চিন ও পাকিস্তানের আঁতাঁত নিয়ে ক’দিন আগেই গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদী। আবার বাংলাদেশ–পাকিস্তানের ‘নৈকট্য’ নিয়েও দুশ্চিন্তার সুর ছিল তাঁর গলায়। এ বার ভারতের চিন্তা নিশ্চিত ভাবেই বাড়াবে বাংলাদেশ ও চিনের কাছাকাছি আসা।
আগামী ২৬ মার্চ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস যাচ্ছেন চিন সফরে। সূচি অনুযায়ী, ২৭শে ইউনূস ‘বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া অ্যানুয়াল কনফারেন্স’–এর অধিবেশনে যোগ দেবেন। ওই দিনই চিনের স্টেট কাউন্সিলের নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তাঁর দেখা হতে পারে। ২৮শে চিনা প্রেসিডেন্ট শি জ়িনপিংয়ের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকেও বসার কথা তাঁর।
ওয়াকিবহাল মহলের দাবি, ভারতের চিন্তা বাড়াবে ইউনূসের সফরের ‘প্রক্রিয়া’ এবং চিন–বাংলাদেশের সম্ভাব্য আলোচনার নেপথ্যে থাকা সম্ভাব্য কয়েকটি বিষয়। যদিও সাংবাদিক বৈঠকে এ দিনই বাংলাদেশের বিদেশ উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন জানিয়ে দেন, ইউনূসের চিন সফরে কোনও চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে না দু’দেশের মধ্যে। তবে কয়েকটি মউ স্বাক্ষরিত হতে পারে বলে জানান তিনি। চিনের ‘গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ’–এ কি বাংলাদেশ যোগ দেবে? তৌহিদের জবাব, ‘নিশ্চিত নই। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। সাধারণ ভাবে আপত্তি নেই। তবে আমরা এর অংশ হব কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে।’
তাৎপর্যপূর্ণ ইউনূসের সফরসূচিও! বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা চিনে রওনা দিচ্ছেন কিন্তু দেশের স্বাধীনতা দিবসেই! এ–ও কি তবে ‘রিসেট বাটন’ প্রেস করে ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা— প্রশ্নটা কিন্তু উঠেই গেল।
সূত্রের খবর, বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টাকে চিনে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে চিনেরই বিশেষ চার্টার্ড বিমানে।
ইউনূসের চিন সফর ‘মাইলফলক’ হবে বলে এ দিন মন্তব্য করেন ঢাকায় নিযুক্ত চিনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন।
রবিবার ঢাকার বিদেশসচিব মহম্মদ জসীমউদ্দিনের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘অপেক্ষা করুন এবং দেখতে থাকুন, এই সফরে গুরত্বপূর্ণ ঘোষণা আসতে পারে।’ ইউনূসের চিন–সফর নিয়ে সরাসরি কোনও মন্তব্য না–করলেও সূত্রের খবর, শনিবার সংসদীয় কমিটির বৈঠকে বাংলাদেশ–চিন সম্পর্ক প্রসঙ্গে বিদেশমন্ত্রী জয়শংকর বলেন, ‘এই ক্ষেত্রে চিন ভারতের শত্রু নয়, বরং তারা আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী মাত্র।’
সূত্রের খবর, চিন–বাংলাদেশ বৈঠকে আলোচনায় বাংলাদেশের দু’টি পরিত্যক্ত এয়ারস্ট্রিপ নতুন করে চালুর বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। এর একটি লালমনিরহাটে, অন্যটি সিলেটের মৌলবীবাজারে। এই দু’টি এয়ারস্ট্রিপ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকেই অচল পড়ে আছে। আগে এগুলি সচল থাকলেও যাত্রী পরিবহণ কমই হতো। সূত্রের দাবি, মূলত ভারতের উপরে নজরদারির জন্যই এই এয়ারস্ট্রিপগুলিকে আবার চালু করার চিন্তা চলছে।
ইতিমধ্যে গত দু’-তিন মাসে পাকিস্তানের একাধিক সেনাদল গোপনে বেশ কয়েকবার এই জায়গাগুলি পরিদর্শন করে গিয়েছে। মূলত পাকিস্তানের পরামর্শেই এ সব এয়ারস্ট্রিপ সংস্কারে টাকা লগ্নি করতে চায় চিন। সেখানে উচ্চ ক্ষমতার টাওয়ার বসানো হতে পারে। এই পরিকল্পনা সফল হলে পশ্চিমবঙ্গের মালদা এবং অসমের উপরে সহজেই নজরদারি চালানো যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সূত্রের খবর, গত বছর অগস্টে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকে ছ’–সাত মাসে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামি, জাতীয় নাগরিক পার্টির ছাত্র–যুব–সাংস্কৃতিক মঞ্চের নেতাদের একাধিকবার চিন সফর করানো হয়েছে। এরপরে ঢাকাকে হাতের মুঠোয় আনতে রাজনৈতিক নেতাদের সফরের কৌশল তৈরি হয়। সম্প্রতি চিনের বিদেশমন্ত্রীর আমন্ত্রণে সে দেশে সফর করে এসেছেন বাংলাদেশের বিদেশ উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন।
তারপরে ইউনূসকে সরাসরি ঢাকা থেকে চিনে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে বৈঠকের প্রস্তুতি এবং পুরোনো দু’টি এয়ারস্ট্রিপকে নতুন করে সাজানোর ভাবনা কৌশলগত দিক থেকে ভারতের কাছে চিন্তার— এমনটাই মত কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের বড় অংশের। শুধু তা–ই নয়, তিস্তা নদীর বাংলাদেশের অংশে ড্যাম তৈরির প্রকল্প নিয়েও দু’দেশের বৈঠকে আলোচনা হতে পারে। পরিসংখ্যান বলছে, অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকে ১৪টি চিনা কোম্পানি বাংলাদেশে ২১৩ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। এমনকী, জুলাই–অগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আহত রোগীদের প্রথম একটি দল গত ১০ মার্চ উন্নত চিকিৎসার জন্য চিনে গিয়েছে বলেও সম্প্রতি জানান চিনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন।
গত বছর ৫ অগস্ট হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামি লিগ সরকারের পতনের পরে যে ভাবে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই–এর আধিকারিকদের ঢাকায় আনাগোনা বেড়েছে, তাতে এমনিতেই চিন্তা বেড়েছে বিশেষ করে ভারতের পূর্ব সীমান্তে। এর উপরে আবার বাংলাদেশের কট্টরপন্থী নেতারা বারবার হুঁশিয়ারির সুরে কখনও ‘সেভেন সিস্টার্স’কে আলাদা করার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, কখনও বা তাঁদের মুখে শোনা গিয়েছে বাংলা–বিহার–ওডিশাকে ছিনিয়ে আনার হুমকি।
কট্টরপন্থী ও নাশকতার দায়ে অভিযুক্ত বেশ কয়েকজন সন্দেহভাজন মুক্তিও পেয়েছেন ইউনূস সরকারের আমলে। তাই এ রকম একটা প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার চিন সফর এবং সেই সফরে যদি বাংলাদেশের দু’টি এয়ারস্ট্রিপকে চিন–পাকিস্তানের পরিকল্পনামাফিক ফের ঢেলে সাজিয়ে নজরদারির পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়, তাতে ভারতের সীমান্ত নিরাপত্তায় যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ থেকে যাচ্ছে।
ওয়াকিবহাল মহলের একাংশের মতে, ভারতের পাশে দাঁড়িয়ে আমেরিকার ডোনাল্ড ট্রাম্প সরকারের গোয়েন্দাপ্রধান তুলসী গাবার্ড ক’দিন আগে যে ভাবে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন, সার্বিক আইন–শৃঙ্খলা, ইসলামিক খিলাফত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা–সহ নানা বিষয়ে সরাসরি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তাতে ইউনূসও বুঝতে পারছেন পাকিস্তানের পাশাপাশি চিনের আরও কাছাকাছি আসার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টা। ঢাকার সাম্প্রতিক গতিপ্রকৃতির উপরে নজর রাখছে নয়াদিল্লি।