দেশের সময়: একেই বলে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। পেট্রাপোলে আমদানি রফতানি বাণিজ্যে মন্দার জেরে কাঁটায় বিক্রি করে দিতে হচ্ছে ট্রাক।
পরিস্থিতি এমনই যে, গত জুন মাস থেকে এ পর্যন্ত প্রায় বারোশো ট্রাক ভাঙারির দরে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছেন গাড়ির মালিকরা। এমন অবস্থা চলতে থাকলে কিছুদিনের মধ্যেই পরিস্থিতি ভয়ানক হয়ে উঠবে বলে জানিয়েছেন তাঁরা। ট্রাক মালিকদের বক্তব্য, যে ট্রাকের মূল্য আট থেকে দশ লক্ষ টাকা, কাঁটায় বিক্রি করে দু’লাখ টাকাও পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু উপায় কী! দিনের পর দিন গাড়ি বসিয়ে রেখে লোকসানের বহর বাড়ানোর চেয়ে বিক্রি করে দিয়ে যে ক’টা টাকা ঘরে আসে, সেটাই ভাল, বলছেন তাঁরা। এদিকে, প্রতিদিনই বনগাঁয় কাঁটায় ট্রাক বিক্রি হয়ে যাওয়ায় কাজ হারাচ্ছেন চালক, খালাসিরা।
এশিয়ার বৃহত্তম স্থলবন্দর পেট্রাপোলকে ঘিরে যে বিরাট কর্মসংস্থানের স্বপ্ন দেখেছিল বনগাঁর যুব সমাজ, সেখানে আঘাত নেমে আসায় দুশ্চিন্তা গ্রাস করেছে তাঁদের মনে। অনেকেরই বক্তব্য, এভাবে চলতে থাকলে পেট্রাপোলের উপর নির্ভরশীল হাজার হাজার মানুষ কাজ হারাবেন। বনগাঁয় ফের মাথা চাড়া দেবে চোরাচালান। যুব সমাজ ফের অন্ধকারে ডুব দিতে বাধ্য হবে। বিষয়টি নিয়ে রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে বিকল্প কোনও পথ খোলা যায় কি না, তার চেষ্টা করা হবে বলে জানিয়েছেন বনগাঁর পুরপ্রধান গোপাল শেঠ।
কিন্তু কেন এই পরিস্থিতি?
বাংলাদেশের সঙ্গে এ রাজ্যের স্থলবন্দরগুলি দিয়ে ট্রাকে পণ্য রফতানি সংক্রান্ত কাজে স্বচ্ছতা আনতে রাজ্যের পরিবহণ দফতর অনলাইন স্লট বুকিং সিস্টেম বা সুবিধা ভেহিক্যালস ফেসিলিয়েশন সিস্টেম চালু করেছে। এতেই বাণিজ্যে গতি বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু সমস্যায় পড়ে গিয়েছেন স্থানীয় ট্রাক মালিকরা। আগে বাইরের রাজ্য থেকে যে সব ট্রাকে পণ্য আসত, সেগুলি পেট্রাপোলে পণ্য নামিয়ে দিয়ে চলে যেত। কারণ, তখন বাংলাদেশে পণ্য নিয়ে ঢোকার জন্য দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হত। কখনও কখনও সেই অপেক্ষা একমাসও হয়ে যেত। এতদিন ডিটেনশন করলে ভিনরাজ্যের ট্রাকগুলির মোটা টাকা আর্থিক ক্ষতি হত। সেকারণে সেগুলি পেট্রাপোলের কাছাকাছি কোনও জায়গায় পণ্য নামিয়ে দিয়ে ফিরে যেত। বাংলাদেশে ঢোকার ‘লাইন’ না পাওয়া পর্যন্ত সেই পণ্য হয় স্থানীয় কোনও গোডাউনে রাখা হত, নতুবা এলাকার কোনও ট্রাকে লোড করা হত। এতে একদিকে যেমন পণ্য বোঝাই ও খালাস করার কাজ পেতেন এলাকার শ্রমিকরা, তেমনই এলাকায় অনেক গোডাউন তৈরি হয়েছিল, বনগাঁর ট্রাক মালিকরাও দু’টো পয়সার মুখ দেখতেন। কিন্তু এখন সুবিধা পোর্টালের মাধ্যমে ঘরে বসেই স্লট বুকিং করা যাচ্ছে। স্লট বুক করার সময়ই বলে দেওয়া হচ্ছে, কবে সেই পণ্য বাংলাদেশে ঢোকার ‘লাইন’ পাবে। সুতরাং সেইমতো ট্রাকে পণ্য বোঝাই করা হচ্ছে। ফলে পণ্য বোঝাই ট্রাকগুলিকে পেট্রাপোলে এসে এখন আর দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হচ্ছে না। এর জেরে ভিন রাজ্য থেকে যেসব ট্রাক পণ্য নিয়ে আসছে, তারা আর পেট্রাপোলে পণ্য নামিয়ে দিয়ে ফিরে যাচ্ছে না। একেবারে বাংলাদেশে ঢুকে পণ্য খালাস করিয়ে তারপরই ফিরছে। স্বাভাবিকভাবেই স্থানীয় ট্রাকের চাহিদা কমে গিয়েছে অনেকটাই। এরই জেরে কাঁটায় ট্রাক বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন মালিকরা।
