দেশের সময়:এক ধাক্কায় লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের ভাতা দ্বিগুণ করে দিয়েছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর এতেই মাথা ঘুরে গিয়েছে বিজেপির। তারা বিলক্ষণ বুঝেছে, তাদের সব অস্ত্র ভোঁতা এই এক লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে। ফলে একে মোকাবিলা করতে না পারলে লোকসভায় বাংলাজুড়ে ধরাশায়ী হতে হবে পদ্ম ব্রিগেডকে। আর তাই বাংলায় মহিলা ভোটব্যাঙ্ক কাছে টানতে এবার নিজের কাঁধে গুরুদায়িত্ব তুলে নিলেন বিজেপির পোস্টারবয়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
বঙ্গ সফরে এসে আরামবাগ হোক কিংবা কৃষ্ণনগর সর্বত্রই নারীশক্তির জয়গান গাইলেন তিনি। বাংলার নারী জাগরণের কথা মনে করিয়ে দিয়ে সন্দেশখালির মহিলাদের তুলনা করলেন মা দুর্গার সঙ্গে। আর এভাবেই মোদি ছাপিয়ে গেলেন তাঁর দলের সেকেন্ড ইন কমান্ড অমিত শাহের টার্গেটকেও।
এর আগে শাহ বঙ্গ বিজেপিকে টার্গেট দিয়েছিলেন, এ রাজ্যে ৪২টি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে ৩৫টি চায় তাঁর। কিন্তু কৃষ্ণনগরের সভা থেকে মোদী বললেন, ৪২-এ ৪২ টার্গেট তাঁর। মোদির এই ভাষণের পর স্বাভাবিকভাবেই স্নায়ুর চাপ বাড়ল বাংলার বিজেপি নেতাদের উপর। শুধু বাংলায় নিজের টার্গেট বেঁধে দেওয়াই নয়, এবার এনডিএ সরকার ৪০০ আসন পার করবে বলেও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জানিয়েছেন মোদী।
আরামবাগের সভা থেকেই তৃণমূলকে আক্রমণ করেছিলেন মোদি। বলেছিলেন, কেন্দ্র টাকা দিলেও কাজ না করে দুর্নীতি করেছে বাংলার তৃণমূল সরকার। তবে শুধু দুর্নীতির ইস্যু উস্কে দিয়েই থেমে যাননি তিনি। দুর্নীতির টাকা ফিরিয়ে মানুষের হাতে তুলে দেওয়ার দায়িত্বও নিয়েছেন নিজের কাঁধে। বলেছেন, মোদী এত সহজে ছেড়ে দেওয়ার লোক নন। কড়াই গণ্ডায় হিসেব দিতে হবে। আর এরপরই শনিবার কৃষ্ণনগরের সভায় কয়েক ধাপ এগিয়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধে আক্রমণকে তুঙ্গে তোলেন মোদী।
বলেন, তৃণমূল মানে অত্যাচার। তৃণমূল মানে দুর্নীতিবাজ। তৃণমূল মানে বিশ্বাসঘাতক। তৃণমূল মানে পরিবারতন্ত্র। যে কোনও স্কিমকে স্ক্যামে পরিণত করে বাংলার তৃণমূল সরকার। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলকে কটাক্ষ ছুঁড়ে দিয়ে মোদী বলেছেন, টিএমসি মানে তু ম্যায় অউর করাপশন। তাঁর তোপ, মা-মাটি-মানুষের কথা বলে বাংলায় ভোট পেয়েছিল তৃণমূল। কিন্তু সেই তৃণমূলের কুশাসনের ফলে এখন বাংলার মা-মাটি-মানুষ কাঁদছে। পরিত্রাণের পথ খুঁজছে। তৃণমূল সরকার বাংলার মানুষকে গরিব বানিয়ে রাখতে চায় বলেও আক্রমণ করেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, তৃণমূল জানে এ রাজ্যের মানুষ গরিব হয়ে থাকলে তবেই তারা তাদের খেলা চালিয়ে যেতে পারবে। বাংলায় তৃণমূল সরকার গরিবের রেশন লুট করেছে বলেও কৃষ্ণনগরের সভা থেকে আক্রমণ করেছেন মোদী।
