দেশের সময়: এ মাসেই পেট্রাপোলে আসছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। সরকারি সূত্রে খবর, ১৭ ডিসেম্বর আসার কথা রয়েছে তাঁর। মূলত সরকারি অনুষ্ঠানেই যোগ দেবেন তিনি। কিন্তু তাঁর এই সফরের খবর চাউর হতেই বনগাঁ মহকুমার বাসিন্দাদের মধ্যে নতুন করে মাথাচাড়া দিয়েছে এনআরসি আতঙ্ক। তাঁদের আশঙ্কা, তাহলে কি আবারও এনআরসি ইস্যুকে উস্কে দেবেন তিনি?

অমিত শাহের পেট্রাপোল সফর নিয়ে রাজনৈতিক মহলেও চর্চা চলছে। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, ২০২৪ সালের লোকসভা ভোট আসতে আর বেশি দেরি নেই। আর প্রতিবার লোকসভা ভোটের আগে বিজেপি একটা করে ইস্যু তৈরি করে। সেই ইস্যুকে সামনে রেখেই ভোট বৈতরণী পার হতে চায়। ধর্মের ভিত্তিতে ভোট, বাংলার মানুষ মেনে নেবে না। তা হলে কি বঙ্গে এনআরসি ও সিএএ ইস্যুকেই সামনে রেখে আগামী লোকসভা ভোটে লড়াই করবে বিজেপি? 

NOTICE

এনিয়ে জল্পনা শুরু হতেই সীমান্তপারের হাজার হাজার মানুষ চরম উদ্বেগে পড়েছেন। বিশেষ করে যাঁরা বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ থেকে অত্যাচারিত হয়ে কিংবা অন্য নানা কারণে এপারে চলে এসেছেন এবং এখানে দীর্ঘদিন ধরে বাস করছেন, ফের রাতের ঘুম উধাও হওয়ার জোগাড় হয়েছে তাঁদের। ওইসব মানুষজনের বক্তব্য, নাগরিকত্ব পাওয়ার মাপকাঠি কী হবে, সেটাই তাঁরা বুঝতে পারছেন না। সরকার যে মাপকাঠি নির্ধারণ করে দেবে, সেইমতো নথি পেশ করতে না পারলে, তাঁদের কি ঘর ছেড়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে গিয়ে আশ্রয় নিতে হবে? এভাবে দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে তাঁরা আর সুস্থ জীবন যাপন করতে পারছেন না। 

এদিকে, বিজেপি বারবার মুখে বললেও সিএএ কার্যকর করে মতুয়াদের পাকাপাকিভাবে নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যবস্থা না করায় ক্ষোভ বাড়ছে তাঁদের মধ্যে। এনিয়ে ঠাকুরনগর ঠাকুরবাড়ির ‘নেতা’ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শান্তনু ঠাকুরও বিভিন্ন সময় হাবেভাবে তাঁর অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। দিন কয়েক আগেই ঠাকুরনগরে এসে সভা করে গিয়েছেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তিনি অবশ্য শান্তনু ঠাকুরকে পাশে বসিয়ে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, আজ না হয় কাল, সিএএ চালু হবেই। যদিও এই সিএএ ইস্যুতে আড়াআড়িভাবে ভাগ হয়ে গিয়েছে ঠাকুরনগর ঠাকুরবাড়ি। 

ঠাকুরবাড়ির ‘নেত্রী’ তৃণমূলের প্রাক্তন সাংসদ মমতাবালা ঠাকুর বলেছেন, দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে নাগরিক হিসেবে যে পরিচয়পত্র রয়েছে, তাঁদের কাছেও একই পরিচয়পত্র আছে। মোদি, অমিত শাহরা যদি দেশের নাগরিক হয়ে থাকেন, তা হলে তাঁরাও দেশের নাগরিক। সেক্ষেত্রে আর নতুন করে নাগরিকত্ব দেওয়ার মানে কি। আমাদের সাফ বক্তব্য, যদি নাগরিকত্ব দিতে হয়, তা হলে নিশর্তভাবে দিতে হবে। সিএএ কার্যকর করে কোনওরকম শর্ত চাপানো চলবে না। বাংলাদেশ থেকে কে অত্যাচারিত হয়ে এপারে চলে এসেছেন, এর প্রমাণ হবে কীভাবে? এদেশের সরকার কি বাংলাদেশের সরকারের কাছে নাম, ঠিকানা ধরে ধরে জানতে চাইবে। আর বাংলাদেশ সরকার যা রিপোর্ট দেবে সেই অনুযায়ী নাগরিকত্ব মিলবে এদেশে। এটা কখনও হয় নাকি? কেন্দ্রীয় সরকারের এই ‘ভাওতাবাজি’র বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি। এই আন্দোলন চলবে। 