এনিয়ে পেট্রাপোলে আন্দোলনও শুরু হয়েছে। গঠিত হয়েছে পেট্রাপোল এক্সপোর্ট ইমপোর্ট সমম্বয় কমিটি। আন্দোলনকারীদের দাবি, বনগাঁয় কোনও ভারী শিল্প নেই। ট্রাক ও পরিবহণ ব্যবসার সঙ্গে এলাকার হাজার হাজার মানুষ যুক্ত। অনলাইন স্লট বুকিংয়ের কারণে স্থানীয় ট্রাকগুলিতে পণ্য লোড হচ্ছে না। বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসা পণ্যভর্তি ট্রাক সরাসরি বাংলাদেশে চলে যাচ্ছে। এতে তাঁরা রোজগার হারাতে বসেছেন। পরিবহণ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত মানুষজন জানিয়েছেন, এতদিন বাইরে থেকে আসা পণ্যভর্তি ট্রাকের প্রায় ৭০ শতাংশ পণ্য স্থানীয় ট্রাকে লোড করা হত। তারপর তা বাংলাদেশে যেত। অনেক সময় ওই পণ্য স্থানীয় গোডাউনে রাখা হত। পণ্য বোঝাই ট্রাকগুলি বেসরকারি পার্কিংয়ে থাকত। কিন্তু নতুন পদ্ধতি চালু হওয়ায় এখন স্থানীয় গোডাউনে কোনও পণ্য রাখা হচ্ছে না। ফলে গোডাউন ব্যবসা মার খাচ্ছে। পাশাপাশি বেসরকারি পার্কিং লট ফাঁকা পড়ে রয়েছে। এভাবে চললে এলাকার মানুষজন যাঁরা এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের খাওয়া জুটবে কী করে, সেই প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা। আর এখানেই দাবি উঠতে শুরু করেছে, বাংলাদেশে পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে অনলাইন স্লট বুকিং সিস্টেম তুলে দিয়ে পুরনো ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা হোক। অনেকের আবার দাবি, অনলাইন স্লট বুকিং থাকুক, কিন্তু স্থানীয় মানুষের রোজগারের কথা ভেবে স্পট বুকিং চালু করা হোক। সেক্ষেত্রে পেট্রাপোলে পণ্য নিয়ে ট্রাক আসার পর তবেই স্লট বুকিং করা যাবে, এমন ব্যবস্থা চালু করা দরকার। না হলে কমজোরি ট্রান্সপোর্টাররাও মার খাবেন।
পেট্রাপোল এক্সপোর্টার ইমপোর্টার ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক প্রদীপ দে বলেন, এমনিতেই বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক মুদ্রা ভাণ্ডারে সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ডলারের ঘাটতির জেরে আগের মতো এখন লেটার অফ ক্রেডিট ইস্যু হচ্ছে না। স্বাভাবিকভাবেই রফতানির হার কমছে। তারউপর অনলাইন স্লট বুকিংয়ের জেরে এখন আর পেট্রাপোলে পণ্য নিয়ে ট্রাকগুলিকে একদিনও দাঁড়াতে হচ্ছে না। ফলে স্থানীয় ট্রাকের চাহিদা কমে গিয়েছে। যে কারণে বহু মালিক জলের দরে ট্রাক বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এর জেরে সেই ট্রাকের যিনি চালক ছিলেন, যিনি খালাসির কাজ করতেন, এলাকার গোডাউনে যাঁরা পণ্য লোডিং আনলোডিংয়ের কাজ করতেন, প্রত্যেকেই কাজ হারাচ্ছেন। এটা মোটেই ভাল ইঙ্গিত নয়। এভাবে চললে বনগাঁর বহু মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বেন। স্বাভাবিকভাবে একটা বড় সঙ্কট তৈরি হবে। মানুষের পেটে টান পড়লে সীমান্ত এলাকায় নানা ধরনের বেআইনি ও অপরাধমূলক কাজকর্ম বাড়বে। ফলে সরকারের এ বিষয়ে দ্রুত নজর দেওয়া দরকার।
