সৌরভ শি চিত্রশিল্পী ক্যানভাসে এঁকেছেন শতাধিক ছবি। সৃজনশীল মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন— মানুষের জীবনযাপন।
একটা ছবিতে এক নারীর মুখাবয়বে শূন্য দৃষ্টি। প্রদর্শনীর ছবিগুলো এঁকেছেন অয়েল, অ্যাক্রেলিক, জল রং ও কালি-কলমেও। নিজের হাতে তৈরি কাগজেও বেশ কয়েকটিট ছবি এঁকেছেন সৌরভ। পেন্সিল ও তুলির টানে পোট্রেট এঁকেছেন বেশ কয়েকটি ছবি যা দেখে মনে হতে পারে দেশের সেরা পোট্রেট শিল্পীর তকমা পাওয়া কেউ আটকাতে পারবে না মাত্র ২৫ বছরের এই নবীন শিল্পীকে।
বিশেষ করে, রঙের গভীরতা, এক রং থেকে অন্য রঙে অবাধ গতিময়তা, বুনোট, রং তুলির পরিমিত ব্যবহার নজর কাড়বে। এ কী করে এমনটা সম্ভব মনে হতেও পারে এ সবও। ছবি আঁকা শেখা, চর্চার জন্য সৌরভের কাজ অবশ্যই শিক্ষনীয় হয়ে উঠবে এখনকার অঙ্কন শিক্ষার্থীদের কাছে।
সৌরভের একক প্রদর্শনী এ দিক থেকে অন্য মাত্রা এনে দেবে বলে মনে করছেন চিত্র শিল্পী, সমালোচকরাও।
সৌরভের ছবির ও রঙের শৈলীতে গ্রেট মাস্টার পেইন্টারদের প্রভাবও দেখা গিয়েছে। পাশাপাশি সৌরভের অক্লান্ত পরিশ্রমেরও ছাপ রয়েছে। তাই বলাই যায়। সৌরভের এই একক প্রদর্শনী চিত্রপ্রেমীদেরকে মুগ্ধ করবেই।
তবে ‘আনসিন’ নামাঙ্কিত প্রদর্শনীটির নামকরণে হঠাৎই মনে হতে পারে, হয়তো বা কোনও তরুণ, অপরিপক্ব শিল্পীর দ্বিধাময় কোনও অবতরণ। কিন্তু বাস্তবে তার একেবারেই বিপরীত। কারণ জানতে দেখতে আসতেই হবে সৌরভের আঁকা ছবিগুলি।
যেখানে লুকিয়ে আছে বিষয়গত দিক থেকে নেহাতই দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সুখ দুঃখের তহবিল থেকে আহরিত ছবির সব কম্পোজ়িশন। যেমন ‘পরিবার’, ‘অথবা ‘প্রতিবেশী’ নামে চিহ্নিত হয়েছে বহু কাজ। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে বিষয় যত সহজই মনে হোক না কেন, চিত্রের উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে শিল্পী যে তাঁর অভ্যন্তরীণ বৃহত্তর মানসিক সত্তাকে তুলে ধরতে প্রয়াসী হয়েছেন, তা চোখে পড়বে। মানুষের একক ব্যক্তিসত্ত্বা বা আমিত্বের আড়ালে যে সামগ্রিকতার এক পূর্ণতা লুকিয়ে থাকে, সেই ‘হোলনেস’ বা পরিপূর্ণতার সৃজনোন্মুখ আস্বাদকে প্রকাশ করাই ছবিগুলির মূল প্রতিপাদ্য বলে মনে জায়গা করে নেবে বলে বিশ্বাস শিল্পী সৌরভের।
শিল্পীমাত্রই গড়ে তোলেন তাঁর নিজের এক জগৎ। যে জগতে শিল্পীর থাকে অনায়াস বিচরণ, সেখানে হতাশা, ক্ষোভ, দুঃখের সাথে সহবাস করে উৎসাহ, আনন্দ ও বিস্ময়। এ ক্ষেত্রেও শিল্পী সৌরভ শি সেই সব দৈনন্দিন শখ, আহ্লাদ, বিষাদ, বিস্ময়কে নিজের মতো করে চিহ্নিত করে তাতে রূপ, রং, আকার সংযোজন করে সাজিয়েছেন তাঁর চিত্রমালা। জীবনমাত্রই বেঁচে থাকার লড়াইয়ে সংশয় ও দ্বিধার যে টানাপড়েন, চড়াই-উৎরাইয়ের ঘূর্ণাবর্ত, ঠিক-বেঠিকের অহর্নিশি এক প্রশ্নোত্তর, সেই সব অন্তর্নিহিত অনুভব, অনুভূতি, ভাবনার সংশ্লেষে রচিত তাঁর সব ছবি।
শিল্পী তাঁর ভাবনার গভীরে গিয়ে মানুষের সঙ্গে মানুষের সংলাপের যে ক্রিয়াকরণ, হতাশা ও অনিশ্চয়তার যে বিষাদ, সেগুলিকে অতি নান্দনিক ভাবে তাঁর নিজস্ব চিত্রভাষার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন। কিন্তু সেই সংলাপগুলি সৃষ্টি করতে গিয়ে প্রচলিত ধ্রুপদী ধারাকে বেছে না নিয়ে, কোনও ছায়াতপের ছলনাকে প্রশ্রয় না দিয়ে, শিল্পী বরঞ্চ এক লৌকিক মাধুর্যের আবরণে তাঁর মানবিক অবয়বগুলিকে মুড়ে দিয়েছেন। ফলত সরলীকৃত রেখা ও গঠনের মাধ্যমে তাঁর ভাবনাগুলি অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাবে ফুটে উঠেছে।
পাশ্চাত্যের আধুনিক পয়েন্টিলিজ়ম ধারার সমতুল্য রং ও তার বিন্যাস সৌরভের চিত্রপটগুলিতে এক ঘনত্ব ও গভীরতা প্রদান করেছে। সুতরাং বহু রঙের এই বিন্দুভিত্তিক বুনট ছবির তলকে এক স্বপ্নময় জগৎ গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। যা দেখে আপনিও অবিভূত হবেন। আগামী ৩ এপ্রিল থেকে চলবে ৯ এপ্রিল, কলকাতার অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে।