দেশের সময়: আর মাত্র কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষা, তারপরেই তৃতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন নরেন্দ্র মোদী। জওহরলাল নেহেরুর পর একমাত্র মোদী পরপর তিনবার প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসতে চলেছেন।
মাঝের সময়টা ছয় দশক। তবে জহরলাল নেহেরুর সঙ্গে মোদীর এবারের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পার্থক্য একটাই, শরিকদের কাঁধে ভর করে কুর্সিতে বসতে হচ্ছে তাঁকে। এদিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদীর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান ঘিরে দিল্লির রাইসিনা হিলসে এখন সাজো সাজো রব। আজ রবিবার সন্ধ্যা সোয়া সাতটায় প্রধানমন্ত্রী পদে শপথগ্রহণ করবেন মোদী। আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে সাত রাষ্ট্রপ্রধানকে। ডাক পেয়েছেন রূপান্তরকামী ও সাফাইকর্মীরা। সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রকল্পে যে সমস্ত শ্রমিক কাজ করেছেন, আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে তাঁদেরও।
এছাড়াও মোদীর মন কি বাতে অংশগ্রহণকারীরা থাকছেন আজ প্রধানমন্ত্রীর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে। ডাক পেয়েছেন পদ্মশ্রী ও পদ্মভূষণ পুরস্কার প্রাপকরাও। থাকবেন ধর্মগুরুরা। সব মিলিয়ে দেশ-বিদেশের ৮০০০ অতিথির আজ উপস্থিত থাকার কথা।
নরেন্দ্র মোদীর মন্ত্রিসভায় জায়গা পেতে চলেছেন বাংলার দু’জন সাংসদ। এমনটাই খবর মিলেছে বিজেপির সূত্রে। এখনও পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা হয়নি মন্ত্রীদের নাম। রবিবার সন্ধ্যায় মোদী তৃতীয় বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথগ্রহণ করবেন। তার আগে সকালে নিজের বাসভবনে কয়েক জনকে তিনি চা-চক্রে ডেকেছিলেন। জল্পনা ছিল, যাঁরা এই চা-চক্রে ডাক পেয়েছেন, তাঁরাই মন্ত্রিসভাতেও জায়গা পাবেন। চা-চক্রে ছিলেন বাংলার দুই প্রতিনিধি— সুকান্ত মজুমদার এবং শান্তনু ঠাকুর। বিজেপি সূত্রে খবর, তাঁরা দু’জনই মন্ত্রী হচ্ছেন। তবে এ বারও পূর্ণমন্ত্রী পাচ্ছে না বাংলা। সুকান্ত এবং শান্তনু উভয়েই প্রতিমন্ত্রী হচ্ছেন। শান্তনু জাহাজ মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। এ বার কোন দায়িত্ব তাঁকে দেওয়া হয়, সেটা দেখার। সেই সঙ্গে সুকান্ত কোন মন্ত্রকের দায়িত্ব পাবেন, সে দিকেও নজর থাকবে।
বর্তমানে রাজ্য বিজেপির সভাপতি পদে রয়েছেন সুকান্ত। তিনি বালুরঘাটের সাংসদ। লোকসভা ভোটে এ বারও ওই কেন্দ্র থেকে জিতেছেন। তারই পুরস্কার হিসাবে সুকান্তকে মন্ত্রিত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে মত অনেকের। শান্তনুকে জাহাজ প্রতিমন্ত্রী করা হয়েছিল ২০২১ সালে। তিনি বাংলায় মতুয়া সঙ্ঘাধিপতি। বাংলায় বিজেপির ভোটব্যাঙ্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ মতুয়া ভোট। যে কারণে মন্ত্রিত্বের হিসাবে শান্তনু বরাবর বাড়তি গুরুত্ব পেয়ে এসেছেন। রাজ্য বিজেপির অনেকে বলছেন, শান্তনু বনগাঁ অর্থাৎ দক্ষিণবঙ্গের প্রতিনিধি। সেই হিসাবে মন্ত্রী হিসাবে দ্বিতীয় জনকে উত্তরবঙ্গ থেকেই বাছতে হত মোদীকে। সুকান্তকে দায়িত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে সেটাও ‘ফ্যাক্টর’ হিসাবে কাজ করে থাকতে পারে।
চার মন্ত্রীর মধ্যে বার্লাকে এ বার লোকসভা ভোটে টিকিট দেওয়া হয়নি। নিশীথ এবং সুভাষ হেরে গিয়েছেন। মন্ত্রীদের মধ্যে জিতেছেন কেবল শান্তনু। তাঁকে মন্ত্রিসভায় রাখা হচ্ছে। সেই সঙ্গে আনা হচ্ছে নতুন মুখও।
বাংলা থেকে এ বারের মোদী মন্ত্রিসভায় কারা জায়গা পাবেন, তা নিয়ে জল্পনা চলছিল। তমলুকের জয়ী প্রার্থী তথা হাই কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, আলিপুরদুয়ারের জয়ী প্রার্থী মনোজ টিগ্গার নাম শোনা যাচ্ছিল। অনেকেই বলছিলেন, এঁদের কোনও না কোনও মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী করা হতে পারে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত যা খবর, তাতে সুকান্ত এবং শান্তনু ছাড়া আর কেউ মন্ত্রিত্ব পাচ্ছেন না।