সিএএ কোনও দিনই বাংলায় চালু হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর সাফ কথা, যাঁরা এদেশে বাস করছেন, ভোটার তালিকায় নাম রয়েছে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতি মেনে ভোটদানে অংশ নেন, তাঁরা দেশের নাগরিক। তাঁদের নতুন করে নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলার মানে কী? তিনি বেঁচে থাকতে কখনও বাংলায় এনআরসি চালু করতে দেবেন না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হুঙ্কার দিলেও বিজেপি কিন্তু দমছে না। এর আগে অমিত শাহ বলেছিলেন, করোনা পরিস্থিতি একটু থিতু হলেই দেশে সিএএ চালু করা হবে। সেই কথারই রেশ ধরে রেখে কয়েকদিন আগেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, কারও স্বপ্নেও ভাবা উচিত নয় যে, সিএএ প্রযোজ্য হবে না। যাঁরা এমনটা ভাবছেন, তাঁরা ভুল করছেন। এর আগে উত্তরবঙ্গের মাটিতে দাঁড়িয়ে সরাসরি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিশানা করে অমিত শাহ বলে গিয়েছেন, সিএএ কার্যকর হবেই। আপনি কিছুই করতে পারবেন না দিদি। সেসময় তিনি তোপ দেগে বলেন, সিএএ নিয়ে তৃণমূল মিথ্যাচার করছে। মমতা অনুপ্রবেশকারীদের পক্ষে। কিন্তু আমরা শরনার্থীদের নাগরিকত্ব দেবই। 

এই পরিস্থিতিতে পেট্রাপোল সফরে অমিত শাহের মুখে এনআরসি, সিএএ নিয়ে কোনও কথা শোনা যাবে কি না, তারই অপেক্ষায় বনগাঁ, বাগদা, গাইঘাটার মানুষ। স্থানীয় বিজেপি নেতৃত্বের বক্তব্য, পেট্রাপোলে সরকারি অনুষ্ঠান। সেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কী বলবেন তা আমাদের জানা নেই। তবে সিএএ চালু হবেই, এটা অমিত শাহজি বারবার স্পষ্ট করে দিয়েছেন। দিন কয়েক আগে ঠাকুরনগরে এসে একই কথা জানিয়ে গিয়েছেন শুভেন্দু অধিকারী।

মতুয়াদের আশ্বস্ত করে তিনি বলেন, সিএএ বিরোধিতার নামে উস্কানি দেওয়া হচ্ছে। আমি বারবার এই আইনের পক্ষে সওয়াল করেছি। সংসদেও এই আইন পাশ হয়েছে। কারও নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার কথা আইনে লেখা নেই। আগামী দিনে এ রাজ্যে সিএএ চালু হবেই। আপনারা শুভেন্দু অধিকারী, শান্তনু ঠাকুরের উপর ভরসা রাখুন। সিএএ কার্যকর হওয়া এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। আমি ব্যক্তিগতভাবে এনআরসি চাই। জন্ম নিয়ন্ত্রণ চাই। দেশকে বাঁচাতেই হবে। তোপ দেগে তিনি বলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভোটের স্বার্থে সিএএ বিরোধী আন্দোলনে সংখ্যালঘুদের উস্কে দিয়েছিলেন। কেন্দ্র সুপ্রিম কোর্টের রায়ের অপেক্ষায় রয়েছে। সেই রায় বের হওয়ার পরই রুল তৈরি হবে। 

