান ইডির আইনজীবী। অন্যদিকে সুজয়কৃষ্ণের আইনজীবী কালীঘাটের কাকু ও তাঁর স্ত্রীর অসুস্থতাজনিত যাবতীয় নথি আদালতের কাছে তুলে ধরেন। যে কোনও শর্তের বিনিময়ে যাতে সুজয়বাবুর জামিন দেওয়া হয়, সেই আর্জি জানান তাঁর আইনজীবী।

এমনকী যেভাবে সুজয়কৃষ্ণর বাড়িতে তল্লাশি চালানো হয়েছে ও যেভাবে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাও সম্পূর্ণ বেআইনি বলে দাবি কালীঘাটের কাকুর আইনজীবীর। আইনজীবীর দাবি, সুজয়বাবু কোনও খুন বা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নেই। বাড়িতে যে তল্লাশি চালানো হয়েছে, তাও যথাযথ নিয়ম মেনে হয়নি। কোনওরকম আইনি অনুমতি ছাড়াই বাড়িতে ঢুকে তল্লাশি চালিয়েছে ইডি, দাবি সুজয়কৃষ্ণের আইনজীবীর। সুজয়বাবুর আইনজীবীর আরও প্রশ্ন, যখন তল্লাশি চালানো হয়েছে, তখন প্রসিড অব ক্রাইমের জন্য কি কিছু পাওয়া গিয়েছে? তাহলে পিএমএলএ আইন কীভাবে আনা হল? সেই সব প্রশ্ন তুলেই জামিনের আবেদন জানান সুজয়কৃষ্ণের আইনজীবী।

মঙ্গলবার রাতে নিয়োগ দুর্নীতিকাণ্ডে সুজয়কৃষ্ণকে গ্রেফতার করার পর বুধবার স্বাস্থ্যপরীক্ষার জন্য তাঁকে জোকা ইএসআই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। আদালতে ইডির তরফে জানানো হয়, সুজয়কৃষ্ণ অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন, এই আশঙ্কায় স্বাস্থ্যপরীক্ষাতেও বিলম্ব হয়েছে। আদালতে ইডির কৌঁসুলি ফিরোজ এডুলজি জানান, যে সব মোবাইল বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, সেখান থেকে বহু তথ্য পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু ফোন থেকে বেশ কিছু তথ্য মুছে ফেলা হয়েছে বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা।

আদালতে ইডি এ-ও জানায় যে, ২০১৪ সালের টেট পরীক্ষার সঙ্গে সুজয়কৃষ্ণের যোগসূত্র পাওয়া গিয়েছে। এই বিষয়ে আরও তথ্য সংগ্রহ করতে ‘কালীঘাটের কাকু’কে আরও জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন বলে মনে করছে তদন্তকারী সংস্থাটি। তাই বুধবার সুজয়কৃষ্ণকে ১৪ দিনের জন্য নিজেদের হেফাজতে চেয়ে আদালতের কাছে আর্জি জানিয়েছেন ইডির আইনজীবী। সুজয়কৃষ্ণের আইনজীবী সেলিম রহমান আদালতে অভিযোগের সুরে জানান, মঙ্গলবার রাতে সুজয়কৃষ্ণের আইনজীবী সিজিও কমপ্লেক্স (ইডি দফতর)-এ ছিলেন। কিন্তু তাঁকে গ্রেফতারির বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি।

ইডি সূত্রে খবর, ইতিমধ্যেই দুর্নীতিকাণ্ডে ধৃত এবং অভিযুক্তদের (যাঁদের মুখে বার বার ‘কালীঘাটের কাকু’ নামটি শোনা গিয়েছে) বয়ান সামনে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় সুজয়কৃষ্ণকে। কিন্তু তিনি প্রায় সব প্রশ্নেরই উত্তর এড়িয়ে যান। এমনকি মোবাইল ফোনে তাঁর সামনে যাবতীয় তথ্য তুলে ধরা হলেও, তিনি তা মানতে অস্বীকার করেন। ইডি সূত্রে খবর, সুজয়কৃষ্ণ যে তিনটি সংস্থার সঙ্গে যুক্ত, তার মধ্যে একটি সংস্থার চার আধিকারিককে আগেই তলব করেছিল ইডি। তাঁদের বয়ানও সুজয়কৃষ্ণের সামনে তুলে ধরা হয়। সেই বয়ানের ভিত্তিতে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও তিনি অধিকাংশ প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান বলে ইডি সূত্রে খবর। তার পরই তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে তাঁকে গ্রেফতার করার সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাটি।

মঙ্গলবার সকাল ১১টায় সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্সে (যেখানে ইডির দফতর রয়েছে) হাজিরা দেন সুজয়। ইডি দফতরে প্রবেশের সময় জানিয়েছিলেন যে, তিনি যথেষ্ট ‘আত্মবিশ্বাসী’। রাজ্যে শিক্ষায় নিয়োগ দুর্নীতিকাণ্ডে আগেই সিবিআই গ্রেফতার করেছিল বেসরকারি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ সংগঠনের নেতা তাপস মণ্ডলকে। তাঁর মুখেই প্রথম ‘কালীঘাটের কাকু’র কথা শোনা যায়।

নিয়োগে দুর্নীতি সংক্রান্ত তদন্তে নাম উঠে আসে গোপাল দলপতিরও। তাঁর মুখেও ‘কাকু’র নাম শোনা গিয়েছিল। এর পরেই গোয়েন্দাদের আতশকাচের তলায় চলে আসেন সুজয়কৃষ্ণ। সিবিআই সুজয়কে দু’বার তলব করে। প্রথম বার সিবিআই দফতরে গিয়ে হাজিরা দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু পরের বার নিজের আইনজীবীকে দিয়ে নথিপত্র পাঠিয়েছিলেন। সেই সময় সুজয় জানিয়েছিলেন, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার পক্ষে তাঁর কাছে কিছু নথি চাওয়া হয়েছিল। সেগুলি তিনি আইনজীবী মারফত পাঠিয়েও দিয়েছেন সিবিআই দফতরে। একই সঙ্গে সুজয় দাবি করেছিলেন, তাঁর স্ত্রী-কন্যার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের নথিও তিনি পাঠিয়েছেন আইনজীবীর মাধ্যমে।

গত ২০ মে সুজয়ের বেহালার ফকিরপাড়া রোডের ফ্ল্যাট, বাড়ি, অফিস-সহ বহু জায়গায় তল্লাশি চালায় ইডি। ওই দিনই নিয়োগ দুর্নীতিতে ধৃত কুন্তল ঘোষের চিঠি সংক্রান্ত মামলায় তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে জিজ্ঞাসাবাদ করে সিবিআই। সুজয় এক সময় অভিষেকের অফিসে কাজ করতেন। ‘কাকু’র সঙ্গে সংযোগ রয়েছে এমন ৩টি সংস্থাতেও তল্লাশি চালিয়েছিল ইডি। সেই সংস্থার মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করা হয়েছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here