বাংলায় পাটশিল্পকে তৃণমূল সরকার ধ্বংস করে দিয়েছে বলেও অভিযোগ তাঁর। বলেছেন, পাঁচ বছর গরিব মানুষকে বিনা পয়সায় রেশন দেওয়া হবে, এটা মোদী সরকারের গ্যারান্টি। আর মোদীর গ্যারান্টি মানে গ্যারান্টি পূর্ণ হওয়ার গ্যারান্টি। প্রধানমন্ত্রীর তোপ, বাংলার মানুষ অনেক আশা করে তৃণমূল সরকারকে ভোট দিয়েছিল। কিন্তু দশ বছরে এই তৃণমূল সরকার বাংলার মানুষকে নিরাশ করেছে। বাংলার মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। মোদী বলেন, বাংলার অনেক গৌরব গাথা রয়েছে। কিন্তু তা সঠিকভাবে কাজে লাগানো হয়নি। সেকারণে বাংলা পিছিয়ে পড়েছে।
কেন্দ্রের বিজেপি সরকার বাংলায় তাই রেলের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে বিশেষ জোর দিয়েছে। বহু কাজ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর দাবি, দেশ তখনই এগিয়ে যাবে, যখন বাংলা এগবে। কিন্তু বাংলাকে এগিয়ে যেতে দিয়ে চায় না টিএমসি সরকার। মোদীর কটাক্ষ, এ রাজ্যে তৃণমূলের গুণ্ডাগিরি, তোলাবাজি করার জন্য কোনও অনুমতির প্রয়োজন হয় না। অথচ কল্যাণীতে এইমস করার সময় তৃণমূল সরকার অভিযোগ তোলে তাদের অনুমতি নেওয়া হয়নি। আসলে তৃণমূল চায় না কোনও ভালো কাজ হোক। তারা শুধু নিজেদের আখের গোছাতেই ব্যস্ত। গরিব মানুষের জন্য আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্প রয়েছে কেন্দ্রের। এতে পাঁচ লক্ষ টাকা পর্যন্ত চিকিৎসায় ছাড় পাবে গরিব মানুষ।
কিন্তু মমতার সরকার ওই প্রকল্প চালু করতে দেয়নি বলে অভিযোগ করেন মোদী। বাংলায় আইনশৃঙ্খলা নেই বলেও দাবি করে মোদীর তোপ, এরাজ্যে পুলিশ নয়, দুষ্কৃতীরা ঠিক করে, তারা কবে পুলিশের হাতে ধরা দেবে। কবে গ্রেফতার হবে। এ প্রসঙ্গে সন্দেশখালির ইস্যু উল্লেখ করে মোদী বলেন, শাহজাহান গ্রেফতার হোক, এটা কখনওই চায়নি তৃণমূল সরকার। কিন্তু সেখানকার মহিলারা মা দুর্গার মতো শক্তি নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন। এই নারীশক্তির কাছেই মাথা নত করতে হয়েছে বাংলার তৃণমূল সরকারকে।
সন্দেশখালির দুর্গাদের চাপেই শাহজাহানকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলেও দাবি করেন মোদী। প্রধানমন্ত্রীর এই বার্তার পর সন্দেশখালির মহিলারা খানিকটা খুশি হলেও এখনই পুরোপুরি আতঙ্কমুক্ত হতে পারছেন না তাঁরা। তাঁদের দাবি, দূর থেকে শুধু বার্তা দিলেই হবে না। প্রধানমন্ত্রীকে সন্দেশখালিতে আসতে হবে। তাঁদের অত্যাচারের কথা শুনতে হবে। সব কথা ক্যামেরার সামনে বলতে পারছেন না তাঁরা। কীভাবে তাঁরা বছরের পর বছর অত্যাচারিত হয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী নিজে এসে তা শুনুন।
সন্দেশখালির মহিলাদের বক্তব্য, তাঁরা চেয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একবার সন্দেশখালিতে আসুন। কিন্তু তিনি এখনও সন্দেশখালিতে পা রাখেননি। সেকারণেই তাঁরা এবার প্রধানমন্ত্রীর উপর আস্থা রাখছেন। চাইছেন, মোদী সশরীরে সন্দেশখালিতে আসুন। সামনে থেকে তাঁকে সবটা জানাতে চান তাঁরা।
মোদী তৃণমূলকে চাঁচাছোলা ভাষায় আক্রমণ করলেও শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সাক্ষাৎপর্ব শেষে মমতা অবশ্য সাংবাদিকদের জানান, যা বলার তিনি রাজনৈতিকভাবে বলবেন। এই সাক্ষাৎ শুধুমাত্র সৌজন্য। শনিবার অবশ্য পরিবারতন্ত্র নিয়ে মোদির অভিযোগের প্রেক্ষিতে তৃণমূলের মুখপাত্র শান্তনু সেনের তোপ, যে দলে পরিবারতন্ত্রের ভূরি ভূরি উদাহরণ রয়েছে, সেই দলের সর্বাধিনায়ক যখন পরিবারতন্ত্র নিয়ে কিছু বলেন, তখন ঘোড়াতেও হাসে।