পেট্রাপোল ক্লিয়ারিং এজেন্ট স্টাফ এন্ড ওয়েলফেয়ার এ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক কার্তিক চক্রবর্তী বলেছেন, অনলাইন স্লট বুকিং সিস্টেম চালু করে ভারত-বাংলাদেশ আমদানি রফতানি বাণিজ্যে গতি এসেছে কি আসিনি, সেটা এখানে বিবেচ্য নয়। আঞ্চলিক পরিস্থিতি বিচার করে সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। জম্মু ও কাশ্মীরের জন্য সরকার সে সিদ্ধান্ত নেবে, সেই একই সিদ্ধান্ত মিজোরাম কিংবা মণিপুরের জন্য নিশ্চয় নেবে না। একইভাবে পেট্রাপোলের কত মানুষ স্থানীয় ট্রাক শিল্পের উপর নির্ভরশীল, সেটা ভেবে তারপরই রাজ্য সরকারের এই সুবিধা পোর্টাল চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সেটা না করার জন্য এখন হাজার হাজার মানুষকে পথে বসতে হচ্ছে। মানুষজন কাজ হারাচ্ছেন। তাঁদের পেটে টান পড়ছে। নাগপুরে এমন জায়গা রয়েছে, যেখানে এ রাজ্য থেকে কোনও ট্রাক পণ্য নিয়ে গেলে ঢুকতে পারে না। সেখানকার ট্রাকে পণ্য লোড করে তারপরই সেখানে পৌঁছতে হয়। অথচ বাইরের রাজ্য থেকে ট্রাকে পণ্য আসছে পেট্রাপোলে। সেগুলি হামেশাই বাংলাদেশে ঢুকছে। আর ভাড়া না পেয়ে বসে থেকে মার খাচ্ছেন স্থানীয় ট্রাকের মালিকরা। এই অবস্থার একটা সুরাহা হওয়া দরকার। কার্তিকবাবুর কথায়, ১৯৭০ সাল থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য শুরুর পর থেকেই বনগাঁর বহু মানুষ পরিবহণ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। ধীরে ধীরে ব্যবসা বেড়েছে। এলাকার মানুষের নির্ভরতাও বেড়েছে পেট্রাপোলের উপর। এখন পেট্রাপোল দিয়ে বছরে ৩০ হাজার কোটিরও বেশি ব্যবসা হয়। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে ট্রাক ও পরিবহণ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, তাঁদের যদি না খেয়ে মরার মতো অবস্থা তৈরি হয়, তাহলে সত্যিই খুব দুর্ভাগ্যজনক। সরকারের কাছে আমরা বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার দাবি জানিয়েছি। আমাদের বক্তব্য, সুবিধা পোর্টাল যদি চালু রাখতেই হয়, রাখা হোক। সেক্ষেত্রে পণ্য নিয়ে ট্রাক পেট্রাপোলে পৌঁছনোর পর তারপরই স্লট বুকিং করা যাবে, এমন সিস্টেম চালু করা হোক। তাতে কিছুটা হলেও অবস্থার পরিবর্তন হবে। স্থানীয় ট্রাকমালিকরা মাঝেমধ্যে হলেও ভাড়া পাবেন।
দীর্ঘদিন ধরে রফতানি বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত থাকা দেবব্রত সেন বলেছেন, অনলাইন স্লট বুকিং সিস্টেম চালু হওয়ায় কম করে পাঁচ হাজার ট্রাক বনগাঁয় বসে গিয়েছে। এর মধ্যে বারোশোর মতো ট্রাক কাঁটায় বিক্রি হয়ে গিয়েছে। আমি নিজেই সাতটি ট্রাক এভাবে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছি। যেখানে একটি ট্রাকের দাম ৭-৮ লাখ টাকা, কাঁটায় বিক্রি করে সাকুল্যে দু-তিন লাখ টাকাও পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে কী পরিস্থিতি চলছে, তা সহজেই অনুমেয়। তাঁর দাবি, বাংলাদেশ সরকারকে আরও বেশি করে লেটার অফ ক্রেডিট ইস্যু করতে হবে। বাণিজ্যের পরিমাণ বাড়াতে হবে। তা না হলে স্থানীয় ট্রাক শিল্পের এই দুর্দিন ঘুচবে না। পাশাপাশি আগে যেখানে বনগাঁ থেকে বাংলাদেশে পণ্য নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি ট্রাকের ভাড়া দেওয়া হত, ১২-১৩ হাজার টাকা। এখন তা কমিয়ে করা হয়েছে ৮-৯ হাজার টাকা। তাছাড়া আগে একদিনের জন্য ডিটেনশন চার্জ দেওয়া হত ১১০০ টাকা। সেটাও এখন কমিয়ে ৮০০ টাকা করে দেওয়া হয়েছে। ফলে সবদিক থেকেই এই ব্যবসায় মন্দা নেমে এসেছে। এভাবে খুব বেশিদিন টিকে থাকা সম্ভব নয়। শীঘ্রই এই অবস্থার বদল দরকার।