স্বাধীনতা দিবসের ভাষণেই বাংলাদেশে হিন্দু এবং সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তারপরেই তাঁকে ফোন করে সেখানে হিন্দু এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। শুক্রবার, ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে এই আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। এদিন, সোশাল মিডিয়াতে একটি পোস্টে ইউনূসের ফোন করে এই নিশ্চয়তা দেওয়ার বিষয়টি জানিয়েছেন মোদী।
এদিন মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে থেকে ফোন পান নরেন্দ্র মোদী। সোশাল মিডিয়া X-এ পোস্ট করে ইউনূসের ফোন করার বিষয়টি জানান মোদী। তাতে তিনি জানান, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এদিন ফোন করে তাঁর সঙ্গে সেখানে বিরাজমান পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময় করেন।
একইসঙ্গে একটি গণতান্ত্রিক, স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও প্রগতিশীল বাংলাদেশের প্রতি ভারতের সমর্থন থাকবে সেই কথাও পুনর্ব্যক্ত করেছেন মোদী। ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাতে লিখেছেন যে বাংলাদেশের হিন্দু ও সকল সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা, নিরাপত্তা ও নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছেন মুহাম্মদ ইউনূস।
https://x.com/narendramodi/status/1824395924086354148?t=FgS3IuwyoF-tTR_zbQzIig&s=19
প্রসঙ্গত, গত ৫ তারিখে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী পদে ইস্তফা দেন শেখ হাসিনা। তারপরেই সেখানে আওয়ামি লিগের নেতাদের মতই হামলা এবং আক্রমণ শুরু হয় হিন্দু এবং সংখ্যালঘুদের বাড়ি ও মন্দিরে। সেখানে প্রায় ২৫০টি এই রকম হামলা হয়। এর প্রতিবাদে এবং অত্যাচার বন্ধ করার দাবিতে সেখানে রাস্তায় নামে হিন্দুরা। তারপরেই সেখানে হিন্দুদের সঙ্গে কথা বলে নিরাপত্তা নিয়ে তাদের আশ্বস্ত করেছিলেন ইউনূস।
বৃহস্পতিবার , মোদীর স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে উঠে আসে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। সেখানের পরিস্থিতি নিয়ে তাঁর উদ্বেগের কথা জানান তিনি। সেই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দেশের ১৪০ কোটি মানুষ চাইছেন বাংলাদেশে হিন্দু এবং সংখ্যালঘুরা নিরাপদ থাকুক। আমরা চাই আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলি শান্তি এবং সুখের পথে চলুক।’ বাংলাদেশে দ্রুত শান্তি এবং খুশির পরিবেশ ফিরে আসবে বলেও আশা করেন তিনি। ভারত বাংলাদেশের শুভাকাঙ্ক্ষী হয়েও থাকবে বলেও জানান মোদী।
এদিকে, প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনা যেন সেখানে বসে বিবৃতি না দেন, সে বিষয়টি নিশ্চিতে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে বলেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের বিদেশ বিষয়ক উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। ১৪ আগস্ট বুধবার বিকেলে বাংলাদেশের বিদেশ মন্ত্রকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, ভারত, সৌদির প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে তিনি এসব কথা বলেন। ভারতে বসে শেখ হাসিনা বিবৃতি দিলে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষতি হবে এবং তা ভারতীয় হাইকমিশনারকে বলা হয়েছে জানিয়ে তৌহিদ হোসেন বলেন, “আমি বলেছি এটা সম্পর্ক উন্নয়নে সহায়ক হবে না। এটা আমি তাকে বলেছি। কারণ সরকারের অবস্থান এটাই। এটা নিয়ে তিনি (হাইকমিশনার) কিছু বলেননি, তিনি বলতে পারেনও না। এটা সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তিনি সেখানে সেটি জানাতে পারেন।” তৌহিদ আরও বলেন, “এই আলোচনার প্রেক্ষাপটটা হলো বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর স্টেটমেন্ট এই সরকারের জন্য স্বস্তিকর হচ্ছে না। আমরা চাই তিনি ভারতে বসে যেন এটা না করেন।” শেখ হাসিনার বিবৃতিকে বাংলাদেশ কী হিসেবে দেখবে- এমন প্রশ্নের জবাবে বিদেশ বিষয়ক উপদেষ্টা বলেন, “আমরা সরাসরি হোস্টাইল অ্যাক্ট হিসেবে বলছি না। কিন্তু এটা তো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের অন্তরায়, সেটাই তাকে বলার চেষ্টা করেছি। তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ছেলেকে (সজীব ওয়াজেদ জয়) নিয়ে আমি কোনো কথা বলিনি।” শেখ হাসিনার নামে মামলা হয়েছে, তাকে দেশে ফেরাতে বিদেশ মন্ত্রক উদ্যোগ নেবে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “মামলা হলে তারা (আইন মন্ত্রক) যদি বলে তাকে ফেরত আনতে হবে, আমরা আনব। না হলে বিদেশ মন্ত্রকের এ ব্যাপারে কিছু করার নেই। এটা দুটি মন্ত্রকের কাজ- একটি হলো স্বরাষ্ট্র ও আরেকটি আইন। তারা যেভাবে পরামর্শ দেবে, সেভাবেই আমরা কাজ করব।” বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যু নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে কিছু বলেছেন কি না- জানতে চাইলে তৌহিদ হোসেন বলেন, “আমি বলেছি এখানে কিছু ঘটনা ঘটেছে সেটি আমরা খবর নিয়েছি, প্রধান উপদেষ্টা হিন্দু সম্প্রদায়সহ অন্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করছেন। আমরা চাই সবাই সুখে-শান্তিতে থাকতে পারে, কারও ওপর হামলা সরকার সহ্য করবে না। দোষীদেরও বিচারের আওতায় আনা হবে। তাকেও (হাইকমিশনার) বলেছি ভারতের গণমাধ্যম এটাকে অতিরঞ্জন করে খারাপ পরিবেশ তৈরি করছে, এটা ঠিক নয়৷” সীমান্ত ইস্যু নিয়ে ভারতের হাইকমিশনারের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা বলেছি কিছু সমস্যা আছে। এই একটি ইস্যু আমরা দুই পক্ষ চাইলে সমাধান করতে পারি। আমি যখন মুক্ত মানুষ ছিলাম তখন প্রচুর লিখেছি, সেটা আমার বিশ্বাস। আমরা চাইলে এটা পারি।”
এদিকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে আরও চারজন শপথ নিলেন। ১৬ আগস্ট শুক্রবার বিকেল ৪টা ১০ মিনিট নাগাদ তারা শপথ নেন। ঢাকার বঙ্গভবনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন তাদের শপথবাক্য পাঠ করান। শপথ নেওয়া নয়া চার উপদেষ্টা হলেন অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, বাংলাদেশ রাইফেলস তথা বিডিআরের (বর্তমান নাম বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি) সাবেক মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ও সাবেক সচিব মুহাম্মদ ফাওজুল করিম খান৷ এদের মধ্যে অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি পড়াতেন। তিনি ১৯৯৬ সালে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ছিলেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শৈশব পার করা এই অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশে এনজিওগুলোর ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচিতে অর্থায়নকারী শীর্ষ সংস্থা পিকেএসএফের সহপ্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। আলী ইমাম মজুমদার ১৯৫০ সালে কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন৷ তিনি ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের প্রশাসন ক্যাডারের সদস্য হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন৷ চাকরিজীবনে তিনি মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের মুখ্য সচিব ও পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন৷ বর্তমানে তিনি জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেটিভ এজেন্সির (জাইকা) বিভিন্ন প্রকল্পের পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন৷ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে ৩ তারকা জেনারেল হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) সঙ্গে সংঘর্ষের সময় এবং বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বঙ্গ সেনা জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে সংঘর্ষের সময় তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলসের (বিডিআর) প্রধান ছিলেন। জাহাঙ্গীর আলম বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার ছিলেন ও একই সময়ে তাকে কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল পদে উন্নীত করা হয়। তাকে তৎকালীন রাষ্ট্রপতির বাসভবন বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতিকে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে বলার কৃতিত্ব দেওয়া হয়। এ ঘটনার মাধ্যমে ২০০৭ সালে সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসে। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব পালনকারী ফাওজুল কবির খান সামসময়িক আর্থসামাজিক বিষয়ে নিয়মিত নিবন্ধ লিখে থাকেন। আমেরিকার বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রিধারী এই প্রাক্তন আধিকারিক রাষ্ট্রীয় তথা সরকারি চাকরি থেকে লিয়েন নিয়ে ১৯৯২ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত সিঙ্গাপুর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা করেন। ১৯৯৮ সালে তিনি নন-ব্যাংক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান ইডকল প্রতিষ্ঠা করেন ও ২০০৭ সাল পর্যন্ত সেখানে প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হলেও বিভিন্ন ঘটনায় মন্ত্রক ও দপ্তরগুলো কার্যত অচল ছিল। এ অবস্থায় এগুলো দ্রুত কার্যকরের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তারই অংশ হিসেবে সরকারের আকার বাড়ানো হচ্ছে। গত ৮ আগস্ট ড. ইউনূসের নেতৃত্বে শপথ নেয় বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ সরকারে রয়েছেন ১৬ জন উপদেষ্টা। নতুন চারজন শপথ নেবার পর প্রধান উপদেষ্টাসহ এখন মোট উপদেষ্টার সংখ্যা দাঁড়ালো ২১ এ৷