পার্থ সারথি নন্দী, বাগদা: হেমন্ত শেষে বাতাসে ভেসে আসে ওপার বাংলার নলেন গুড়ের গন্ধ। বাগদা সীমান্তের বাসিন্দাদের এটাই শীতের আগমনী বার্তা। ওপার বাংলার গ্রামে কাঠের আগুনে খেজুর রস জ্বাল দেওয়ার কাজ শুরু হতেই তার গন্ধ বাতাসে ভেসে তা চলে আসে সীমান্তের এপারে কাঁটাতার থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বের বাগদা ব্লকের বেত্রাবতী নদী পারের ঘরে গঘরে৷ আর তখনই তাঁরা বুঝতে পারেন তাঁদের দুয়ারে শীত এসেছে ৷
হ্যাঁ, আর এই সময়ে পাওয়া যায় সুস্বাদু খেজুর গাছের রস। বাংলার বিভিন্ন এলাকায় খেজুর গাছের রস সংগ্রহের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন গাছিরা। তবে আগের তুলনায় বর্তমানে খেজুর গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় এই ঐতিহ্য দিন দিন হারিয়ে যেতে বসেছে। রাসায়নিকের ব্যবহার বাড়ার ফলে গুড়ের নিজস্ব স্বাদ, গন্ধ হারাচ্ছে। আর তাই নির্ভেজাল খেজুর রস ও গুড়ের চাহিদাও বাড়ছে।
তাই খেজুর রস থেকে গুড় তৈরির প্রস্তুতি শুরু উত্তর ২৪ পরগনার বাগদার ব্লকের মুস্তফাপুর গ্রামে।
স্থানীয় বাসিন্দা অজয় প্রামাণিক জানান, বাগদা ব্লকে এক সময় প্রচুর খেজুর গাছ ছিল। বর্তমানে খেজুর গাছের সংখ্যা অনেকটাই কমে গেছে। আষাঢ়ু,বাঁশঘাটা এবং বিশেষ করে মুস্তফাপুর গ্রামে প্রচুর খেজুর গাছছিল যা বেশির ভাগই বিভিন্ন সময়ে কেটে ফেলেছেন শিউলিরা। তবে এই গ্রামের কাঁটাতারের বেড়ার গাঁঘেষে বেত্রাবতী নদীর ওপারে বাংলাদেশের শিকেরপুর গ্রাম থেকে বাতাসে ভেসে আসতে শুরু করেছে নলেন গুড়েরগন্ধ৷ তাতেই আমরা বুঝতে পারছি দুয়ারে শীত এসেছে এবারও খেজুর গুড় মিলবে হয়তো কিছুটা ৷
মুস্তফাপুর গ্রামের বাসিন্দা কুমারেশ মন্ডল বলেন,এক সময় অনেক খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করতাম কিন্তু এখন আবহাওয়ার অনেক পরিবর্তন হয়েগেছে এখন আর আগের মতোন কোন গাছেই তেমন রস মিলত না , যেটুকু রস পাওয়া যেত তা দিয়ে গুড় তৈরী করে বিশেষ লাভ না হওয়ার কারণেই এক প্রকার ক্ষোভের বসেই খেজুর গাছ কেটে ফেলেছেন তাঁর মতো অনেক শিউলি৷ তবে এ বছর বৃষ্টির পর শীতটা বেশ অনুভব হচ্ছে ৷ এখনও মুস্তফাপুর গ্রামে বেশ কিছু খেজুর গাছ রয়েছে স্থানীয় শিউলিদের দাবি এবার হয়তো অনেকটাই রসের মুখ দেখতে পাবেন তাঁরা৷
বর্তমানে খেজুর রস সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত গাছিরা। পূর্ব মেদিনীপুরের খেজুরি থেকে বেশ কয়েকজন খেজুর গাছের রস মারতে প্রতিবছরের মতো এবছরও এসেছেন মোহনপুর ব্লকে।
খেজুর রস তৈরি করেন মিমাই মণ্ডল। প্রতিবছর তিনি গাছ ছাড়িয়ে গুড় তৈরি করেন। শীতকাল ধরে এই কাজ করেন তিনি , তাঁর কথায় প্রথমে গাছগুলি পরিষ্কার করা হয়। এক সপ্তাহ পর গাছে উঠে রস বের করার কাঁঠি লাগান হয় গাছে। সন্ধেয় হাঁড়ি কিংবা রস পড়ার পাত্র বেঁধে দিয়ে আসি। সারা রাত ধরে রস বের হয়। সকালে সেই রস সংগ্রহ করে বাড়িতে নিয়ে এসে আমরা গুড় তৈরি করি।
এই সময় ভোর তিনটে নাগাদ ঘুম থেকে উঠে খেজুর গাছে ওঠা , সেখানে আগের দিনের ঝুলিয়ে রাখা রসের হাঁড়ি নামিয়ে, নতুন হাঁড়ি ঝোলানো ৷ দীর্ঘ পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে রস পাড়া এবং সেই রস নামিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে সেই রসকে আগুনের আঁচে ফুটিয়ে খেজুরের গুড় বা নলেন গুড় তৈরি করেন শিউলিরা ৷ কিন্তু, এত পরিশ্রমের দাম সেভাবে তাঁরা পাচ্ছেন না বলেই অভিযোগ ৷ এক শিউলি জানাচ্ছেন, বাজারে গুড় বিক্রি করতে গেলে ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না ৷ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম দাম পাচ্ছেন তাঁরা ৷ এর মূল কারণ বাজারে ভেজাল নলেন গুড়ের জোগান ৷
যদিও বহুবার প্রশাসনের তরফে গুড় ও রস বিক্রেতারা যাতে কোনও রাসায়নিক ব্যবহার না করেন সেই বিষয়ও সতর্ক করা হয়েছে বলে দাবি এক ব্লক অফিসারের।
শিউলিদের কথায়, বাজারে নলেন গুড়ের সেন্ট মেশানো নকল গুড় ছেয়ে গিয়েছে ৷ যার দাম অনেক কম ৷ ফলে তাঁদের খেজুরের রস দিয়ে তৈরি গুড়ের দাম উঠছে না ৷ আর দাম পাওয়ায় তৈরি করা গুড় কোথায় বিক্রি করবেন শিউলিরা, তা বুঝে উঠতে পারছেন না ৷ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তাঁরা খেজুরের রস থকে নলেন গুড় তৈরি করছেন ৷ কিন্তু, বাজার থেকে দাম না পাওয়ায় সমস্যা বেড়েছে তাঁদের ৷
শিউলিদের আপশোস, শীত এসে গিয়েছে ৷ কিন্তু, খাদ্যরসিক বাঙালির পাতে আসল নলেন গুড় বা তার তৈরি মিষ্টি পৌঁছবে না নকল গুড়ের রমরমার কারণে ৷ আর সেই সঙ্গে তাঁদেরও লোকসান ৷ তবে, এতে তাঁরা হতাশ নন ৷ ন্যায্য দাম না পেলেও, পূর্বপুরুষের দেখানো পথেই হাঁটবেন তাঁরা ৷তাঁদের আশা, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি বদলাবে এবং নলেন গুড়ের ন্যায্য দামও হয়তো পাবেন৷
তবে সোমাবার সন্ধ্যায় বাগদা ব্লকের মুস্তফাপুর গ্রামে গিয়ে বেত্রাবতী নদীর তীরে দাঁড়িয়ে থাকতেই হঠাৎ বাতাসে ভেসে এলো নলেন গুড়ের গন্ধ,পাশে দাঁড়িয়ে এক শিউলি বললেন বাবু এটা ওপার বাংলার খেজুর গুড় যা এখানে মিলবে না।