দেশের সময় কৃষ্ণনগর : বিজেপি এবার কৃষ্ণনগর কেন্দ্র থেকে প্রার্থী করেছেন রাজপরিবারের সদস্য অমৃতা রায়কে। এরপরেই মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে ব্রিটিশদের ‘সম্পর্ক’ নিয়ে সুর চড়িয়েছিল তৃণমূল। রবিবার ধুবুলিয়ার সভা থেকে এই নিয়ে সুর চড়ালেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
তিনি বলেন, ‘ সিরাজউদ্দৌলাকে বাংলার লোক সমর্থন করে, মীরজাফরকে করে না। সিরাজউদ্দৌলা ভালো না খারাপ তা নিয়ে আমি আলোচনা করছি না। যে লোকটা লর্ড ক্লাইভের বন্ধু হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধকে খতম করার জন্য, সেই নামটাকে নিয়ে এসে— মোদীবাবু আপনি কি ইতিহাস ভুল গেলেন?’
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংযোজন, ‘আবার বলছে রাজমাতা। কোথা থেকে মাতা রাজ হল? এখন দেশে তো আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে। আমরা সবাই প্রজা কেউ রাজা নেই। যাঁরা যাঁরা রাজা আছেন, তাঁরা গিয়ে রাজপ্রাসাদে থাকুন। সেখানে গিয়ে জনগণের ধর্ম পালন করুন। মিথ্যার আশ্রয় নেবেন না। তাহলে কিন্তু ইতিহাসের পাতা উল্টাব। আর তা করলে জায়গা পাবেন না, মানুষ ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করবে। ‘
‘প্রার্থী পাচ্ছে না বিজেপি’, এই কটাক্ষ সামনে রেখে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘একটা এত বড় রাজনৈতিক দল, শুধু ইডি- সিবিআই করে, আবাসের-১০০ দিনের টাকা দেয় না-খালি বড় বড় কথা বলে।’
লোকসভা থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল সাংসদ মহুয়া মৈত্রকে। পাশে দাঁড়িয়েছিল দল। সেই মহুয়া মৈত্রের কেন্দ্র থেকেই প্রচার শুরু করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কৃষ্ণনগর সভা থেকে মমতার হুঁশিয়ারি, মানুষই মহুয়া মৈত্রকে জিতিয়ে দেবে।
লোকসভা নির্বাচনের প্রথম প্রচার সভা থেকে মমতা বলেন, ‘মহুয়ার উপরে দেখেছেন কী অত্যাচার হয়েছে, তাঁকে লোকসভা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। কারণ, সে জোরে জোরে কথা বলত।’ মহুয়া মৈত্রকে বহিষ্কার করার পর তৃণমূল কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব মহুয়ার পাশে দাঁড়ায়। লোকসভা নির্বাচনের প্রার্থী ঘোষণার আগেই তাঁকে কৃষ্ণনগর থেকে প্রার্থী করা হচ্ছে বলে জানিয়ে দেন মমতা।
এদিনের সভায় মহুয়ার বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্ত নিয়েও সরব হন মমতা। তিনি বলেন, ‘ভোটে দাঁড়ানোর পরেও তাঁর বাবা-মা বেচারা কিছু জানেন না, তাঁদের বাড়িতে রেড করে এসেছে। ওদের কাজ মহুয়াকে যেভাবে হোক হারানো। মহুয়াকে আপনারা জেটাবেন। রানাঘাটেও জেতাবেন।’ ২০১৯ সালে এই কেন্দ্র থেকে মহুয়া মৈত্রকে টিকিট দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
প্রায় ৬০ হাজারের কাছাকাছি ব্যাবধানে সেবার বিজেপি প্রার্থী কল্যাণ চৌবেকে হারিয়েছিলেন তিনি। এবার যদিও এই কেন্দ্রে প্রার্থী বদল করছে বিজেপি। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির বধূ অমৃতা রায়কে দাঁড় করিয়েছে বিজেপি।
বিজেপি প্রার্থীকে নিয়েও এদিন কটাক্ষ শোনা যায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে। টেনে আনেন, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে ব্রিটিশদের যোগাযোগের বিষয়টি। প্রসঙ্গত, অর্থের বিনিময়ে প্রশ্নের মামলায় লোকসভা থেকে মহুয়া মৈত্রকে বহিষ্কার করা হয়। পরে লোকপালের নির্দেশে মহুয়া মৈত্রের বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্ত শুরু হয়। এমনকি, কিছুদিন আগে আদর্শ আচরণবিধি চালু থাকার মাঝেই মহুয়া মৈত্রের কৃষ্ণনগরের বাড়িতে এবং কলকাতায় আলিপুরের বাড়িতে হানা দেয় সিবিআই।
বিষয়টি নিয়ে আগেই সরব হয়েছিলেন মহুয়া মৈত্র। এভাবে আদর্শ আচরণবিধি থাকার মাঝে সিবিআই তদন্ত চালাতে পারে কিনা, কোনও প্রার্থীর বাড়িতে তল্লাশি চালাতে পারে কিনা, সেই বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন মহুয়া। ভোটের মাঝে কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলির পদক্ষেপ নির্দিষ্ট গাইডলাইন দাবি করে নির্বাচন কমিশনে চিঠি দেন মহুয়া। বিদেশি মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন লঙ্ঘন করার একটি মামলায় তাঁকে ইডি তলব করে দুদিন আগেই। ইডি তলব এড়িয়ে নিজের প্রচারেই ব্যস্ত ছিলেন মহুয়া মৈত্র। তবে কৃষ্ণনগর আসনটি এবারের লোকসভা নির্বাচনেও জিততে মরিয়া তৃণমূল কংগ্রেস, সেই বার্তাই এদিনের জনসভা থেকে দিয়ে যান তৃণমূল নেত্রী।
এদিন মতুয়াদের উন্নয়নের জন্য কী কী পদক্ষেপ করেছে তাঁর সরকার, তা সামনে রাখেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘বড়মা যখন বেঁচেছিলেন ১৫ বছর ধরে চিকিৎসা আমি করাতাম, মতুয়াদের বিশ্ববিদ্যালয় আমি করেছি।’ পাশাপাশি সিএএ নিয়েও সরব হতে দেখা যায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে।
তিনি বলেন, ‘২০১৯ সালে আইন পাশ হয়েছিল। ১ বছর আগে কেন করল না? কেন নির্বাচনের আগে তা ঘোষণা হল! ভুলেও ওখানে আবেদন করতে যাবেন না।’ বিজেপি-কে ‘ভাঁওতাবাজির দল’ বলে তোপ দাগেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এদিন মহুয়া মৈত্রের পাশে দাঁড়িয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘মহুয়াকে জেতাবে মানুষ। আপনারা জয়ী করার পর ওকে তাড়িয়ে দিয়েছে। ওকে জেতালে যোগ্য জবাব দিতে পারবে। বিজেপি-র যে মুখোশ রয়েছে তা টেনে ছিঁড়ে ফেলতে পারবে।’
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এদিন বলেন, ‘আমরা কথা দিলে কথা রাখি। ওরা কথা দিয়ে ভোট মাপে। আর মোদীর গ্যারেন্টি মানে মিথ্যে কথার গ্যারেন্টি। ওরা জিরো, তৃণমূল কংগ্রেস হিরো। এটা মাথায় রাখবেন।’
এদিন কৃষ্ণনগরের ধুবুলিয়ায় জনসভা থেকে বিজেপি-সিপিএম-কংগ্রেস এবং নাম না করে আইএসএফকে একই বন্ধনীতে রেখে মমতার দাবি, “বাংলায় জোট হয়নি, ঘোট হয়েছে। সিপিএম-কংগ্রেসকে ভোট দেওয়া মানে বিজেপিকে ভোট দেওয়া।”
তৃণমূল নেত্রী এও জানিয়েছেন, “ইন্ডিয়া জোট আমি তৈরি করেছি। নামটাও আমার দেওয়া। ভোটের পর ওটা দেখে নেব।” পর্যবেক্ষকদের মতে, ভোটের আগে আসন সমঝোতা না হলেও প্রয়োজনে ভোটের পর ফের ইন্ডিয়া জোটে যোগ দিতে পারে তৃণমূল, সে ইঙ্গিতও এদিন মমতা দিয়ে রাখলেন।
এরপরই মোদীকে কটাক্ষ করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “কোথাও দেখেছেন যে বিয়ে করে সেই পুরোহিত! এটা দেশের ভোট। অথচ ইলেকশন করছে বিজেপি। নিজেদের জেতাবার জন্য সব লোক ঠিক করেছে বিজেপি। তবু বলছি, বাংলায় গো হারান হারাব।”
কেন তৃণমূলকে ভোট দেবেন আর কেন বিজেপিকে ভোট নয়, এদিনের সভা থেকে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন মমতা। ১০০ দিনের কাজ, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, বিনা পয়সার রেশনের প্রসঙ্গ টেনে তৃণমূল নেত্রী বলেন, “বিজেপি ক্ষমতায় এলে সব প্রকল্প বন্ধ করে দেবে। নিশ্চয়ই বাংলার সর্বনাশ কেউ চান না।”
এরপরই জনতার উদ্দেশে তৃণমূল নেত্রী জানতে চান, “ভরসা আছে, বিশ্বাস আছে?” সমস্বরে জনতার সস্মতি শোনার পর মমতা বলে, “তাহলে আমাদের সঙ্গেই থাকুন। ওদের মিথ্যের প্ররোচনায় পা দেবেন না। সবাইকে বলব, প্রার্থনা করুন, যেন দেশ ভাল থাকে।”
খানিক থেমে যোগ করেছেন, “দেশ ভাল নেই। কারণ, একটা জুমলা সরকার। নির্বাচন চালু হয়ে যাওয়ার পরও আমাদের নেতাদের বাড়িতে সিবিআই, এনআইএ, ইডি পাঠানো হচ্ছে। দেখলেন না মহুয়ার ওপর কী অত্যাচারটাই না করল। ওর অপরাধ, ও সংসদে বিজেপির বিরুদ্ধে মুখ খুলতো। লোকসভা থেকে তাড়িয়েও ক্ষান্ত হয়নি। এখনও বাড়িতে ইডি, সিবিআই পাঠাচ্ছে।”
নাম না করে সন্দেশখালির বিজেপি প্রার্থীর প্রসঙ্গও টেনে এনেছেন মমতা। মোদীর উদ্দেশে বলেন, “যাকে প্রার্থী করেছেন সে তো রাজ্যের স্বাস্থ্য সাথী এবং লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের সুবিধা গ্রহণ করেন!”
২৪ এর ভোটে ৪০০ পারের কথা বলছেন বিজেপির শীর্ষ নেতারা। সেই প্রসঙ্গ টেনে মমতা বলেন, “অতই যদি ৪০০ পার করার ক্ষমতা থাকে, তাহলে ভয় পেয়ে ইডি, সিবিআই পাঠাচ্ছো কেন?” খানিক থেমে তাচ্ছিল্যের সুরে মমতা বলেন, “৪০০ পার! আগে ২০০ পার করে দেখা!”
গত পরশু সিএএর কারণে মণিপুরে আরও ২ জনের মৃত্যু হয়েছে দাবি করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “সিএএ মাথা। ল্য়াজা হল এনআরসি। সিএএ করলেই এনআরসিতে পড়ে যাবেন। বিজেপি নেতারা কেন সিএএ-তে আবেদন জানাচ্ছেন না? করলেই বিদেশি হয়ে যাবেন। তাই বলছি, বাংলায় সিএএ হতে দেব না। কোনও প্রশ্নেই বিজেপির সঙ্গে কম্প্রোমাইজ নয়।”