( প্রথম পর্ব )
লোকবিশ্বাস ও অনুভূতি হল, কার্তিক ‘ওম ভারি’ হবার মরশুম। উত্তাপ কমে আসে, মৃদু শীতলতা ভারি হয়, আসে অঘ্রাণ। জমির ধান কাটা হয়ে বিধবা হয় মাঠ। সান্ধ্য-শোকে একমাত্র বসে আছে সেই বৃদ্ধ পেঁচা, মহানিম গাছের বিটপের আড়ালে ড্যাবড্যাবে চোখে। কুয়াশার অন্তরালে অস্পষ্টতার আঁধার। মৃত আত্মারা তখন পৃথিবীতে ফিরে আসেন! সারা বিশ্বের লোকসংস্কৃতিতে এমনই সংবাদ!
মহালয়ায় দেবীপক্ষের আগে যখন পিতৃপক্ষ, যখন পূর্বসূরীদের সতিল গঙ্গাজল নেবার সময়, তখন থেকেই পৃথিবীর চেনাপথে আরবার ফিরে আসতে ইচ্ছে হয় মৃত আত্মার। মাঝে কয়েকদিন দুর্গাপূজার আলোকসজ্জা, মা-লক্ষ্মীর আরাধনা, হৈ হুল্লোড়। তারপর আবারও ভূত সম্পৃক্তি, ‘ভূত চতুর্দশী’। এভাবে মাস দুই/আড়াই অগণন আত্মার অবাক চাহনি! কোথায় তাদের উত্তরসূরী? কেমন আছে তারা? সেই চেনা মাঠ কই? সেই দুপুরের হাট? সেই বাধানো স্নানের ঘাট? সবকিছু কি একই আছে, একই রকম, যেমনটা দেখেছিলাম! আমার অবর্তমানে শোকগাঁথা কি কিছুই গাঁথে নি উত্তর প্রজন্ম! একবারও কি ভূমণ্ডলে সেই চেনা ছবি ফিরে আসবে না? রবি ঠাকুরের কথা কী একেবারেই মিছে? “তোমার মহাবিশ্বে কিছু হারায় না তো কভু।”
মৃতেরা কি সত্যিই কোথাও আছেন? আমাদের প্রিয়জন মৃত্যুর পর কোথায় যান? আবারও কি জন্মান? তবে সারা কার্তিক মাস জুড়ে যে আকাশপ্রদীপ জ্বালান আমাদের মায়েরা, পূর্ব পুরুষের স্মৃতি তর্পণে আলোর বাতি জ্বালেন, সে বাতি কারা দেখেন?
কবি জীবনানন্দ দাশ লিখছেন —
“লীন হ’য়ে গেলে তা’রা তখন তো— মৃত।
মৃতেরা এ-পৃথিবীতে ফেরে না কখনো।
মৃতেরা কোথাও নেই; আছে?
কোনো-কোনো অঘ্রাণের পথে পায়চারি-করা শান্ত মানুষের
হৃদয়ের পথে ছাড়া মৃতের কোথাও নেই বলে মনে হয়..।”
বাস্তবের অজানা অনুভূতির পরত অল্পবিস্তর পেতে পেতে যখন নির্জনতা ও ভূত বিষয়টি সাহিত্যের পাতাতেও অনুভব করি, তুল্যমূল্য করি সাহিত্যিকের অমল প্রকাশের সঙ্গে, তখন পাঠক হিসেবে কি আমরা একাকিত্বে জারিত হই না! নিঃসঙ্গ হই না আমরা! আমরা তো অনাদি কাল থেকে নিঃসঙ্গই, যদি না পরমাত্মাকে পাই। জগৎ সংসারে এসেছি একা, যাবোও একা, ইহজগতে রোজ রোজ নানান মানুষের মতান্তরেও প্রায়শ একলা। চির নিঃসঙ্গতা ব্যক্তি মানুষের। কিন্তু এই অনবদ্য মনের নির্জনতা, এই অভূতপূর্ব একাকিত্ব থেকেই না আমাদের যাবতীয় কল্পনা, আমাদের যাবতীয় সৃষ্টি-সৃজন! ভাবা কী যায় না, ভূত নামের এক অদ্ভুত সত্তা আমাদের একলা করার মতলবে আছে! ‘একলা আমি-তে’ই আমার সিদ্ধিলাভ, জগৎ সংসারের মায়া থেকে পদে পদে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া! কোথায় সেই জানপদিক মূলস্রোত? আর কোথায়ই বা ভৌতিক সীমানা”? ভূত নামক এক পদাধিকারী সুযোগ পেলেই পরলোকের সীমানায় নিয়ে আসে আমাদের। বলে দেয়, এই তোমার আসল পরিচয়, বুঝে নাও তুমি কে! অস্তিত্ব হীনতায় ভোগার চাইতে এ কী আমার কম বড় প্রাপ্তি! এভাবেই কী বিভূতিভূষণ মালভূমির টিলাপাহাড়ে নিজেরই মৃতদেহ দেখেছিলেন? সাদাকাপড়ে আচ্ছাদিত নিজেরই শবদেহ! প্ল্যানচেটে বসে রবীন্দ্রনাথ কী দেখেছেন জীবন মরণের সীমানা ছাড়িয়ে?
( ক্রমশ )
ছবি: ফেসবুক-মেটা থেকে সংগৃহীত