মনসা মঙ্গল……।। অশোক মজুমদার/দেশের সময়ঃ

0
568

মনসা মঙ্গল……।।

অশোক মজুমদার/দেশের সময়ঃ

কিছুদিন আগে রাতে বাড়ি ফিরছিলাম। হঠাৎ রাস্তায় আচমকা পথ আটকে দাঁড়ালেন এক মাঝবয়সী মহিলা। একটু সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার বলুন তো? তিনি বললেন, আমার আবার কী ব্যাপার? ব্যাপার তো সব তোদের! আমার বাহনদের ওপর জুলুমবাজি করবি, আর তারা তা সহ্য করতে না পেরে কাউকে কাটলেই তাদের দোষ? আমি বললাম, দেখুন আপনার বোধ হয় ভুল হচ্ছে। আমি কারোর ওপর জুলুমবাজি করিনি আর আমাকে কেউ কাটেওনি।

সে কথা উড়িয়ে দিয়েই তিনি বললেন, আরে মহা উজবুক তো, আমি কি তোর কথা বলছি? বলছি তোদের মত মানুষদের কথা। আমার হতভম্ব ভাব দেখে বোধহয় তাঁর কিঞ্চিৎ করুণা হল। বললেন, আরে আমি বলছি হাসনাবাদের কালিদাসী মণ্ডলের কথা। তোদের কাগজপত্তরে তো তার নাম এখন খুব ছাপছে। স্বামী পরিত্যক্তা অভাবী মেয়ে, আমার নামগান গেয়ে সংসার চালাতো, তার এমন দুর্মতি কেন হল বুঝতে পারলাম না। জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার নামটাই তো জানা হল না। ঝাঁঝালো গলায় উত্তর এল, রাতে আমার নাম করতে নেই। ব্যস, এতক্ষণ আমি ঠিক ট্র্যাকটা পাচ্ছিলাম না। বিদ্যুৎ চমকের মত আমার মনে পড়ে গেল হাসনাবাদের কদমতলা গ্রামের কালিদাসী মণ্ডলের কথা। কিছুদিন আগেই হাতে বিষধর সাপ জড়িয়ে মা মনসার ভাসান গান গাইতে গিয়ে যিনি সাপের ছোবলে মারা গেছেন।

আমার মুখ চোখের ভাব দেখে তিনি বললেন, যাক চিনতে পেরেছিস তাহলে? আমি বললাম, হ্যাঁ, কিন্তু আপনার ভক্ত আপনার নামগান গাইতে গিয়ে আপনারই বাহনের ছোবলে মারা গেল, এটা কি ঠিক হল? দেবী মনসা এবারে একটু অপ্রস্তুত হলেন। মুখ নামিয়ে বললেন, নারে আমিও খুব কষ্ট পেয়েছি। গরীব মেয়ে, ওর আয়েই তো সংসার চলতো। আরে আগে তো প্লাস্টিকের সাপ হাতে জড়িয়ে আমার ভাসান গান গাইতো। কি যে দুর্মতি হল, হাতে সত্যিকারের সাপ নিয়ে দর্শককে চমক দিতে চাইল। ওই বদমাইশ ওঝাটাই, দয়াল ঠাকুর না কি যেন একটা নাম, ওকে এই বুদ্ধি দিয়েছিল বলে শুনেছি। এমন কি সাপে কাটার পর ওই দয়ালই ওকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে দেয় নি। এখন দোষ হল আমার সাপের। বিষধর সাপ নিয়ে খেলা দেখিয়ে যে ও ভুল করেছিল, সাপ সম্পর্কে নানা ভুল ধারণা ও কুসংস্কারে ভোগা স্থানীয় মানুষ যে দয়ালের বুজরুকিতে বিশ্বাস করেছিল তা নিয়ে তো তোরা কিছু বলছিস না? সাপ নয়, কালিদাসীকে মেরেছে মানুষের কুসংস্কার আর লোভ।

