
দেশের সময় বনগাঁ : লক্ষ্য ছিল মতুয়াদের সমর্থন ধরে রাখা। একইসঙ্গে চ্যালেঞ্জ ছিল মতুয়াদের আশীর্বাদকে সঙ্গে নিয়ে ফের একবার বনগাঁ লোকসভা জয়। আর সেই চ্যালেঞ্জ জিতেও গিয়েছেন তিনি। এ বার ভোটে তিনি তৃণমূল প্রার্থী বিশ্বজিৎ দাসকে ৭৩ হাজার ৬৯৩ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেছেন।
এ রাজ্যে অনেক জেতা লোকসভা আসন যখন বিজেপির হাত থেকে বেরিয়ে গিয়েছে, সেই সময় নিজের গড় ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন শান্তনু। এমনকী মন্ত্রী পদে থাকা নিশীথ প্রামাণিক বা সুভাষ সরকারের মতো দাপুটে সাংসদরা যখন নিজেদের আসন ধরে রাখতে পারেননি, সেই সময় নিজের বিজয় রথ অব্যাহত রেখেছেন তিনি। আর সেই জয়ের পুরস্কারও মিলল। ফের একবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হলেন শান্তনু ঠাকুর। রবিবার রাষ্ট্রমন্ত্রী পদে বনগাঁর বিজেপি সাংসদ শান্তনু ঠাকুর -কে শপথ বাক্য পাঠ করালেন রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু।

বাংলায় এ বার বিজেপির ফল ভাল না হলেও বনগাঁ, রানাঘাটের মতো মতুয়া অধ্যুষিত আসনে বিজেপি বড় ব্যবধানে জয়লাভ করেছে।
২০১৯ সালে ভোটে জিতে বন্দর, নৌ-পরিবহণ ও জলপথ দফতরের প্রতিমন্ত্রী করা হয়েছিল শান্তনুকে।
রাজনৈতিক মতাদর্শের দিক থেকে বিগত কয়েক বছর ধরেই আড়াআড়িভাবে বিভক্ত বনগাঁর ঠাকুর বাড়ি। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের সময় তা আরও প্রকাশ্যে চলে আসে। ঠাকুর পরিবারেরই অপর সদস্য তথা তৃণমূল প্রার্থী মমতাবালা ঠাকুরের বিরুদ্ধে নির্বাচনী লড়াইতে নামেন শান্তনু ঠাকুর। আর প্রথমবার নির্বাচনী লড়াইতে নেমেই করেন বাজিমাত। ৬ লাখ ৮৭ হাজার ৬২২ ভোট পেয়ে জয়ী হন তিনি।
২০২৪ সালে ফের একবার তাঁর ওপরেই ভরসা রাখে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। বনগাঁ আসন ধরে রাখার দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয় তাঁর কাঁধেই। আর সেই দায়িত্ব অক্ষরে অক্ষরে পালন করে, মোদী-শাহদের গুডবুকে আরও অনেকটা নম্বর বাড়িয়ে নেন শান্তনু।
এবারের নির্বাচনে অবশ্য প্রথম থেকেই রাজনৈতিকমহলের বিশেষ নজর ছিল বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রের দিকে। মতুয়া সমাজের একটা বড় অংশের মানুষের দীর্ঘদিন ধরেই নাগরিকত্ব সংক্রান্ত দাবিদাওয়া ছিল। আর এবারের ভোটের আগে দেশে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা সিএএ লাগু করে কেন্দ্রীয় সরকার। যদিও রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস তথা রাজ্য সরকার প্রথম থেকেই সিএএ-র বিরোধিতা করে এসেছে। কিন্তু রাজনৈতিকমহল মনে করছে এতকিছুর পরেও বনগাঁর ভোটে এবার বড়সড় ফ্যাক্টর হয়ে ওঠে সিএএ। আর তারই সুফল হয়ত ভোটবাক্সে পেয়েছেন শান্তনু ঠাকুর। মতুয়া অধ্যুষিত বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রে বিপুল জনসমর্থন পেয়ে জয়ী হন তিনি। আর জয়ের পরেই নরেন্দ্র মোদীর মন্ত্রিসভায় দ্বিতীয়বারের জন্য জায়গা করে নিলেন বনগাঁর ঠাকুর পরিবারের এই সদস্য।
রবিবার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের আগে সকালে তাঁর বাসভবনে একটি চা-চক্রের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে শান্তনু যোগ দেওয়ায় তখনই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, শান্তনু মন্ত্রিত্ব পাচ্ছেন।

