Laxmi Puja: ধান্যলক্ষ্মীর আরাধনায় রয়েছে চিরন্তন অন্নপূর্ণার রূপ: লিখছেন
অবন্তিকা গোস্বামী ও অরিত্র ঘোষ দস্তিদার

0
1297

দেবী লক্ষ্মীকে আমরা থিতু, অচলা করে রাখতে চাই, তা আমাদের গৃহেই হোক কিংবা গোলায়! গোলায় গোলায় ধান থাকলে, তবেই গলায় গলায় গান আসে। দেবী দুর্গার অন্নদাত্রী রূপ অর্থাৎ আউশধান কেটে গোলায় ভরে উঠলেই শারদীয়া দুর্গাপূজার বাদ্যি বেজে ওঠে। তারপরই পূর্ণিমা তিথিতে অনুষ্ঠিত হয় কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো। কোথাও তাঁর রূপ সোনা-ধানের পাকা-ফসলের অবয়বে, ধান্যলক্ষ্মী হয়ে। প্রস্তুতি নিবন্ধে আমরা ধনলক্ষ্মীর কথাই বলবো।

বঙ্গমাতা ধান্য সম্পদে পরিপূর্ণ। বঙ্গের মতো ধান্য বৈচিত্র্য বোধহয় কোথাও ছিল না। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের বহু জায়গায় বহু বিচিত্র ধানের নাম পাওয়া যায়। ধানের বৈচিত্র্যময় সম্ভারের নাম পাওয়া যায় হাণ্টার সাহেবের স্ট্যাটিসটিক্যাল অ্যাকাউন্ট অফ বেঙ্গলের নানান ভলিউমে। ‘ধানের আবাদে ধন’-লাভ হয়। এই ধানই তাই ভৌম সমাজের মূল লক্ষ্য! সেই ধানের দেবী লক্ষ্মী এইজন্যই যে, তিনি আশীর্বাদ করলে আমরা ধানচাষে অধিক ফলনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারবো। তিনি লক্ষ্মী, কারণ তিনি লক্ষ্য পূরণ করে দেন। সৌভাগ্য ও সমৃদ্ধির দেবী হয়েছেন, কারণ ধানচাষ করে একদিন কৃষক সমৃদ্ধ হতে পারতেন।

শাস্ত্রে দেখা যায় দেবী লক্ষ্মী ভগবান নারায়ণের পত্নী। যে শক্তি দ্বারা বিষ্ণু জগৎ সংসারকে পালন করছেন সেই শক্তিই হলেন মা লক্ষ্মী। আমাদের শাস্ত্রে মা লক্ষ্মীর অষ্টরূপের কথা উল্লেখ আছে। সেই আটটি রূপ হল – আদিলক্ষ্মী, ধনলক্ষ্মী, ধান্যলক্ষ্মী, গজলক্ষ্মী, সন্তানলক্ষ্মী, বীরলক্ষ্মী, বিজয়ালক্ষ্মী এবং বিদ্যালক্ষ্মী ।

এর মধ্যে আমাদের অনেকের গৃহে ‘ধান্যলক্ষ্মী’-র আরাধনা করা হয়। এর মধ্যে ঢাকা অঞ্চল থেকে আসা বাঙাল বাড়িতে এই পুজো অতি প্রচলিত। গৃহে বছরে পাঁচবার ধান্যলক্ষ্মীর পূজা করা হয়ে থাকে। পৌষ, চৈত্র, ভাদ্র, আশ্বিন (কোজাগরী পূর্ণিমা) ও কার্তিক (দীপান্বিতা লক্ষ্মী) — এই পাঁচ মাসের পূর্ণিমা বা অমাবস্যা তিথিতে মা লক্ষ্মীর আরাধনা করা হয়। উপাসকের গৃহে মা লক্ষ্মী নারায়ণের সঙ্গে একাসনে পূজিতা হন। ধান্যলক্ষ্মী পূজায় ধান ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ধান হল এই পূজার এক গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রী।

এই পূজার জন্য একটি চৌকি নিয়ে তার ওপর ধান ঢালা হয়ে থাকে। তারপর তার উপর পেঁচা, সিঁদুর কৌটো, ধান ভর্তি লক্ষ্মীর ঝাঁপি ইত্যাদি দিয়ে সাজানো হয়। এই ধানের উপর লক্ষ্মী- নারায়ণ অধিষ্ঠান করেন। অগ্রহায়ণ মাসের নতুন আমন ধান ঢেলে পৌষ মাসেও এই পূজা শুরু হয় এবং পরের বছর পৌষ মাস না আসা পর্যন্ত এই ধানেই বাকি মাসের পূজা সম্পন্ন হয়। এই ধান একটি পবিত্র হাঁড়িতে রেখে দেওয়া হয়। আবার পৌষ মাস এলে এই পুরোনো ধান পরিবর্তন করে নতুন ধান দিয়ে পূজা হয়। এই পূজায় সতেরোটি ধান, সতেরোটি দূর্বার সঙ্গে তুলায় মুড়ে মা লক্ষ্মীকে অর্ঘ্য হিসেবে প্রদান করতে হয়।