আমি বললাম, আপনার ওপর তো এখনও মানুষের বিশেষ করে গ্রামবাংলার মানুষের পরম বিশ্বাস। আদতে তারা আপনাকে ভয় করে। নিরীহ মানুষগুলিকে আপনার চ্যালা চামুণ্ডারা যেখানে সেখানে ছোবল মারে তখন তো আপনি কিছু বলেন না? দেবী বললেন, দ্যাখ,ওরা কিন্তু মানুষকে ভয় করে, এড়িয়ে চলতে চায় মানুষকে। তোরা না জেনে ওদের কাছে চলে যাস বলে কিংবা অসতর্ক ভাবে আঘাত করে ফেলিস বলে আত্মরক্ষার জন্য ওরা কামড়ায়। ওরাই বা কোথায় যাবে বল? জলা জঙ্গল সব তো তোরা কেটে সাফ করে দিচ্ছিস। গ্রামগঞ্জে আমার থানগুলোর আশেপাশে কিছু সাপ থাকে বটে কিন্তু তারা তো সংখ্যায় বেশি নয়।

দেবী বলেন, সাপের ছোবলে মৃত্যুর সংখ্যা এখন আগের তুলনায় অনেক কম। তোদের এই বেহুলা লক্ষ্মীন্দরের দেশে সাপে কাটার চিকিৎসার এখন খুব উন্নতি হয়েছে। সময়মত হাসপাতালে নিয়ে গেলে কিংবা কাছের স্বাস্থ্য কেন্দ্রে অ্যান্টি ভেনম ইঞ্জেকশন দিলে মানুষ বেঁচে যায়। তোদের এই রাজ্যে যে মেয়েটা মুখ্যমন্ত্রী হয়েছে তার চেষ্টায় সর্পাঘাতে মৃত্যু কমেছে। এখন মানুষ আমাকে আর আগের মত ভয় পায় না। কালিদাসীকে যদি দয়াল ওখানে ঝাড়ফুঁকের নামে চারঘন্টা ফেলে না রাখতো তাহলে সেও বেঁচে যেত।

আসলে তোদের শহর এখন খুব ঝাঁ চকচকে হয়েছে, পালিয়েছে সাপখোপ কিন্তু মানুষের কুসংস্কার পালায়নি। তোর এই সল্টলেকেই আগে ছিল সাপের রাজত্ব। আমি প্রতিবাদ করে বলি, আমার কোন কুসংস্কার নেই। নইলে রাতে আপনার সঙ্গে এতক্ষন কথা বলতাম না। দেবী ক্ষেপে বললেন, ছাড়তো তোর মত এক দুজনকে আমি ধরিনা এখনও তোদের শহরে কুসংস্কার, ঝাড়ফুঁক রমরম করে চলছে।এইতো সেদিন দেশপ্রিয় পার্কের কাছে দেখলাম, ভূতনাথ ঘুঘু বলে এক তান্ত্রিক কলেজে পড়া একটা মেয়েকে ভুত তাড়ানোর নামে ঝাঁটাপেটা করছে। লোকে আবার সেটা ভিড় করে দেখছে! বাড়ির লোকই ওকে ওই বুজরুকটার কাছে নিয়ে এসেছে। হাসনাবাদের গণ্ডগ্রাম নয় এ ঘটনা ঘটছে তোদের শহরের পশ এলাকার দেশপ্রিয় পার্কের কাছে। হাসনাবাদের সঙ্গে দেশপ্রিয় পার্কের আর কি তফাৎ রইলো! বড় বড় কথা বলছিস আবার!

দেবী তখন একেবারে ফুল ফর্মে। তিনি তখন বলে চলেছেন, কালিদাসীর মৃত্যুতে সাপেদের দোষ দিয়ে লাভ নেই, তোদের কুসংস্কার আর ভুল ধারণাগুলোকে তাড়া। বন্ধ কর ওই দয়াল আর ঘুঘুদের বুজরুকি ব্যবসা। তাহলেই অনেক মৃত্যু, দুর্ভোগ, অর্থদণ্ড কমবে। এসবের সঙ্গে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই। যার নাম করে গোটা দেশে এত কুসংস্কারের চাষ, একি কথা শুনি সেই দেবীর মুখে। কেমন যেন একটা ভাব এসে গেল আমার। দেবীর সামনে হাতজোড় করে চোখ বুজে ফেললাম। এভাবে কতক্ষণ ছিলাম জানিনা। হঠাৎ খসখস আওয়াজে চোখ খুলে দেখি পাশ দিয়ে একটা সাপ চলে যাচ্ছে।

অশোক মজুমদার/দেশের সময়ঃ

Previous articleVisva Bharati to reach out to over 100 villages and help them evolve: Modi/ Desher Samay,Shantiniketan,
Next articleভোটের দিন বাগদায় হামলা, তৃণমূলের বিক্ষোভ মিছিল বনগাঁয়: দেশের সময়ঃ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here