রাজনৈতিক মহলের অনেকেই মনে করছেন, মতুয়া সমাজের ভোটব্যাঙ্কের কথা মাথায় রেখেও শান্তনুকে মন্ত্রিসভায় এ বার জায়গা দেওয়া হয়েছে।
শান্তনু মতুয়া ঠাকুরবাড়ি পরিবারের সদস্য এবং অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসঙ্ঘের সঙ্ঘাধিপতি। এ রাজ্যে ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটে মতুয়া উদ্বাস্তু মানুষের ভোট টানতে শান্তনুর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে বলে মনে করেন বিজেপির অনেকে। এ সব কথা মাথায় রেখেই তাঁকে এ বার মন্ত্রী করা হল বলে মনে করা হচ্ছে।
প্রথমবার জিতে দু’বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ২০২১ সালে গিয়ে মন্ত্রী হয়েছিলেন। এ বার ভোটে জিতেই মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পেলেন শান্তনু ঠাকুর। রবিবার সন্ধ্যায় রাইসিনা হিলসে যে ৭২ জন শপথ নিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন তিনিও। দিল্লিতে শান্তনু শপথ নেওয়ার পরেই বনগাঁয় দলের কর্মী-সমর্থকেরা রাস্তায় নেমে পড়েন। বাজি ফাটতে থাকে। শুরু হয় লাড্ডু বিলি।
দ্বিতীয় বার কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিসেবে শান্তনু শপথ নেওয়ায় মতুয়া উদ্বাস্তু মানুষেরা আনন্দিত। অনেকেই জানালেন, কেন্দ্র যে নাগরিকত্ব শংসাপত্র দেওয়ার কাজ শুরু করেছে। আশা করা যায়, শান্তনু সেই কাজ আরও তরান্বিত করবেন।
বনগাঁর সাধারণ মানুষ চাইছেন, দ্বিতীয় বার মন্ত্রী হয়ে শান্তনু যেন প্রথমেই এলাকার মূল সমস্যাগুলি সমাধানের দিকে নজর দেন।

বনগাঁয় গেরুয়া আবিরও উড়ল রবি-সন্ধ্যায়। বনগাঁ উত্তরের বিধায়ক অশোক কীর্তনিয়া পথচলতি মানুষজনকে ও টোটো-অটো চালকদের লাড্ডু বিলি করেন। মতুয়ারা ডঙ্কা, কাসি বাজিয়ে আনন্দ মেতে ওঠেন। বাগদার হেলেঞ্চাতেও আতস বাজি ফাটিয়ে, মিষ্টি মুখ করিয়ে উৎসবে মেতেছিলেন বিজেপি কর্মীরা।
শহরের মতিগঞ্জের বাসিন্দা ট্যাক্সি চালক তাপস শীল বলেন, ‘‘শান্তনু ঠাকুর মন্ত্রী হওয়ায় আমরা খুশি। আমি চাইব, তিনি যেন যশোর রোড সম্প্রসারণ এবং ইছামতী নদী সংস্কারের কাজটি দ্রুত শুরু করার জন্য উদ্যোগী হন।’’ শান্তনু প্রথম বার মন্ত্রী হওয়ার সময়েও তাঁরা একই প্রত্যাশার কথা জানিয়েছিলেন।

