
দেশের সময় : শুরু হয়েছে মহাকুম্ভ ২০২৫। প্রতি ১২ বছর অন্তর কুম্ভস্নানের পূ্ণ্যতিথি আসে। এবার হচ্ছে মহাকুম্ভ। ১৪০ বছরে প্রথমবার এই পূণ্য তিথি এসেছে। কুম্ভে পূণ্য স্নান করতে প্রয়াগরাজে ভিড় জমিয়েছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। দেশ-বিদেশ থেকে এসেছেন তারা। এই কুম্ভে এসেছেন নাগা সন্ন্যাসীরাও।

বিশ্বের প্রাচীনতম ও বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসবগুলির মধ্যে অন্যতম কুম্ভমেলা । এই উৎসব শুধু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান নয়, বরং এটি ভারতের দীর্ঘ আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের এক চিরন্তন স্মারক। হাজার হাজার বছরের পুরনো এই মেলার বর্ণনা রয়েছে পুরাণে।

এ মেলা এমনই যা কোটি কোটি ভক্তের মিলনস্থল, যেখানে ঐতিহ্য ও বিশ্বাস মিলেমিশে এক অনন্য আধ্যাত্মিক পরিবেশ তৈরি করে। মহাকুম্ভ ২০২৫ সালের (Kumbh Mela 2025) প্রয়াগরাজে শুরু হয়েছে ১৩ জানুয়ারি এবং শেষ হবে ২৬ ফেব্রুয়ারি। প্রতি ১২ বছর অন্তর পূর্ণ কুম্ভ হয়। এবার তেমন নয়। তবে উত্তরপ্রদেশের যোগী সরকার একে বলছে মহাকুম্ভ।

হিন্দু পুরাণে কুম্ভমেলার উৎপত্তি জড়িয়ে আছে সমুদ্র মন্থনের সঙ্গে। পুরাণ অনুসারে, দেবতা ও অসুরেরা অমৃতের সন্ধানে সমুদ্র মন্থন করেছিলেন। অমৃতের কুম্ভ ছিনিয়ে নেওয়ার সময়ে এর কয়েকটি ফোঁটা ভারতের চারটি স্থানে পড়ে—প্রয়াগরাজ, উজ্জয়িনী, নাসিক ও হরিদ্বারে। এই স্থানগুলিই কুম্ভমেলার পবিত্র তীর্থক্ষেত্র, যেখানে গঙ্গাস্নান আত্মার পরিশুদ্ধি ও জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তি দেয় বলে মানুষ বিশ্বাস করে।

প্রাচীন ভারতে কুম্ভমেলা ছিল আধ্যাত্মিক চর্চার কেন্দ্র ও জ্ঞানবিনিময়ের ক্ষেত্র। ঋষি-মুনিদের তত্ত্ব ও দার্শনিক আলোচনার মাধ্যমে এটি এক ঐতিহাসিক গুরুত্ব অর্জন করেছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ সালে এই মেলার কথার উল্লেখ কোথাও কোথাও পাওয়া যায়। যুগের পর যুগ ধরে এই মেলা শুধুমাত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং হিন্দুধর্মের মূল সত্তাকে সংরক্ষণ করে আসছে।

মধ্যযুগে কুম্ভমেলা রাজসমর্থন লাভ করে আরও সমৃদ্ধ হয়। মৌর্য ও গুপ্ত সাম্রাজ্যের রাজারা মেলার ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন। এই সময়েই নানা আখড়া প্রতিষ্ঠিত হয়, যা আজও কুম্ভমেলার অন্যতম আকর্ষণ।

আধুনিক ভারতে কুম্ভমেলা আরও বৃহৎ ও সুশৃঙ্খল আকার ধারণ করেছে। সরকারের তত্ত্বাবধানে মেলার পরিকাঠামো উন্নত হয়েছে। প্রযুক্তির সাহায্যে আজকের কুম্ভমেলা শুধু আধ্যাত্মিকতার মেলবন্ধন নয়, এটি ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এক অনন্য প্রদর্শনী। ২০২৫-এর মহাকুম্ভ এক আধ্যাত্মিক ও ঐতিহাসিক যাত্রার সাক্ষী হতে চলেছে, যা ভারতীয় ঐতিহ্যের গভীরতা ও ধর্মীয় চেতনার প্রমাণ দেবে।

