বাংলার দুর্গাপুজো ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পাওয়ার পর আক্ষেপ ছিল উত্তর ২৪ পরগনার মসলন্দপুরের ঢাকি গোকুল দাসের। খানিকটা হতাশার সঙ্গেই বলেছিলেন, ঢাকের বাদ্যি ছাড়া দুর্গাপুজো ঠিক পুজো হয়ে ওঠে না। কিন্তু বাংলার দুর্গাপুজো ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেয়ে গেলেও এ রাজ্যের ঢাকিদের ভাগ্যে কিছুই জোটে না। অবশেষে গোকুলের সেই আক্ষেপ ঘুচল।
শনিবার রাতে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে পদ্মশ্রী সম্মান প্রাপক হিসেবে নাম ঘোষণা হয়েছে ৫৭ বছরের বাংলার এই খ্যাতনামা ঢাকির। তিনি নিজে তো স্বনামধন্য ঢাকি। সঙ্গে লিঙ্গভেদ ঘুচিয়ে মহিলা ঢাকি তৈরি করেছেন। তাঁর তালিমে ১৫০ জন মহিলা আজ ঢাকের বোলে মুগ্ধ করছেন দেশবাসীকে। এই বিশেষ অবদানের জন্য গোকুলকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করা হচ্ছে।
তাঁর সঙ্গে এবার পদ্মশ্রী সম্মান পাচ্ছেন গোয়ার শতায়ু স্বাধীনতা সংগ্রামী লিবিয়া লোবো সরদেশাই, কুয়েতের যোগা প্রশিক্ষক শাইখা এল জে আল সাহাবা। পদ্ম-পুরষ্কার পাচ্ছেন ব্রাজিলের আধ্যাত্মিক গুরু তথা বেদান্ত দার্শনিক জোনাস ম্যাসেত্তি। একই সম্মান পাচ্ছেন ট্রাভেল ভ্লগার দম্পতি হিউ এবং কলিন গ্যান্টজার। ভারতীয় প্রাচীন ঐতিহ্য নিয়ে লেখালেখি করেন তাঁরা। এছাড়াও ওই সম্মান পাচ্ছেন আধ্যাত্মিক সঙ্গীতের গায়ক ভেরু সিং চৌহান, সাংবাদিক ভীম সিং ভবেশ, ঔপনাসিক জগদীশ যোশিলা, সার্ভিক্যাল ক্যানসার বিশেষজ্ঞ নীরজ ভাটলা।
৭৬ তম সাধারণতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে পদ্মশ্রী প্রাপকদের নাম ঘোষণা করেন রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদি মুর্মু। সবমিলিয়ে এবার ৩০ জনকে দেওয়া হচ্ছে পদ্মশ্রী। পদ্মশ্রী প্রাপকদের নাম ঘোষণার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন রাজ্যের বিজেপি সভাপতি তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার। বলেছেন, পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হওয়ায় গোকুলচন্দ্রকে দাসকে অভিনন্দন। তিনি ঢাকি হিসেবে মহিলাদের ক্ষমতায়ন ঘটিয়ে সমাজের প্রচলিত ধারা ভেঙেছেন।
শোয়ের জন্য এখন দিল্লিতে রয়েছেন গোকুল। সেখানেই পদ্মশ্রীর খবর পান তিনি। খবর দেন বাড়িতে। কলকাতায় রয়েছেন তাঁর দুই ছেলে গোপাল ও নেপাল। তাঁরাও শনিবার নিজেদের অনুষ্ঠান নিয়ে দিনভর ব্যস্ত ছিলেন। তারই মাঝে বাবার এতবড় সম্মান প্রাপ্তিতে খুশিতে আত্মহারা তাঁরা।
ছোটবেলা থেকেই ধ্যানজ্ঞান বলতে ঢাক। বাপ-ঠাকুরদাও ঢাক বাজাতেন। চার বছর বয়সে বাবার কাছেই ঢাকের হাতেখড়ি। ছ’বছর বয়সে কাকার কাঁধে চড়ে প্রথম ঢাক বাজাতে যাওয়া দুর্গাপুজোর মণ্ডপে। ২০১০ সালে জাকির হোসেনের সঙ্গে দক্ষিণ আমেরিকায় গিয়েছিলেন শো করতে। তাঁর ঢাকের বোলে মুগ্ধ হয়েছেন বাংলাদেশ, নরওয়ে, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা, লন্ডন, কেনিয়া সহ নানা দেশ। দেশে এমন কোনও বড় শহর নেই, যেখানে ঢাক বাজাননি গোকুল। পণ্ডিত রবিশঙ্করের সঙ্গে ঢাক বাজানোর সুযোগকে জীবনের সবচেয়ে বড় সম্মান বলে মনে করেন গোকুল। হলিউডের ওই শোয়ে উপচে পড়েছিল দর্শক-শ্রোতার ভিড়। ওই অনুষ্ঠান সম্পর্কে বলতে গিয়ে গোকুল এর আগে জানিয়েছিলেন, আমার ঢাক শুনে পণ্ডিতজি বলেছিলেন, ‘আমাদের সব কম্পোজিশন গোকুল ঢাকের তালে ভাসিয়ে নিয়ে গেল’। এটাই জীবনের আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
