কলকাতার রাধা গোবিন্দ কর (আর জি কর) মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে কতর্ব্যরত অবস্থায় ৩১ বছর বয়সী তরুণী শিক্ষানবিশ চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠা গোটা ভারতের সাথে সংহতি জানিয়ে এবার বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাও প্রতিবাদে ফুঁসে উঠল, জানাল আন্দোলনের সাথে সংহতি৷ এসময় তারা কলকাতা থেকে বাংলাদেশ, সব জায়গায় এসব ঘটনার ন্যায়বিচার ও দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দ্রুত নিশ্চিত করার দাবি নিয়ে রাত দখল করে ।
দেখুন ভিডিও
১৬ আগস্ট শুক্রবার বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যে ‘আওয়াজ তোলো নারী, কলকাতার পাশে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীবৃন্দ’র ব্যানারে অনুষ্ঠিত এক প্রতিবাদ সমাবেশে এমন দাবি জানান তারা। রাত ১০টায় একই জায়গায় বিভিন্ন বয়সের মহিলারা মিছিল নিয়ে জড়ো হন। পালন করেন ‘মেয়েরা রাত দখল করো’ কর্মসূচি৷ তারা তিলোওমা’র ধর্ষণকারী ও নৃশংস হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেন৷ গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে তনু ও মুনিয়াসহ প্রতিটি ধর্ষণ মামলারও এদিন সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করেন তারা৷
বিকেল সাড়ে চারটের সময় শিক্ষার্থীরা- ‘তনু থেকে তিলোওমা’, কুমিল্লা থেকে কলকাতা’, ‘ধর্ষকের সাজা একটাই, মৃত্যু ছাড়া কথা নাই’, ‘জাস্টিস ফর তিলোওমা’ , স্টপ রেপ’, ‘এই অসুরদের জন্য মানবিকতা নয়, ‘আওয়াজ তোলো নারী’ সহ নানা স্লোগানে প্রতিবাদ জানান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃত্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থী জিনিয়া বলেন, “আজকে আমরা সেই ঘটনার প্রায়শ্চিত্ত করতেই দাঁড়িয়েছি। বাংলাদেশেও অসংখ্য ধর্ষণের ঘটনার মামলাই হয় না। অনেক ঘটনার মামলা হলেও তার কোনও বিচার হয় না। এমনও হয় যে অনেক ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল না হলে কেউ জানতেও পারে না। আমরা চাই, এমন ঘটনা যেন না হয় বা হলেও যেন ভুক্তভোগী নারী যেন তার বিচার পায়। কলকাতা থেকে বাংলাদেশ সব জায়গায় যেন নারীরা ন্যায়বিচার পায় আমরা সেই দাবি জানাই।” অন্যান্য বক্তারা বলেন, দেশে এত ধর্ষণের মাঝে আমরা হিসেব মেলাতে পারি না। কিন্তু সেসবের কোনও প্রতিকার হয় না। এসব নিয়ে প্রোপারলি খবরও হয় না। এমনও হয়, ঘটনার চার্জশিট গঠন করতেই বছর সময় লেগে যায়। বিচারকার্য শেষ হয় না বছরের পর বছর পার হলেও। আমরা ধর্ষণ হওয়ার আগে চুপ থাকি, যখন কাউকে ধর্ষণ করে হত্যা করে ফেলে যায় তখন আমরা রাজুতে (সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্য) এসে প্রতিবাদের জন্য দাঁড়াই। এক হিসাব অনুযায়ী এক বছরে সাড়ে ৪ হাজার ধর্ষণের দাখিলকৃত মামলা হয়েছে। কিন্তু পরিবারের সদস্য, শিক্ষক, বন্ধুদের দিয়ে নারীরা যে পরিমাণ হেনস্তার শিকার হয় সেটার হিসাব কেউ রাখে না। তারা বলেন, সবকিছু সরকারের ওপর ছেড়ে দিলে হবে না। নিজেরাও এর প্রতিবাদ করতে হবে। এমন ঘটনা যখন কোনও বন্ধু করতে যাবে, যখন সে গায়ে হাত দেওয়ার চেষ্টা করবে তখন তাকে থাপ্পড় দিতে হবে, প্রয়োজন হলে তাকে পুলিশে দিয়ে দেন। দেখবেন বন্ধু হয়ে এমন করার সাহস করবে না।
তারা আরও বলেন, দেশের ৯৯ শতাংশ নারীই কোনও না কোনোভাবে হেনস্তার শিকার হয়েছে। সেটা অধিকাংশই বন্ধু বা কাছের মানুষ দ্বারাই হয়েছে। কিন্তু আমরা জানি না কত পুরুষ ধর্ষক, কত ছেলেদের মানসিকতা পরিষ্কার। আমরা ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে চিনি কিন্তু সেই ধর্ষকদের চিনি না। আমরা দাবি জানাই, এসব ঘটনা নিয়ে যেন আলাদা সেল গঠন করা হয় এবং ধর্ষকদের যথাযথ বিচার হয়।