২০২৫ সালের মহাকুম্ভ নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে, কিন্তু জানেন স্বাধীন ভারতে প্রথম কুম্ভ কোথায় এবং কোন সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল? স্বাধীন ভারতের প্রথম কুম্ভ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক –


প্রকৃতপক্ষে, স্বাধীনতার আগেও, কুম্ভ, অর্ধকুম্ভ এবং মাঘ মেলা ব্রিটিশ সরকার দ্বারা আয়োজিত হত। এই সময়ে, ইংল্যান্ড থেকে অফিসাররা আসতেন, যারা মেলার ব্যবস্থাপনা দেখাশোনা করতেন। স্বাধীন ভারতে আয়োজিত প্রথম কুম্ভমেলার কথা যদি বলি, তাহলে এই মেলাটি প্রয়াগরাজে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। স্বাধীন ভারতের প্রথম কুম্ভ ১৯৫৪ সালে প্রয়াগরাজে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

এই কুম্ভ আয়োজনের প্রস্তুতি কয়েক মাস আগে থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহেরু এবং রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদও এই কুম্ভে অংশগ্রহণ করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহেরু মৌনী অমাবস্যার দিন সঙ্গমের তীরে স্নান করেছিলেন। এই সময়, একটি হাতি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার পর একটি দুর্ঘটনা ঘটে। জানা যায় যে এতে ৫০০ জন প্রাণ হারিয়েছিল। সেই থেকে কুম্ভে হাতির প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়।

শুধু তাই নয়, এই দুর্ঘটনার পর, প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু প্রধান স্নান উৎসবে ভিআইপিদের সঙ্গমে প্রবেশ নিষিদ্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আজও, অর্ধকুম্ভ, কুম্ভ এবং মহাকুম্ভের প্রধান স্নান উৎসবে ভিআইপিদের প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা বহাল রয়েছে। স্বাধীনতার পর, প্রয়াগরাজে অনুষ্ঠিত এই কুম্ভে ১২ কোটি মানুষ অংশগ্রহণ করেছিলেন।

এই কুম্ভের প্রস্তুতি তৎকালীন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী গোবিন্দ বল্লভ পন্ত নৌকায় করে এবং পায়ে হেঁটে পর্যালোচনা করেছিলেন। কথিত আছে যে এই কুম্ভে ভক্তদের চিকিৎসার জন্য সঙ্গমের তীরে সাতটি অস্থায়ী হাসপাতাল নির্মিত হয়েছিল। হারানোদের পুনরায় একত্রিত করার জন্য এবং জনতাকে তথ্য দেওয়ার জন্য লাউডস্পিকারও ছিল। এছাড়াও, আলোর জন্য, কুম্ভে ১০০০টি রাস্তার আলোও স্থাপন করা হয়েছিল।

এই কুম্ভমেলার প্রধান শাহী স্নানের (Kumbh Mela 2025 Sahi Snan Dates) তারিখ দেখুন এক নজরে:
- ১৩ জানুয়ারি ২০২৫: পৌষ পূর্ণিমা
- ১৪ জানুয়ারি ২০২৫: মকর সংক্রান্তি (প্রথম শাহী স্নান)
- ২৯ জানুয়ারি ২০২৫: মৌনি অমাবস্যা (দ্বিতীয় শাহী স্নান)
- ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫: বসন্ত পঞ্চমী (তৃতীয় শাহী স্নান)
- ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫: অচলা সপ্তমী
- ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫: মাঘী পূর্ণিমা
- ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫: মহাশিবরাত্রি ( এই কুম্ভের শেষ শাহী স্নান )
