রাতভর গুলির লড়াই। পাকিস্তানে ৫০০ যাত্রী-সহ জাফর এক্সপ্রেস ট্রেন হাইজ্যাক করেছে বালোচ লিবারেশন আর্মি-র (বিএলএ) সদস্যরা। পণবন্দি করা হয়েছে যাত্রীদের। ইতিমধ্যেই শতাধিক যাত্রীকে উদ্ধার করেছে পাক সেনা। তাদের সঙ্গে গুলির লড়াইয়ে নিকেশ হয়েছে বিএলএ-র ১৬ জন। ভয়ঙ্কর এই ঘটনা ঘিরে নানা প্রশ্ন রয়েছে। কী ভাবে যাত্রীবাহী ট্রেনটি হাইজ্যাক করল BLA?
বালোচিস্তানে অপহৃত ট্রেনের একশোর বেশি পণবন্দি যাত্রীকে উদ্ধার করল পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী। গুলির লড়াইয়ে মৃত্যু হয়েছে বালোচিস্তানের স্বাধীনতাপন্থ সশস্ত্র সংগঠন বালোচিস্তান লিবারেশন আর্মির (বিএলএ) ১৬ জঙ্গির। তবে ট্রেনে এখনও কতজন যাত্রী পণবন্দি রয়েছেন, তা স্পষ্ট নয়। আবার তাদের সদস্যদের মৃত্যুর খবর অস্বীকার করেছে বিএলএ।
পাকিস্তান সংবাদমাধ্যম জিও নিউজ় সূত্রে খবর, পাহাড় ঘেরা ট্রেনের যাত্রাপথে ১৭টি টানেল ছিল। আগে থেকেই একটি টানেলে ঘাপটি মেরে বসেছিল বিএলএ। ট্রেন সেই টানেলে ঢুকতেই বিএলএ-র সদস্যরা এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়তে শুরু করে। ট্রেনের ইঞ্জিন টার্গেট করে শুরু হয় গুলিবৃষ্টি। গুলি এসে লাগে ড্রাইভারের গায়ে। গুরুতর আহত হওয়ায় বেসামাল হয়ে পড়েন তিনি। থামিয়ে দেন ট্রেন। শুধু তাই নয়, বিএলএ-র জঙ্গিরা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে উড়িয়ে দেয় রেললাইনও।
গতকাল বালোচিস্তানের কোয়েত্তা থেকে খাইবার পাখতুনখোয়ার পেশোয়ারে যাওয়ার পথে জাফর এক্সপ্রেস অপহরণ করে বিএলএ জঙ্গিরা। ওই এক্সপ্রেসের ৯টি বগিতে প্রায় ৪০০ যাত্রী ছিলেন। এক বিবৃতিতে বিএলএ জানায়, তাদের মুক্তিযোদ্ধরা বোলানে রেলপথ উড়িয়ে দেয়। যার জেরে ট্রেনটি থামতে বাধ্য হয়। তারপরই ট্রেনের দখল নেয় তারা। পণবন্দিদের উদ্ধারে সেনা অভিযান হলে যাত্রীদের খুন করারও হুঁশিয়ারি দেয় বিএলএ।