এদিকে, বনগাঁয় পঞ্চায়েত ভোটের উত্তাপ বাড়তে শুরু করে দিয়েছে। যুযুধান দু’পক্ষ তৃণমূল ও বিজেপি ইতিমধ্যেই নিজেদের মতো করে নেমে পড়েছে ময়দানে। দুই শিবিরের বাকযুদ্ধও নজর কাড়ছে। বাগদার বিধায়ক তথা তৃণমূলের বনগাঁ সাংগঠনিক জেলা সভাপতি বিশ্বজিৎ দাসের হুঁশিয়ারি, পঞ্চায়েত ভোটের আগে তৃণমূলের নামে প্রকাশ্যে কুৎসা করলে ঝাঁটাপেটা করা হবে বিজেপিকে। সম্প্রতি বাগদার বেয়াড়া বাজরে এক সভায় তিনি বলেছেন, বিভিন্ন জায়গায় তৃণমূলকে ‘চোর’ সাজানোর চেষ্টা করছে বিজেপি। দু’এক জায়গায় কারও নামে অভিযোগ ওঠা মানেই তিনি অপরাধী, এমনটা বলার অধিকার নেই কোনও আইনে। কিন্তু বিজেপি সেটাই করে চলেছে। এমনটা আর সহ্য করা হবে না। তৃণমূলের নামে প্রকাশ্যে ‘চোর’ বলতে শুনলে বিজেপিকে ঝাঁটাপেটা করা হবে। বেয়াড়া বাজারে বিজেপি নেতা রাহুল সিনহার পাল্টা সভা করে তৃণমূল। সেখানেই রাহুল সিনহাকে তিনি ‘অপদার্থ নেতা’ বলে তোপ দাগেন। বিশ্বজিৎ বলেন, রাহুল সিনহার মতো একজন অপদার্থ নেতা বলছেন তৃণমূল কংগ্রেস চোর। আমি মানুষের কাছে আবেদন করছি, যদি কেউ ভোটের আগে এসে এলাকা অশান্ত করার চেষ্টা করে, তৃণমূলকে চোর সাজানোর চেষ্টা করে, তা হলে তাকে ঝাঁটাপেটা করুন। বাগদা দিয়েই বিজেপিকে ঝাঁটাপেটা করা শুরু হবে। সবকিছুর একটা সীমা থাকে। কিন্তু কেউ যদি সেই সীমা অতিক্রম করে, তা হলে তার উচিত শিক্ষা হওয়া উচিত।

বিশ্বজিতের এই মন্তব্যের পরই কড়া প্রতিক্রিয়া দিয়েছে গেরুয়া শিবির। বিজেপির বনগাঁ সাংগঠনিক জেলা সাধারণ সম্পাদক দেবদাস মণ্ডল বলেছেন, তৃণমূলকে কি শুধু বিজেপি চোর বলছে? গোটা বাংলার মানুষই তো বলছে। আর চোরকে চোর বলবে না তো কী বলবে? সাধু বলবে? বাংলার মানুষ বুঝে গিয়েছে, এ রাজ্যের উন্নতি চাইলে চোরমুক্ত বাংলা গড়তে হবে। আর একমাত্র তৃণমূলকে তাড়িয়েই চোরমুক্ত বাংলা গড়া সম্ভব। ফলে এসব বলে কিছুই হবে না। 

বিজেপি পুরোদমে পঞ্চায়েত ভোটের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু বিধানসভা নির্বাচনের মতো পঞ্চায়েতেও দলের প্রার্থী বাছাই ঘিরে গেরুয়া শিবিরের নেতৃত্বকে বিপাকে পড়তে হতে পারে বলে এখনই আভাস মিলছে। বিশেষ করে দলে নতুন-পুরনোর দ্বন্দ্বের জেরে প্রার্থী নির্বাচন ঘিরে ঝামেলার আশঙ্কা রয়েছে। যদিও দেবদাস মণ্ডল বলেছেন, যিনি আজ বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন, তাঁরও যেমন অধিকার রয়েছে, যিনি কুড়ি বছর ধরে দলে রয়েছেন, তাঁরও একই অধিকার। পরিবারে নতুন সন্তানের জন্ম হলে যেমন আগের সন্তানের ভালোবাসা, অধিকার কমে না। এক্ষেত্রেও তাই। সুতরাং নতুন-পুরনোর দ্বন্দ্ব বলে কিছু নেই। সবটা নিয়েই বিজেপি একটা পরিবার। দল যাঁকে প্রার্থী করবেন, তিনিই প্রার্থী হবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here