রাত ১০ টায় রাজু ভাস্কর্যের সামনেই ‘তিলোওমা’র ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে চলমান প্রতিবাদের প্রতি সংহতি জানিয়ে ‘মেয়েরা রাত দখল করো’ কর্মসূচি পালন করেন কয়েক হাজার মহিলা সমাবেশ থেকে নানা প্ল্যাকার্ড হাতে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো হয়৷ সমাবেশে উপস্থিত থেকে কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা শারমিন মুরশিদ, অধ্যাপক তানিয়া মাহমুদা তিন্নি, সংগীতশিল্পী ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান, অভিনেত্রী নওশাবা, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী ড. শহিদুল আলম সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও মানবাধিকারকর্মীরা।
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা শারমিন মুরশিদ বলেন, “আমি আজ এখানে আপনাদের কথা শুনতে এসেছি। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে আমরা কাজ করব।” শিক্ষক তানিয়া মাহমুদা তিন্নি বলেন, “ভারত এবং বাংলাদেশ স্বাধীনতার এত বছর পরেও নারীবান্ধব হয়ে ওঠেনি। প্রীতিলতার মতো নারী যোদ্ধারা যারা পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছেন, তারা কি এই স্বাধীনতা চেয়েছিলেন? স্বাধীনতার পর দীর্ঘ সময় বাংলাদেশে নারী প্রধানমন্ত্রী থাকলেও তাঁরা নারীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা, নতুন বাংলাদেশ চাই যেখানে নারীদের সমান অধিকারের আইন বিদ্যমান থাকবে।” সমাবেশে বক্তারা বলেন, “দেশের সরকার প্রধানেরা কখনো নারীদের জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারেনি। দেশের আইনে এখনো বৈষম্য রয়েছে। ফলে নারীরা সমান সুযোগ পায় না। নতুন দেশে এমন আইন প্রয়োজন, যেখানে নারীদের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত হবে।” সমাবেশে শিক্ষার্থীরা বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের হলে দেরি করে ঢুকলে হল প্রশাসন চরিত্র হননের চেষ্টা করে থাকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সবাই শিক্ষা অর্জন করতে আসে। চারিত্রিক সনদ নিতে নয়।” সমাবেশে বক্তারা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার জন্য নিরাপদ দেশ গড়ার আহ্বান জানান। এরপর শাহবাগ চত্বরে নারীরা মশাল মিছিল নিয়ে বের হন৷ তখন পুরুষরাও একাত্ম হয়ে নারীদের সাথে সাথে একই স্লোগানে প্ল্যাকার্ড হাতে এগিয়ে যান৷ এসময় তারা ‘ঢাকা থেকে কলকাতা উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, তিলোওমা’, রাস্তায় আমরা তোমার মিতা’, ‘গুঁড়িয়ে দেব পিতৃতন্ত্র, কেঁপে উঠবে রাষ্ট্রযন্ত্র’, ‘পোশাকের বাহানায়, পার পাবে না কোনো পিশাচ’, ‘প্রশ্ন যখন স্বাধীনতার, বাংলাজুড়ে ওয়াদ্দেদার’, ‘নো মিনস নো, ইয়েস মিনস ইয়েস’, ‘ধর্ষকের কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’, ‘আজাদী আজাদী’ প্রভৃতি স্লোগানে মুখর করে তোলেন ঢাকার রাজপথ৷ এদিন ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম, বরিশাল ও সিলেটেও ‘তিলোওমা’র ধর্ষক ও খুনিদের বিচার চেয়ে গোটা ভারতবর্ষের আন্দোলনের সাথে সংহতি জানিয়ে প্রতিবাদ সমাবেশ ও মশাল মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ তিলোওমা’র ধর্ষণ ও খুনের প্রতিবাদে রাজপথে নেমে আসা ভারতীয়দের প্রতি সংহতি জানিয়ে মোমবাতি প্রজ্বলন ও সমাবেশ করেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি), বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় (ববি) সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও৷