বিএলএ হুঁশিয়ারি দিলেও পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী পণবন্দি যাত্রীদের উদ্ধারে নামে। বিএলএ-র বিদ্রোহীদের সঙ্গে রাতভর গুলির লড়াই চলে পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর। প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছে, ১০৪ জন পণবন্দিকে উদ্ধার করা হয়েছে। তার মধ্যে ৫৮ জন পুরুষ, ৩১ জন মহিলা এবং ১৫ শিশু রয়েছে। সবাইকে নিকটবর্তী শহর মাচের একটি অস্থায়ী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ট্রেনে এখনও কতজন পণবন্দি রয়েছেন, তা স্পষ্ট নয়।
গুলির লড়াইয়ে ১৬ বিদ্রোহীর মৃত্যু হয়েছে বলে প্রশাসন জানিয়েছে। যদি তা অস্বীকার করে বিএলএ জানিয়েছে, তাদের সঙ্গে গুলির লড়াইয়ে ৩০ জন জওয়ান মারা গিয়েছেন। পাক প্রশাসনের তরফে এই নিয়ে কোনও মন্তব্য করা হয়নি।
ট্রেন অপহরণের পর বিএলএ দাবি জানিয়েছে, বালোচিস্তানের জেলবন্দি রাজনৈতিক নেতাদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মুক্তি দিতে হবে। পাকিস্তানের জওয়ানদের বিরুদ্ধে বালোচিস্তানের অনেককে অপহরণের অভিযোগ তুলে বিএলএ জানিয়েছে, সেইসব নিখোঁজ ব্যক্তিদেরও মুক্তি দিতে হবে। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দাবি মানা না হলে ট্রেন পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে সশস্ত্র এই সংগঠন।
জাফর এক্সপ্রেস কেন বার বার নিশানায়?

বালুচিস্তানের বোলান। গত ২৪ ঘণ্টায় বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত জায়গা। এই স্থানেই জাফর এক্সপ্রেসকে অপহরণ করেন বালুচ বিদ্রোহীরা। রাতভর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চেষ্টায় এখনও পর্যন্ত
১০৪ জনকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। বিদ্রোহীদের সঙ্গে চলছে পাক সেনার গুলির লড়াই। তবে মঙ্গলবারের ঘটনা নতুন নয়। অতীতেও বার বার জাফর এক্সপ্রেস বিদ্রোহীদের নিশানা হয়েছে।
প্রশ্ন উঠছে, কেন বার বার জাফর এক্সপ্রেসকে নিশানা করেন বিদ্রোহীরা?
২০১৮, ২০১৩, ২০২৪ প্রায় এখনই কায়দায় বালুচ বিদ্রোহীরা এই জাফর এক্সপ্রেসকেই নিশানা করেছেন। এই এক্সপ্রেসে হামলা চালিয়েছেন। কখনও তাঁদের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে, কখনও তাঁরা ব্যর্থ। তবে তার পরও জাফর এক্সপ্রেসই বিদ্রোহীদের লক্ষ্যবস্তু!
২০১৮ সালে পাকিস্তানের পঞ্জাবগামী এই এক্সপ্রেসে নাশকতা হামলার ছক কষেছিলেন স্বাধীনতাপন্থী সশস্ত্র বালুচ গোষ্ঠী বিএলএ (বালুচ লিবারেশন আর্মি)-র বিদ্রোহীরা। কিন্তু সেই হামলা থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পায় ট্রেনটি। লাইনের উপর বিস্ফোরক পেতে রেখেছিলেন তাঁরা। সেই বিস্ফোরক রিমোট দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল। তবে জাফর এক্সপ্রেস যখন বিস্ফোরকের থেকে ২০০ ফুট দূরে, তখন তা বিস্ফোরিত হয়। ট্রেনটি দাঁড় করিয়ে দেন চালক।
বালুচ বিদ্রোহী ছাড়াও টিটিপি (তেহরিক-ই-তালিবান)-র জঙ্গিদেরও নিশানাতেও থাকে জাফর এক্সপ্রেস! মঙ্গলবারের হামলা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ২০২৩ সালে দু’বার জাফর এক্সপ্রেসে একই স্থানে দু’মাসের ব্যবধানে হামলার ঘটনা ঘটে। সেই বছর ১৯ জানুয়ারি সেই বোলানেই বালুচ বিদ্রোহীরা নিশানা করেছিলেন ট্রেনটিকে।