যদিও তৃণমূলের বক্তব্য, এর আগে তিন বছর মন্ত্রী থেকেও কিছুই করেননি শান্তনু। তাই এত আনন্দের কিছু নেই। ২০১৯ সালে প্রথম রাজনীতির ময়দানে পা রেখেই বনগাঁর সাংসদ হয়েছিলেন শান্তনু। নাগরিকত্বের ইস্যুতে দু’হাত উপুড় করে বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন মতুয়ারা। কিন্তু আইন পাস হলেও সিএএ কার্যকর আর হচ্ছিল না। তা নিয়ে ক্ষোভ বাড়তে থাকে মতুয়াদের।
তৃণমূল প্রভাবিত মতুয়া কৃষ্ণ মণ্ডল বলেন, ‘শান্তনু ঠাকুর গত পাঁচ বছর সাংসদ ছিলেন। কেন্দ্রের মন্ত্রী ছিলেন প্রায় তিন বছর। কিন্তু এই সময়কালে মতুয়াদের সদস্য পদের জন্য কার্ড করানো ছাড়া কিছুই করেননি। ফলে কেন্দ্রের মন্ত্রী হয়েও উপকার হয়নি মতুয়াদের।’

জগদীশ গোঁসাই নামে আর একজন বলেন, ‘এর আগেও তিনি কেন্দ্রের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। এবারও হয়েছেন। কিন্তু প্রতিমন্ত্রীর কোনও স্বাধীন দায়িত্ব নেই। তাই শান্তনু ঠাকুর কেন্দ্রের মন্ত্রী হলেও মতুয়াদের লাভ কিছু হবে না।’
শান্তনু নিজেও বেসুরো হয়েছিলেন। বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে একাধিকবার দরবার করেছিলেন তিনি। বিজেপির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে থাকেন মতুয়ারাও। মতুয়া ভোট ব্যাঙ্কে ফাটল আন্দাজ করেই ২০২১ সালে শান্তনু ঠাকুরকে কেন্দ্রের মন্ত্রী করেন মোদী-শাহ। জাহাজ দপ্তরের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান শান্তনু।

এ বার ভোটের মুখে নাগরিকত্বের আইন কার্যকর করার বিজ্ঞপ্তি জারি করে কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। বনগাঁ কেন্দ্রের ভোট শেষ হতেই দেখা যায় বেশ কয়েকজন মতুয়া নাগরিকত্বের শংসাপত্র পেয়েছেন। বনগাঁতে সিএএ-র পক্ষেই ভোট দিয়েছেন মতুয়ারা। ৭৩ হাজার ৬৯৩ ভোটে জয়ী হন শান্তনু ঠাকুর। মতুয়া ভোটের দিকে তাকিয়ে এ বারও যে শান্তনু ঠাকুরকে কেন্দ্রে মন্ত্রী করা হবে, এমন একটা ইঙ্গিত ছিলই।
মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়ে শান্তনু ফোনে জানান, ‘‘প্রধানমন্ত্রীর নীতি-আদর্শ মেনে উন্নয়নমূলক কাজ আরও বেশি করে করব। রাজ্য সরকারের সহযোগিতা পেলে কল্যাণীতে বিমানবন্দর, যশোর রোড সম্প্রসারণ এবং ইছামতী নদী সংস্কারের কাজ করতে চাই।’’

পরাজিত প্রার্থী তথা তৃণমূলের বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার সভাপতি বিশ্বজিৎ দাসের প্রতিক্রিয়া, ‘‘গত পাঁচ বছর মন্ত্রী এবং সাংসদ হিসেবে শান্তনুর কোনও ক্রিয়াকলাপ নজরে পড়েনি। মানুষ পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এ বার আশা করব, তিনি এলাকার সমস্যাগুলি সমাধান করবেন।’’
তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ তথা অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসঙ্ঘের সঙ্ঘাধিপতি মমতা ঠাকুর বলেন, ‘‘মানুষ শান্তনুকে ভোটে জিতিয়েছেন। মন্ত্রী হয়েও গত পাঁচ বছরে মানুষের জন্য কোনও কাজ করেনি। এ বার যেন করেন, এটুকুই চাওয়া।’’
