দেশের সময়: ছোট থেকেই তাঁর ভাস্কর্যের প্রতি টান। যখন সবে ক্লাস টু, গোবরডাঙার বাসিন্দা দীপক দাঁর হাত ধরে ভর্তি হয়েছিলেন রেনেসাঁস ইন্সটিটিউটে। শিশুমনের ভাবনাকে রং তুলিতে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টার শুরু তখনই। পরে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজ, তারপর বিশ্ববিদ্যালয়। ভাবনার পরিসর বেড়েছে। কিন্তু শিল্পকলাকে ছাড়তে পারেননি গোবরডাঙার সৌমেন কর। বরং তাঁর মনে আরও বেশি করে ডানা মেলেছে কল্পনার জগৎ।
একসময় রং তুলিকে পিছনে ফেলে তাঁর সৃষ্টিকর্মে প্রাধান্য পেয়েছে ভাস্কর্য। আর তারই টানে গোবরডাঙা হিন্দু কলেজে বি. কম অনার্স নিয়ে পড়াশোনা করলেও ফের ভর্তি হন কলকাতায় গভর্মেন্ট আর্ট কলেজে। সেখান থেকে ভাস্কর্যে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করার পর মাস্টার্স করতে চলে যান বরোদায়। সেখানে মহারাজ শিয়াজি ইউনিভার্সিটি থেকে মডার্ন ক্রিয়েটিভ আর্টসে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। গোটা দেশেই তাঁর শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হয়েছে। এখনও হয়ে চলেছে। ঝুলিতে এসেছে সর্বভারতীয় স্তরের বহু পুরস্কার।
আগামী ২৭ ডিসেম্বর সৌমেনবাবু তাঁর শিল্পকর্মের সম্ভার নিয়ে যাচ্ছেন জাহাঙ্গীরে। সেখানে চতুর্থবারের জন্য প্রদর্শিত হবে তাঁর ভাস্কর্য। এর আগে ২০০১, ২০০৬, ২০১৫ সালে তাঁর ভাস্কর্য প্রদর্শিত হয়েছে সেখানে। এবার ১৮টি ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য ও ১৬টি ছবি নিয়ে সেখানে হাজির হচ্ছেন তিনি। প্রদর্শনী চলবে আগামী ২ জানুয়ারি পর্যন্ত।
ভাস্কর্যের প্রতি এই টান তৈরি হল কীভাবে?
সৌমেনবাবুর কথায়, ছোট থেকেই নিজের মনের ভাবনাকে ফুটিয়ে তোলার জন্য ছটফট করতাম। কখনও ছবি আঁকতে বসতাম। কখনও আবার মাটি দিয়ে নানান কিছু বানানোর চেষ্টা করতাম। তারপর যখন নিজের কল্পনারা অবয়ব নিত, তখন এক অনাবিল আনন্দে ভরে উঠত মন প্রাণ। সেকারণেই স্কুলে কর্মশিক্ষার কাজগুলো খুব মন দিয়ে করতাম। আর পাঁচজনের থেকে অন্যরকম কিছু বানানো যায় কি না তার চেষ্টা থাকত সবসময়। সেকারণে প্রশংসিতও হয়েছি শিক্ষকদের কাছে। সেই প্রশংসা আমাকে সবসময় অনুপ্রাণিত করেছে।
শিল্পীর কথায়, ছবিতে নিজের ভাবনাকে ফুটিয়ে তোলা যায়। অনুভব করা যায়। কিন্তু ভাস্কর্যের মাধ্যমে ভাবনাকে ছুঁয়ে দেখার সুযোগ রয়েছে। এর আনন্দটাই অন্যরকম।
নিজের শহর গোবরডাঙায় ভাস্কর্য শিক্ষার জন্য স্টুডিও গড়েছেন সৌমেন কর। সেখানে সারা বছর কর্মশালা চলতেই থাকে। সরকারি পর্যায়ে সেসব কর্মশালায় যোগ দেয় গোটা রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের স্কুল, কলেজের পড়ুয়ারা। সৌমেনবাবু বললেন, ওই স্টুডিও আমার স্বপ্নের জগৎ। এখানে পা রাখলে আমি ভাবনার জগতে ডুবে যাই। সেই কল্পলোক থেকেই জন্ম নেয় আমার শিল্পেরা। সৌমেন করের, ভাস্কর্যের বিষয়, রিদম। ছন্দ। নান্দনিকতা। বললেন, প্রকৃতি থেকে জীবন। সবকিছুরই একটা নিজস্ব ছন্দ আছে। সেই ছন্দকে চিনতে পারলে, জানতে পারলে জীবনকে চেনা যায়। প্রকৃতির সঙ্গে বিলিয়ে দেওয়া যায় নিজেকে। এক দারুণ শান্তি লাভ করা যায়।
গোবরডাঙা পুরসভার নতুন ভবনের নকশা, সৌন্দর্যায়ন থেকে গোবরডাঙা হিন্দু কলেজের বাগান, বিউটিফিকেশন, সবই সৌমেনবাবুর নিজের হাতে করা। এছাড়া গোবরডাঙা পুরসভা এলাকায় বহু পার্কেরও কাজ করেছেন তিনি। তাঁর শিল্পীসত্ত্বায় নান্দনিক হয়ে উঠেছে সেসব পার্ক। গোটা দেশেই এমন বহু কাজ ছড়িয়ে রয়েছে। বললেন, শিল্পী হয়ে উঠতে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছেন সুবল সাহা, বাদল দাস, অসিত দাশগুপ্ত, সমীর ঘোষ, চিরঞ্জন রায়ের মতো ব্যক্তিকে। তবে প্রথম জীবনে তাঁর ভিতর শিল্পীসত্ত্বাকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন যিনি, গোবরডাঙা খাঁটুরা হাইস্কুলের শিক্ষক চিরঞ্জন রায় কে তিনি কোনওদিন ভুলতে পারবেন না। বললেন, শিল্পী জীবনে অনেক কিছু পেয়েছি। তবে সবচেয়ে বড় পাওয়া ললিত কলা অ্যাকাডেমিতে চিন্তামনি কর, সনৎ করের পরেই তালিকায় তাঁর নাম থাকা।
সৌমেনবাবুর স্ত্রী মৌমিতা করও একজন গুণী মহিলা। এমব্রয়ডারি কাজের সুবাদে তিনি রাজ্যে তো বটেই, গোটা দেশেও যথেষ্টই নাম করেছেন। তাঁর নিজস্ব একটি বুটিক আছে।