এটি ধান্যলক্ষ্মী পূজার এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সাধারণত এই পূজা পঞ্চোপচারে হয়ে থাকে, পঞ্চপচার হল – গন্ধ, পুষ্প, ধূপ, দীপ, নৈবেদ্য। জলপূর্ণ ঘট আম্রপল্লব দিয়ে সাজানো হয় এবং সিঁদুরের ফোঁটা দিয়ে ঘটে স্বস্তিক চিহ্ন আঁকা হয়। এছাড়াও পূজার স্থানে কোশাকুশি, পানিশঙ্খ প্রভৃতি দিয়ে সাজানো হয়। আঁকা হয় ধানের শীষ, মা লক্ষ্মীর পদযুগল, পেঁচা প্রভৃতি। এখানে ঠাকুরকে অন্নভোগ নয়, ফল ও মিষ্টি প্রদান করা হয়ে থাকে। ‘মা, তুমি তো অন্ন দিয়েছো গোলা উপচিয়ে, এই দেখো আমি তাই তোমার জন্য ফলবাগিচা রচনা করেছি। এই দেখো, কেমন নারকেলের মিষ্টি বানিয়েছি, তোমার জন্য।”

পুজোর দিন মধ্যাহ্নে সন্দক লবণের সহকারে আতপ চাল খাওয়ার প্রচলন আছে। বৈজ্ঞানিকদের মতে এই লবণের অনেক উপকারিতা আছে। এটি এক ধরণের খণিজ পদার্থ, যাকে খাঁটি নুন হিসেবে মানা হয়। এই নুনের মধ্যে সাধারণ নুনের তুলনায় অনেক কম আয়োডিন থাকে। তবে এতে ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, সালফার, দস্তার মতো নানা উপকারি খনিজ উপাদান থাকে। বলা হয় সন্ধক লবনে ৯০ ধরনের খনিজ উপাদান মজুত থাকে।

বঙ্গনারীর সমস্ত কার্য সম্পন্ন হলেই কুল-পুরোহিত এসে পুজো করেন। পুজো শেষে আরতি সম্পন্ন হয় ও অপরূপ ছন্দে পাঁচালী পড়া হয়।

প্রত্যেক প্রাণীর কাছেই আবশ্যক হলো খাদ্য। এই খাবার আমাদের পুষ্টি প্রদান করে। ইংলিশে এক প্রবাদ প্রচলিত আছে, “হেলথ ইস ওয়েল্থ” অর্থাৎ “স্বাস্থ্যই সম্পদ”। তাই খাদ্য হলো ধন। আর বাঙালির প্রধান খাদ্য তো আমরা জানি – ধান। এই ধানের বিনিময়ে একসময় পাওয়া যেত নানান সামগ্রী। ধানের ব্যবসা, ধানের হাট, এসবই লক্ষ্মীর আশীর্বাদধন্য। ধান কৃষিজীবী মানুষের যেমন ধন, ব্যবসায়ীর ধনও বটে। এই ধন, ধান, অর্থ, সম্পদ ও সমৃদ্ধির প্রতীক আমাদের মা লক্ষ্মী। ধান্যলক্ষ্মী হলেন ধান এবং অন্যান্য কৃষিজ ফসলের দেবী । তাই আজ কোজাগরী পূর্ণিমা তিথিতে সেই রীতি মেনে পূজা হচ্ছে বাংলার নানান জায়গায়।

লক্ষ্মীপুজো এক নারীব্রতও বটে। বাড়ির মায়েরা এদিন দেবীর কাছে কী কামনা করেন? বলেন —
“গাছে থাকো মা ফুল ফল আর মাঠে সোনার ধান।
দুধে ভাতে বেঁচে থাক মা তোমারই সন্তান।।”
বাংলার নারীর চিরায়ত প্রার্থনা এই —
“বৃক্ষে বিরাজ মা ফুল ফল সমান
দিয়েগো মাঠে সোনার বরণ ধান।” মায়ের চিরকালের প্রার্থনা তার সন্তান যেন দুধেভাতে থাকে।

Previous articleLaxmi Puja 2022: মা লক্ষ্মীর আরাধনায় অপরাজিতা
Next articleMulayam Singh Yadav:প্রয়াত মুলায়ম সিং যাদব,‘‌জরুরি অবস্থায় গণতন্ত্রের লড়াইয়ে অন্যতম সৈনিক ছিলেন’‌,শোকবার্তা মোদীর

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here