পড়াশোনা মাধ্যমিক পর্যন্ত। কিন্তু ঢাকের বিদ্যেয় তাঁর ধারেকাছে ঘেঁষতে সাহস পান না বাংলার অন্য ঢাকিরা। হলিউডের সিনেমা ‘দ্য ওয়েটিং সিটি’ এবং টলিউডে অভিনেত্রী শতাব্দী রায় পরিচালিত ‘ঢাকি’ ছবিতে ঢাক বাজিয়েছেন গোকুল। শতাব্দীর ছবিতে অভিনয়ও করেন তিনি। গাইতে পারেন বাউল গান। গোড়ার দিকে ঢাক বাজিয়ে পেট না চলায় বন্ধ রেখেছিলেন বেশ কিছুদিন। তখন শুধু বাউল গাইতেন। কিন্তু ঢাক ছেড়ে থাকার যন্ত্রণা তাঁকে ঘুমোতে দিত না। ফলে ফের কাঁধে তুলে নেন ঢাক। বাংলার এই ঢাকির ইচ্ছে, ঢাকের বোল নিয়ে বই লেখা। সেই কাজও শুরু করেছেন। ইচ্ছে রয়েছে, তাঁর এলাকায় ঢাকের বাদ্যি শেখার অ্যাকাডেমি খুলবেন। সেখানে শিক্ষা নিতে পারবেন দেশ-বিদেশের ঢাকিরা।
বাবার পদ্মশ্রী সম্মান প্রাপ্তির খবর জানিয়ে ছোট ছেলে নেপাল বলেন, খুবই ভালো লাগছে। বাবা এই সম্মান পাওয়ার যোগ্য। এমন বাবার সন্তান হিসেবে আমি সত্যি গর্বিত। তাঁর কথায়, আমার দাদু ঢাক বাজাতেন। তাঁর কাছেই বাবার ঢাক বাজানো শেখা। ২০০৮ সালে কলকাতায় ঢাক বাজানোর প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে যোগ দিয়েছিলেন বাবা। প্রতিযোগিতায় বাবা প্রথম হন। বিচারক হিসেবে ছিলেন পণ্ডিত তন্ময় বোস। তিনি বাবার ঢাক বাজানো দেখে মুগ্ধ হয়ে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। তারপর থেকেই পণ্ডিতজির কাছে ঢাক বাজানো শেখা শুরু করেন বাবা।
মহিলাদের ঢাক বাজানো শিখিয়েছেন গোকুল। গড়ে তুলেছেন মহিলা ঢাকির দল। গল্পে গল্পে একবার গোকুলবাবু বলেছিলেন, দক্ষিণ আমেরিকায় শো করে ফেরার পথে বড় ছেলে গোপালের জন্য স্যাক্সোফোন কিনতে ঢুকেছিলেন সেখানকার একটি দোকানে। দেখেন, দোকানে এক মহিলা নানারকম বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে দেখাচ্ছেন। তখনই তাঁর মাথায় ভাবনা খেলে যায়, তালিম দিলে মহিলারাও ঢাক বাজাতে পারবেন। বাড়ি ফিরে শুরু করেন ওই কাজ। গ্রামের এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত ঘুরে ঢাক বাজানো শেখানোর জন্য মহিলার খোঁজ করেন। প্রথমে তেমন কেউ রাজি হননি। পরে ধীরে ধীরে সংখ্যাটা বাড়তে থাকে। এখন গোকুলের হাতে তালিম পাওয়া মহিলা ঢাকিরা রাজ্যের নানা প্রান্তে এবং রাজ্যের বাইরেও ঢাক বাজাতে যাচ্ছেন।
কিছুদিন আগেই এক সাক্ষাৎকারে গোকুল বলেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে কিছু ঢাকি শিল্পীকার্ড পেয়েছেন। তাঁরা প্রতিমাসে সরকারের দেওয়া ভাতা পাচ্ছেন। কিন্তু এর বাইরেও অনেক ঢাকি রয়েছেন। তাঁদের জন্যও ওই ব্যবস্থা চালু করা দরকার। সেইসঙ্গে তাঁর আর্জি ছিল, বাংলার ঢাকিদের জন্য পুরষ্কার চালু করা হোক। অবশেষে তাঁর সেই আক্ষেপ ঘুচল।