তবে মোদীর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া নিয়ে ইন্ডিয়া জোটের দুই শরিকদলের মধ্যে লক্ষ্য করা গিয়েছে ভিন্ন অবস্থান। গতকাল শনিবারই তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁরা মোদীর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন না। যদিও দিল্লি সূত্রের খবর, প্রধানমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে থাকতে পারেন কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খারগে। ফলে বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক মহলে আলোড়ন ছড়িয়েছে।
এদিকে ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রে এখনো পর্যন্ত যা খবর, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে থাকছেন অমিত শাহ। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে রাজনাথ সিংকেই। এছাড়াও নীতীশ কুমার ও চন্দ্রবাবু নাইডুর দলের একাধিক সংসদ পূর্ণ ও রাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পেতে চলেছেন। মন্ত্রী হচ্ছেন চিরাগ পাসওয়ান। এবারও মন্ত্রী থাকছেন পীযূষ গোয়েল ও জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া। তবে বাংলা থেকে কতজন মন্ত্রী হচ্ছেন নজর সেদিকেই।
বাংলায় বিজেপির আসন এবার কমেছে। ১৮ থেকে কমে হয়েছে ১২। তাই কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভাতেও বাংলা থেকে প্রতিনিধিত্ব কমে যাওয়ার সম্ভাবনাই এবার বেশি।
সূত্রের দাবি, মোদী মন্ত্রিসভায় আগে বাংলার প্রতিনিধিত্ব ছিল মাত্র দুই। পরে বেড়ে হয় চার। এবার আবার নেমে আসতে পারে দুইয়ে। আবার বিজেপির একটি সূত্র এও দাবি করছে যে রবিবার বাংলার কেউ শপথ নাও নিতে পারেন। এদিন হয়তো সীমিত সংখ্যক সাংসদ শপথ নেবেন। তার পর মাস খানেক বাদে মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণ করা হবে। তখন বাকিদের নেওয়া হবে মন্ত্রিসভায়। এখন সবচেয়ে বড় কৌতূহলের বিষয় হল, আদৌ যদি এ যাত্রায় বাংলা বিজেপির শিঁকে ছেড়ে তাহলে কারা মন্ত্রী হতে পারেন?
এদিন দুপুর পর্যন্ত যতটুকু খবর, বাংলার ১৩ জন বিজেপি সংসদের মধ্যে এদিন সকালে মোদির চা চক্রে হাজির ছিলেন একমাত্র বনগাঁর সাংসদ শান্তনু ঠাকুর। ফলে সম্ভবত তিনিই মন্ত্রী হচ্ছেন বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। রেলমন্ত্রক সম্ভবত নীতীশ কুমারের দলের হাতে যাচ্ছে। এদিনের চা চক্রে হাজির ছিলেন নির্মলা সীতারামন। ফলে তাঁকেই আবার অর্থমন্ত্রী করা হচ্ছে কিনা জল্পনা তা নিয়েও। যদি নির্মলাকে অর্থমন্ত্রী করা না হয়, তাহলে ওই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকের দায়িত্ব যেতে পারে বিদায়ী রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবের হাতে। যদি তা না হয়, অর্থ মন্ত্রক পেতে পারেন পীযূষ গোয়েল। এদিকে বিজেপির জাতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা, যিনি রাজ্যসভার সাংসদ তাঁকে কি সংগঠনের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে এবার মন্ত্রী করা হচ্ছে? তুমুল জল্পনা তা নিয়েও।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্ত্রিসভা গঠনের সময়ে যখন সবটা আগে থেকে জানা যায় না, মোদী মন্ত্রিসভার ক্ষেত্রেও তাই। রবিবার সকালে দেখা গিয়েছে, তমলুকে নতুন জেতা অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় সেজেগুজে দিল্লির উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন। দিল্লি গিয়েছেন হেরে যাওয়া দুই সাংসদ দিলীপ ঘোষ ও অর্জুন সিংও। তবে বিজেপি সূত্রের মতে, প্রথম বার যাঁরা সাংসদ হিসাবে জিতেছেন, তাঁদের মন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা তুলনায় কম।
উত্তরবঙ্গে প্রথম বার সাংসদ হয়েছেন মাত্র দুজন। আলিপুরদুয়ারের বিজেপি সাংসদ মনোজ টিগ্গা ও রায়গঞ্জের সাংসদ কার্তিক পাল। বাকি চার জন তথা দার্জিলিংয়ের রাজু বিস্ত, জলপাইগুড়ির জয়ন্ত রায়, বালুরঘাটের সাংসদ তথা রাজ্য বিজেপি সভাপতি সুকান্ত মজুমদার ও মালদহ উত্তরের সাংসদ খগেন মুর্মু এই নিয়ে দ্বিতীয় বার জিতলেন। দক্ষিণবঙ্গে প্রথমবার জিতেছেন কাঁথির সাংসদ সৌমেন্দু অধিকারী ও তমলুকের সাংসদ অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। বিষ্ণুপুরের সাংসদ সৌমিত্র খাঁ এই নিয়ে তিন বার সাংসদ হলেন।
শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে রাজধানীর ‘কর্তব্য পথ’-এ সাজ সাজ রব।এতদিন পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি ভবনে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান হত। এবারই প্রথম ‘কর্তব্য পথ’-এ হতে চলেছে এই অনুষ্ঠান। সূত্রের খবর, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এদিন রাষ্ট্রপতির কাছে শপথ নিতে পারেন কয়েকজন মন্ত্রীও। সেই তালিকায় শরিকদলের কারা কারা রয়েছেন, তা নিয়ে কৌতূহল তৈরি হয়েছে সব মহলে।
এর মধ্যে বিজেপির টিকিটে জিতলেন দু’বার। বনগাঁর শান্তনু ঠাকুরও, পুরুলিয়ার জ্যোতির্ময় মাহাতো ও রানাঘাটের জগন্নাথ সরকারও দুবার জিতলেন। বাংলা থেকে দুজন মন্ত্রী হলে অবধারিত ভাবেই একজন উত্তরবঙ্গ থেকে হবেন একজন দক্ষিণবঙ্গ থেকে। কারণ, বিজেপির ১২ জন সাংসদের মধ্যে ৬ জন উত্তরবঙ্গের ৬ জন দক্ষিণবঙ্গের। বিজেপি সূত্রে বলা হচ্ছে, নির্দিষ্ট করে কারা মন্ত্রী হচ্ছেন বা আদৌ কেউ হচ্ছেন কিনা তা দুপুরের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে যাবে।
মতুয়া সম্প্রদায়ের ভোটব্যাঙ্কের কথা মাথায় রেখেও শান্তনুকে মন্ত্রিসভায় জায়গা দেওয়া হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। বাংলার মতুয়া অধ্যুষিত দুই এলাকাতেই এ বারও বিজেপি জিতেছে। বনগাঁয় শান্তনুর পাশাপাশি রানাঘাটে জিতেছেন জগন্নাথ সরকার। কিন্তু মতুয়াদের মধ্যে শান্তনুর জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। তা ছাড়া, সিএএ কার্যকর করা নিয়ে একাধিক বার বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে শান্তনুর মনোমালিন্য হয়েছে। বিজেপির অন্দরে গুঞ্জন, ওই মনোমালিন্য দূর করতেও পূর্ণমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে মতুয়া সঙ্ঘাধিপতিকে।
বাংলা কয়েক জন প্রতিমন্ত্রীও পেতে পারে বলে গুঞ্জন। সে ক্ষেত্রে, তমলুক থেকে জেতা হাই কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, আলিপুরদুয়ারের জয়ী প্রার্থী মনোজ টিগ্গার নামও উঠে আসছে। সব জল্পনার উত্তর মিলবে মন্ত্রিসভার সদস্যদের নাম ঘোষিত হলে।
এদিন সকালে রাজঘাটে মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানালেন মোদী। সঙ্গে ছিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর সৌধ ‘সদৈব অটল’-এর স্মৃতিসৌধেও শ্রদ্ধা জানান মোদী।
জানা যাচ্ছে, এদিন সন্ধের শপথ অনুষ্ঠানে সাত দেশের রাষ্ট্রপ্রধান উপস্থিত থাকতে পারেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমসিঙ্ঘে, নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্পকমল দহাল ওরফে প্রচণ্ড, মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি মহম্মদ মইজ্জু, ভুটানের রাজা জিগমে খেসার নামগয়াল ওয়াংচুক, মরিশাসের প্রধানমন্ত্রী প্রবীন্দ জুগনথ এবং পূর্ব আফ্রিকার দেশ সেশেলসের ভাইস প্রেসিডেন্ট আহমেদ আফিফ উপস্থিত থাকতে পারেন।
তবে এর মধ্যে সবচেয়ে চর্চিত নাম মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি মহম্মদ মইজ্জু। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে টানাপড়েনের মাঝে নয়াদিল্লির আমন্ত্রণে সাড়া দেওয়ার কথা জানিয়েছেন মইজ্জু। এটা স্রেফই সৌজন্য নাকি সত্যি সত্যি তিনি হাজির হন, তা নিয়েও কৌতূহল রয়েছে রাজনৈতিক মহলে।
রবিবার সন্ধেয় রাষ্ট্রপতির কাছে শপথবাক্য পাঠ করবেন প্রধানমন্ত্রী। অনুষ্ঠানকে ঘিরে শনিবার থেকেই বহুস্তরীয় নিরাপত্তায় মুড়ে ফেলা হয় নয়াদিল্লি। জানা যাচ্ছে, শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে আট হাজার জনের বেশি অতিথি উপস্থিত থাকবেন।
পুলিশ ছাড়াও প্যারামিলিটারি ফোর্স, এনএসজি কম্যান্ডোরা রবিবারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের নিরাপত্তার দায়িত্বে আছেন। স্নাইপারের পাশাপাশি নজরদারি চালানো হবে ড্রোন দিয়েও।