সেটি লাইনচ্যুত হওয়ার পর বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ওই হামলায় অন্তত ১৩ জন আহত হন। ওই ঘটনার এক মাস পর আবার বোলানেই জাফর এক্সপ্রেসকে নিশানা করেন বিদ্রোহী। বালুচিস্তানের রাজধানী কোয়েটা থেকে খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের রাজধানী পেশোয়ারগামী ওই এক্সপ্রেসে হামলা চালানো হয়। মৃত্যু হয় এক জনের, আহত অন্তত ১২।
শুধু জাফর এক্সপ্রেস নয়, গত বছর কোয়েটা স্টেশনে প্রাণঘাতী হামলার ঘটনা ঘটে। ওই বিস্ফোরণের ঘটনায় অন্তত ২৬ জনের মৃত্যু হয়। ৪০ জনের বেশি মানুষ আহত হন।
জাফর এক্সপ্রেসে সাধারণ যাত্রী থাকে বটে, তবে বিশেষত পাক সেনার কর্মীরাই এই ট্রেন যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করেন। গত ২০ বছরের বেশি সময় ধরে বিদ্রোহীরা বালুচিস্তানে গেরিলা কৌশলের উপর নির্ভর করে নানা সময়ে নানা ‘বিদ্রোহে’র ঘটনা ঘটান। ২০১৮ সাল থেকে বিদ্রোহীদের হামলার কৌশলে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা গিয়েছে। অনেক বেশি পরিকল্পিত হামলা চালাচ্ছেন তাঁরা। বেশির ভাগ সময়ই আত্মঘাতী হামলাকে বেছে নিচ্ছেন।
শুধু ট্রেন নয়, বিদ্রোহীদের নিশানায় থাকে যাত্রিবাহী বাসও। তাঁদের কৌশল পরিবর্তনের পর প্রথম হামলার ঘটনা ঘটে ২০১৮ সালের অগস্টে। চিনা ইঞ্জিনিয়ারদের নিয়ে যাওয়া এক বাসে আত্মঘাতী হামলা চালান বিদ্রোহীরা। ২০১৮ সালের পর থেকে গোয়েদর, করাচি, তুরবাত, বোলানের মতো এলাকায় ১০টিরও বেশি আত্মঘাতী বোমা হামলা চালিয়েছেন তাঁরা।

পাকিস্তানের বৃহত্তম প্রদেশ বালুচিস্তান প্রাকৃতিক ভাবে সবচেয়ে সম্পদশালী। কিন্তু ধীরে ধীরে তা বেহাত হয়ে যাচ্ছে বালোচ নাগরিকদের। ‘চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর’ (সিপিইসি) তৈরির পর থেকেই বিদ্রোহীরা জ্বলে উঠেছেন। এই করিডরের প্রতিবাদে বার বার তাঁরা বিদ্রোহ দেখিয়েছেন।
গত অক্টোবরে মাজ়িদ ব্রিগেড (২০১০ সালে কোয়েটায় পাক সেনার হাতে নিহত বিএলএ কমান্ডরের নামে তৈরি গোষ্ঠী) করাচি বিমানবন্দরের কাছে আত্মঘাতী হামলা চালায়। চিন থেকে আগত ইঞ্জিনিয়ার এবং বিনিয়োগকারীদের একটি কনভয়কে তারা লক্ষ্যবস্তু বানায়। বিস্ফোরকবোঝাই একটি গাড়ি ঢুকে পড়ে ওই কনভয়ে। সেই বিস্ফোরণে চিনা নাগরিক এবং তাঁদের নিরাপত্তাকর্মী-সহ কমপক্ষে ৫০ জন নিহত হন।
‘চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর’ (সিপিইসি) তৈরির পরে গত কয়েক বছরে বালুচিস্তানের সম্পদ আরও বেশি মাত্রায় লুট হয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ। সেই লুট আটকাতে এবং বালুচিস্তান নিজেদের দখলে রাখতে বার বার বিদ্রোহীরা পাক সরকার এবং সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। তাঁদের বিদ্রোহ দমনে পাক সরকারও একের পর এক পদক্ষেপ করেছে।

প্রতিবাদ দমন করতে পাক সেনা এবং ফ্রন্টিয়ার কোর বাহিনী সেখানে ধারাবাহিক মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং গণহত্যা চালাচ্ছে বলেও অভিযোগ। হামলা, পাল্টা হামলায় বার বার উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পাকিস্তান।